রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর দেশে বিক্ষোভ-বিদেশে প্রতিক্রিয়ায় আলোচিত নাম এখন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী। তাকে জড়িয়ে ইসকন নিষিদ্ধের দাবিও উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসকনের বাংলাদেশ শাখা বলেছে, সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত চিন্ময়ের কোনও কাজের দায় তারা নেবে না।
চিন্ময়কে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ থেকে চট্টগ্রামে সংঘাতে এক আইনজীবী নিহত হওয়ার ঘটনায় মর্মাহত হওয়ার কথা জানিয়ে তাকে খুনে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিও করেছে ইসকন।
সংগঠনটির নেতারা বলেছেন, ভারতের সঙ্গে জড়িয়ে ইসকনকে নিয়ে অপপ্রচার চলছে, যার কোনও ভিত্তি নেই। আর ইসকন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সম্পূর্ণ অহিংস একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে সনাতন জাগরণ মঞ্চের ব্যানারে যে সমাবেশ হয়, তার অন্যতম সংগঠক ছিলেন চিন্ময় ব্রহ্মচারী। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় তখন ইসকনেরও নেতা ছিলেন।
২৫ অক্টোবর সেই সমাবেশের দিন চট্টগ্রাম নগরীর নিউ মার্কেট মোড়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ওপরে ইসকনের গেরুয়া রঙের আরেকটি পতাকা ওড়ানোর অভিযোগে চিন্ময়সহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেন স্থানীয় এক বিএনপি নেতা।
সেই মামলায় গত সোমবার চিন্ময়কে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন তাকে চট্টগ্রামের আদালতের মাধ্যমে পাঠানো হয় কারাগারে। চিন্ময়ের অনুসারীরা আদালতে বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে বাধে সংঘাত, তার মধ্যে ধারাল অস্ত্রের আঘাতে খুন করা হয় সাইফুল ইসলাম নামে এক আইনজীবীকে।
এদিকে চিন্ময়কে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ইসকনের আন্তর্জাতিক শাখা থেকে বিবৃতি আসে, ভারত সরকারও তার মুক্তির দাবি জানিয়ে বিবৃতি দেয়। অন্যদিকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসকন সাম্প্রদায়িক বাঁধানোর পাঁয়তারা চালাচ্ছে অভিযোগ করে সংগঠনটি নিষিদ্ধের দাবি তোলে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
এই প্রেক্ষাপটে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে বৃহস্পতিবার ঢাকার স্বামীবাগে ইসকন বাংলাদেশের আশ্রমে সংবাদ সম্মেলনে আসেন সংগঠনটির নেতারা।
‘চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের প্রতিবাদ’ শিরোনামে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী।
সংবদ সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইসকন বাংলাদেশের সভাপতি সত্য রঞ্জন বাড়ৈ, সঞ্চালনায় ছিলেন ইসকন বাংলাদেশের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হৃষীকেশ গৌরাঙ্গ দাস।
চিন্ময় বহিষ্কৃত
চিন্ময় ব্রহ্মচারী ইসকনের নেতা হিসাবেই আগে পরিচিত ছিলেন। ভক্তরা তাকে ‘চিন্ময় প্রভু’ নামেই ডাকেন। তার চিন্ময় নামটিও আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘে (ইসকন) যোগ দেওয়ার পরই নেওয়া। বাংলাদেশে ইসকনের মুখপাত্রের ভূমিকায়ও ছিলেন তিনি।
হিন্দুদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদিঘী মাঠে ‘সনাতন জাগরণ মঞ্চ’ ব্যানারে যখন সমাবেশ হয়েছিল, তখন তারও মুখপাত্র ছিলেন চিন্ময়। এরপর বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ ও বাংলাদেশ সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোট নামে দুটি সংগঠন ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’ ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হলে তার মুখপাত্র করা হয় চিন্ময়কে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “আমরা সবাইকে পুনরায় অবহিত করতে চাই যে, অনেক মাস আগেই প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলারাজ গৌর দাস, সদস্য স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস এবং চট্টগ্রামস্থ পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ইসকনের সাংগঠনিক পদ/পদবীসহ ইসকনের যাবতীয় সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং উল্লেখ করা হয় যে, তাদের দ্বারা সংঘটিত কার্যক্রম ইসকনের কার্যক্রম নয়।”
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হৃষীকেশ দাস বলেন, “নৈতিক স্খলনের অভিযোগে চিন্ময় কৃষ্ণকে দাসকে আগেই ইসকন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।”
এখন চিন্ময়ের কোনও কাজের সঙ্গে ইসকনের কোনও সম্পর্ক নেই দাবি করে চারু ব্রহ্মচারী বলেন, “গত ৩ অক্টোবর অফিসিয়াল বিবৃতির মাধ্যমে জানানো হয় যে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাস (চন্দন কুমার ধর) ইসকন বাংলাদেশের মুখপাত্র নন।
“তাই তার বক্তব্য সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত। অতএব, লীলারাজ গৌর দাস, স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ও চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বক্তব্য এবং কৃতকর্মের জন্য ইসকন বাংলাদেশ কোনোভাবেই দায়বদ্ধ নয়।”
আইনজীবী খুনের বিচার দাবি
ইসকন বাংলাদেশের সভাপতি সত্য রঞ্জন বাড়ৈ চট্টগ্রামের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যাকাণ্ডে তার সংগঠনের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, “তার মর্মান্তিক অকাল মৃত্যু আমাদের মর্মাহত করেছে। এ নির্মম ঘটনার সাথে জড়িত দুষ্কৃতিকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে জোরালোভাবে আহ্বান জানাই।”
আইনজীবী সাইফুল হত্যাকাণ্ডে ইসকনের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই দাবি করে চারু ব্রহ্মচারী বলেন, “ইসকন বাংলাদেশ একটি অরাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সংগঠন, যা সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং মানবকল্যাণে নিবেদিত।
“আমরা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছি যে, বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত এ সকল ঘটনার সাথে ইস্কনের কোনও সম্পৃক্ততা নেই।”
গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর কিছু মহল থেকে ইসকনকে বিতর্কিত করার লক্ষ্যে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলা হচ্ছে বলে দাবি করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
চারু ব্রহ্মচারী বলেন, “বিশেষত চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর এ অপচেষ্টা চরমে পৌঁছেছে। এই মিথ্যাচার এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সড়ক দুর্ঘটনার মতো বিষয়গুলোকেও ইসকনের চক্রান্ত বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
“চট্টগ্রাম কোর্ট ভবনের সামনে সংঘটিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসকন বাংলাদেশকে অন্যায়ভাবে দায়ী করার অপচেষ্টা চলছে। আমরা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই, এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা এবং চলমান আন্দোলনের সঙ্গে ইসকন বাংলাদেশের কোনও ধরনের সম্পৃক্ততা নেই।”
ভারতের সঙ্গে ‘সম্পর্ক নেই’
চিন্ময় ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের পর প্রতিক্রিয়া আসে ভারতের কাছ থেকে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে।
ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ শাখার নেতারা কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। রাজ্য বিধান সভায় বিজেপির সদস্যরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী বাংলাদেশ সীমান্ত অবরোধের হুমকিও দিয়েছেন।
এই প্রেক্ষাপটে ইসকনকে ভারতের মদদপুষ্ট সংগঠন হিসাবে দেখিয়ে তা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে।
সংবাদ সম্মেলনে চারু ব্রহ্মচারী ইসকনকে নিষিদ্ধ করার দাবি ‘অযৌক্তিক’ মন্তব্য করে বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে একাধিকবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এবং সরকার ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি পরিষ্কার করেছি।
“কিন্তু দুঃখজনকভাবে কিছু বিশেষ মহল ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের সংগঠনের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।”
হৃষীকেশ গৌরাঙ্গ দাস বলেন, “ইসকন একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, অনেকেই ভাবেন যে এটি ভারতীয় সংগঠন। অথচ ভারতের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। ইসকন বিশ্বের ১৫৮টি দেশে পরিচালিত হচ্ছে।
“আমরা আমাদের ঘরে থাকা তেলাপোকা পর্যন্ত হত্যা করি না, উল্টো তাদের খাবার পাওয়া নিশ্চিত করি। এরকম একটি সংগঠনের বিরুদ্ধে এমন অপপ্রচার খুবই দুঃখজনক।”
ইসকন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধে সরকারের সহযোগিতাও চেয়েছেন সংগঠনটির নেতারা।
“তদন্ত করে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। যারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের সংগঠনের সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।”
দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় যেকোনও প্রকার উষ্কানিমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থেকে সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বানও জানান ইসকন নেতারা।