ঢাকার চাপ বিকেন্দ্রীকরণে যে প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, তার আওতায় বিদেশ সফরের সুযোগ থাকছে সরকারি কর্মকর্তাদের।
গত ৭ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘রেজিলিয়েন্ট আরবান অ্যান্ড টেরিটরিয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (আরইউটিডিপি)’ শীর্ষক ওই প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এটি ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় ও চলতি অর্থবছরের তৃতীয় একনেক সভা।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
অনুমোদিত ওই প্রকল্পে বিদেশ ভ্রমণ, পরামর্শক, প্রশিক্ষণ ও বিশেষজ্ঞ খাতে ৩০০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এছাড়া প্রকল্পটির আওতায় প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা নতুন গাড়ি কেনার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অথচ সম্প্রতি সরকার অচল গাড়ি সচল করে চালাতে নির্দেশনা দিয়েছে।
সরকারের মোট কত গাড়ি আছে, সেগুলোর মধ্যে কতগুলো নষ্ট বা বসে আছে- সে হিসাব বের করা হবে বলে ৭ অক্টোবর জানান শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সেদিনের একনেক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
এর আগে ২০২৩ সালের দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল বিগত সরকার। এরপর এই প্রকল্পটির মাধ্যমে আবারও সরকারি টাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের অনুমোদন দেওয়া হলো।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা শুরু হয়। তার প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতেও। দেশের অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনাও অর্থনীতির সংকট বাড়ায়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের নির্দেশ দিয়ে ২০২২ সালের ১২ মে পরিপত্র জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এরপর সর্বশেষ গত ৪ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপনে ডলার-সংকটের কারণে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ সীমিত রাখার নির্দেশনা জারি করা হয়। এছাড়া ওই পরিপত্রে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সরকারি অর্থ ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের নানা দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।
২০২৩ সালেও রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ রাখা হয়েছিল। এখনও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগ কাটেনি সরকারের।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের প্রায় তিন মাস অতিবাহিত হলেও দেশের শিল্প ও বাণিজ্য খাতে আসেনি গতি। মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের অর্থনীতি।
এমন পরিস্থিতিতে এই প্রকল্পের আওতায় বিদেশ ভ্রমণ, পরামর্শক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের জন্য বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলো।
প্রকল্প ব্যয়ে আগের ধারাবাহিকতা
অন্তর্বর্তী সরকারের একনেক সভায় অনুমোদন পাওয়া একটি প্রকল্পে এভাবে ইচ্ছামতো বরাদ্দ দেওয়া ‘হাতাশাজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “প্রকল্পে এই ধরনের ব্যয়ে আগের যে ধারাবাহিকতা ছিল নতুন বাস্তবতায়ও একই ধারাবাহিকতা আছে। এখানে যারা অনুমোদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন, তারা এই বিলাসী খাতটা যদি না দেখে থাকেন, প্রশ্ন করে না থাকেন, তাহলে আগের সরকারের সাথে এদের (বর্তমান সরকার) মধ্যে কোনও পার্থক্য আমি দেখতে পাচ্ছি না।
“আগের সরকারের সময়ে সবাই হালুয়া রুটি খাওয়ায় ছিল। এই ডিসিশন চেইনে সবাই বেনিফিটেড হতো। বিদেশ ভ্রমণে যাওয়া, ট্রান্সফার অব টেকনোলজিতে যাওয়া এগুলো অবশ্যই এই সরকার প্রশ্ন করতে পারতো।”
বর্তমান সরকারকে একটি সচেতন সরকার মনে করেন জানিয়ে ‘তাদের সময়ে যদি এই প্রকল্প অনুমোদন হয়ে থাকে- এটা অত্যন্ত হতাশার কথা’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের এই অধ্যাপক আরও বলেন, “যেকোনও প্রকল্পের অধীনে আগের সরকার গাড়ি কেনা, বিদেশ সফরসহ যেসব বিলাসী বরাদ্দ দিত, এই সরকার তো অন্তত ওনারা (বর্তমান সরকার) চেক দিতে পারতেন।
“এসব সুবিধা তো শেষ পর্যন্ত আমলাদের হাতে গিয়েই পড়ে, তাহলে মানুষ অন্তত বুঝতো যে উন্নয়নটা গতানুগতিক না হয়ে জনগণের অর্থের জবাবদিহিতা স্থাপন করে ওনারা প্রজেক্ট অনুমোদন করেছেন।”
“ওইটা যদি না হয়ে আবার সেই গাড়ি কেনা, আবার সেই ট্রান্সফার অব টেকনোলজির নামে বিদেশ ঘুরতে যাওয়া, নন টেকনিক্যাল লোক ঘুরতে যাওয়া, এটা অত্যন্ত হতাশার কথা আমি বলব” যোগ করেন শামসুল হক।
প্রকল্পের প্রধান কাজ ও বরাদ্দ
ঢাকায় জনসংখ্যার বাড়তি চাপ কমাতে দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও জেলা শহরে সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে কর্মকাণ্ডের বিকেন্দ্রীকরণে সরকার যে প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে, তাতে ব্যয় হবে ৫ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ৪ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির মাধ্যমে দেশের ৬টি সিটি করপোরেশন ও ৮১টি পৌরসভার জলবায়ু সহনশীল নগর অবকাঠামো উন্নয়নে ৮৮০ কিলোমিটার নগর সড়ক, ২ হাজার মিটার ব্রিজ-কালভার্ট, দশটি পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে ১০টি টার্মিনাল ও ১০টি পৌর কাঁচাবাজার নির্মাণ করা হবে।
বেশ কয়েকটি পৌরসভায় ৫৯৫ কিলোমিটার সড়কবাতি স্থাপন, ১০টি মার্কেট কাম-কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করা হবে।
এছাড়া প্রকল্পটির আওতায় ২০০ কিলোমিটার ফুটপাথ, ৪৮০ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ, ২০টি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ, দিনাজপুরে একটি মিউনিসিপ্যাল বিল্ডিং নির্মাণ এবং ৭০টি গাড়ি কেনা হবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে গৃহীত প্রকল্পটি ২০৩০ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।
কোন খাতে কত বরাদ্দ
প্রকল্পের নথিতে অবকাঠামো নির্মাণের বাইরে ব্যয় বিভাজনে দেখা যায়, বিদেশ ভ্রমণে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫ কোটি টাকা। দেশে ভ্রমণের জন্য রাখা হয়েছে ৭ কোটি টাকা। আবার পেট্রোল ও লুব্রিক্যান্ট কেনার খাত উল্লেখ করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
পরামর্শক ফি হিসেবে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৩০ কোটি টাকা। আবার ইনডিভিজ্যুয়াল কসালট্যান্ট (পরামর্শক) হিসেবে রাখা হয়েছে ১০ কোটি টাকা।
প্রকল্পের কার্যক্রম অডিট ১ম, ২য় পর্যায় খাত নামে বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। পরিবেশ, আর্থিক ও ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ খাতে বরাদ্দ দিয়েছে প্রায় ১২ কোটি টাকা।
নতুন গাড়ি কেনা হবে ১২ কোটি ৪০ লাখ টাকার। দুই ধরনের ট্রেনিংয়ের জন্য (দেশে) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির জন্য স্ট্যাম্প ও সিল কেনার জন্য রাখা হয়েছে ৩৮ লাখ টাকা, প্রিন্টিং বাইন্ডিংয়ের জন্য রাখা হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। আবার অন্যান্য স্টেশনারি খাত দেখিয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছে আরও ৩ কোটি টাকা।
প্রকল্পটিতে এভাবে অবাধ বরাদ্দের কথা শুনে অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে ৭০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন স্থানীয় সরকার বিভাগ।
“বাংলোদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা রয়েছ এই প্রতিষ্ঠানের। সড়ক, ফুটপাত, টয়লেট ও কিচেন মার্কেট তৈরির মতো কাজ এই প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনও বিষয়ই নয়।”
১৯৫৯ সালের ‘বেসিক ডেমোক্রেসি অর্ডার’ আইনের অধীনে স্থানীয় সরকার বিভাগ গঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির অধীনে বর্তমানে ১৩ হাজার ৩৯৪ জন জনবল রয়েছে। যেখানে উপজেলা পর্যায়ে ১০ হাজার ৩০৫ জন, জেলা পর্যায়ে ২ হাজার ১৫৬ জন, আঞ্চলিক ৩০০ জন, বিভাগীয় পর্যায়ে ১১০ জন এবং সদর দপ্তরে ৩১৯ জন জনবল রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির জনবলের মধ্যে কয়েকশ প্রকৌশলীও রয়েছে।
এসব তথ্য জানিয়ে অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “তাই এই প্রকল্পের জন্য এতো বিপুল ব্যয়ের পরামর্শক ব্যয় ও বিদেশ ভ্রমণ কেন দরকার- আমি বুঝতে পারছি না।”
এ বিষয়ে জানতে শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে গত ৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত একনেক বৈঠকে আরও তিন প্রকল্পসহ এই প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে আসেন উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এসময় এক প্রশ্নের উত্তরে উপদেষ্টা বলেন, প্রকল্প বেশি যাচাই-বাচাই করতে গিয়ে বেশি সময় চলে গেলে চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, “এগুলো যদি এখনই পাস করে না দেওয়া হয়, এগুলো যদি আরও সংশোধন করতে যাই, তাহলে এবছর শেষ পর্যন্ত বৈদেশিক সাহায্য যা বরাদ্দ আছে, সেটা আবার চলে যাবে। আবার নতুন করে ওদের সাথে নেগোশিয়েট করতে হবে।”
এই প্রকল্পের ত্রুটি চিহ্নিত হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ওয়াহিউদ্দিন মাহমুদ সেদিন বলেন, “স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা (এ এফ হাসান আরিফ) এই প্রকল্প নিয়ে আগেই বলেছিলেন যে, আমরা যেন প্রকল্পটি পড়ে দেখি। কারণ, এটার মধ্যে অনেক ত্রুটি আছে। আমি তাকে তখনই বলেছিলাম যে, না এখনই আমরা এটা পাস করে দেই। কারণ, বিদেশি অর্থায়নটা আমাদের অন্তত থাকুক।
“আমরা দাতাদের সাথে আলাপ করে নিয়েছি, এখন একনেকে পাস করে নিয়েছি; কিন্তু (পরে) তাদের সাথে বসে প্রকল্পগুলো প্রয়োজনে বদলিয়ে দিতে পারব। এমনভাবে বদলাব নীতিমালার মধ্যে, যাতে ভবিষ্যতে কোনও সরকার এসে যাতে না বলতে পারে যে, আমরা শুধু এতোগুলো গাড়ি কিনব। এতোগুলো অট্টালিকা তৈরি করতে পারব। এটা যাতে না হয়, তার একটা নীতিমালাও এর সাথে করে দেব।”
এই প্রসঙ্গ টেনে অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “বৈদেশিক মুদ্রার অভাব মেটাতে ঋণ নিয়ে সেই ঋণ যদি আবার তারাই পরামর্শক বা অন্য আরও শর্ত দিয়ে তারাই নিয়ে যায়, তাহলে সেই ঋণ আমার কেন দরকার?”