পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইসলামী ব্যাংকের মোট শেয়ারের মধ্যে সিংহভাগই ধারণ করছে বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। সেসব শেয়ার আগামী জানুয়ারির মধ্যে বেচে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করছে ব্যাংকটি। এর বাইরেও ব্যাংকটি নতুন করে আরও শেয়ার ইস্যু করবে।
সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ এ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। এসময় তিনি ইসলামী ব্যাংকের পুরনো শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠান সৌদি আরবের আল রাজীকে পুনরায় এ ব্যাংকের শেয়ার ধারনের প্রস্তাব করা হবে বলেও জানান।
ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, “এস আলম ইসলামী ব্যাংকের ১৭টি শাখা থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। শুধু টাকা নেয়নি, আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ব্যাংকের যে সম্পর্ক ছিল, সেটাও ধ্বংস করে দিয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “ব্যক্তি এস আলম আর প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ এক বিষয় নয়। আমরা এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকোর মতো কোনও প্রতিষ্ঠানই বন্ধের পক্ষে নই। কোনও প্রতিষ্ঠান মরতে দেওয়া হবে না। কারণ, সব প্রতিষ্ঠান জাতীয় সম্পদ। তবে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।
“সব ব্যাংককে রক্ষা করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব। পরিচালনায় বদল এনেও যেসব ব্যাংক এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সব আমানতকারীকে রক্ষা করা হবে।”
ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা গভর্নরের সঙ্গে কথা বলেছি। এই ব্যাংকের পুরনো উদ্যোক্তা সৌদি প্রতিষ্ঠান আল রাজিকে আনার চেষ্টা চলছে। আইএফসিকেও যুক্ত করার চেষ্টা করা হবে।”
ইসলামী ব্যাংকের উন্নতি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তিন মাসে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা আমানত বেড়েছে। প্রবাসী আয় বাড়ছে। নতুন বিনিয়োগ দেওয়া বন্ধ আছে। ব্যাংকের ২ হাজার ৭০০ এজেন্ট পয়েন্টে তিনজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তারা ব্যাংকের আমানত বাড়াতে ভূমিকা রাখছেন।”
২০১৭ সালে মালিকানা পরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের (বর্তমানে পিএলসি) বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ছাড়তে শুরু করেন। এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগে ইসলামী ব্যাংকের ৫০ শতাংশের বেশি মালিকানা বিদেশি উদ্যোক্তাদের হাতে ছিল। এখন তা কমে ১৭ দশমিক ৮৯ শতাংশে নেমেছে।
এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ধীরে ধীরে শেয়ার ছেড়ে দেয় ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), দুবাই ইসলামী ব্যাংক, ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড করপোরেশন দোহা, ইসলামিক ব্যাংকিং সিস্টেম ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং লুক্সেমবার্গ, শেখ আহমেদ সালেহ জামজুম, শেখ ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল-খতিব, আল-রাজি গ্রুপ, কুয়েতের সরকারি ব্যাংক কুয়েত ফাইন্যান্স হাউস, সৌদি কোম্পানি আরবসাস ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিস্ট এজেন্সিসহ বেশির ভাগ বিদেশি উদ্যোক্তা ও সাধারণ শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠান।
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের মোট শেয়ার সংখ্যা ১৬০ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজারের ৬৬৮টি। এর মধ্যে উদ্যোক্তা-পরিচালকের কাছে দশমিক ১৮ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগককারীর কাছে ৭৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারী ১৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে আছে ৭ দশমিক ১৯ শতাংশ শেয়ার।
ব্যাংকটির মোট শেয়ারের মধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে এস আলম গ্রুপের কাছে রয়েছে ১৩২ কোটি ১ লাখ ৯২ হাজার ৩৪৮টি শেয়ার।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইসঙ্গে ইসলামী ব্যাংকে এস আলম পরিবারের সদস্য ও প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি ও হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে দেশে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলমকে (এস আলম)। বিগত সরকারের সময়কার আলোচিত ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এস আলমের বিরুদ্ধে ব্যাংক খাতের অর্থ লুটপাটসহ অনেক অভিযোগ রয়েছে।
বিএসইসির পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক সময়ের দেশের শীর্ষ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিকে ২০১৭ সালে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেয় সদ্য বিদায় নেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপ। এরপর সাড়ে সাত বছরে নামে-বেনামে ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ। এই অর্থ ব্যাংকটির মোট ঋণের এক-তৃতীয়াংশ।