রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের পর কয়েকদিন দেশের পুঁজিবাজারে যে বড় উত্থান দেখা যায়, সেই ভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরবর্তী সময়ে সরকারের বিভিন্ন নীতির কারণে অনেকটাই সতর্ক বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী।
বুধবার দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৪১ পয়েন্টের বেশি কমেছে। কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দর।
এই পরিস্থিতির মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের দর বেড়েছে চলেছে। দেড় মাসে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকটির দর বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি ১১৬ শতাংশ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়।
এরপর গত দেড় মাসে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চার শতাধিক কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে ইসলামী ব্যাংকের। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকার সময় ফ্লোর প্রাইস ৩২ টাকা ৬০ পয়সায় ক্রেতা ছিল না ব্যাংকটির শেয়ারের।
বুধবার সেই ব্যাংকের শেয়ার ৭০ টাকা ৪০ পয়সায় লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন ব্যাংকটির দাম ৬ টাকা ৪০ পয়সা বেড়েছে। শতাংশ হিসাবে বেড়েছে ১০ শতাংশ। সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার লেনদেন শেষ হয়েছিল ৫৪ টাকা ৩০ পয়সায়।
ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনায় কোনও কারসাজি হয়েছে কি না—তা তদন্তের জন্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) নির্দেশ দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বুধবার জারি করা এক আদেশে বিএসইসি বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের মূল্য ও পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে ওঠানামা করেছে, যা অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক বলে মনে হয়।
বাজারের হেরফের, অভ্যন্তরীণ লেনদেন এবং শেয়ারের ইউনিটের দাম ও পরিমাণের অস্বাভাবিক গতিবিধির পেছনে অন্য কোনও কারণ আছে কি না—তা চিহ্নিত করতে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের লেনদেন ৬ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তদন্ত করতে ডিএসইকে বলেছে বিএসইসি।
আগামী ৩০ দিনের মধ্যে ডিএসইকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
ডিএসইতে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির গত তিন মাসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই সময়ে ইসলামী ব্যাংক ছাড়া অন্য ব্যাংকগুলোর শেয়ারের দাম তেমন বাড়েনি। দুর্বল মানের কিছু ব্যাংকের শেয়ারদর এ সময়ে কমেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুরকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই নানা অনিয়ম, ঋণ কেলেঙ্কারি ও পাহাড়সম খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনতে নানা উদ্যোগ নেন।
সে উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত ২১ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনার কথা জানান। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদ ভেঙে দিয়ে সরকারের সহযোগিতায় ছোট আকারে পর্ষদ গঠন করা হবে।
পরের দিন ২২ আগস্ট রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
একইসঙ্গে চার জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা হলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ খুরশীদ ওয়াহাব, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল জলিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. এম মাসুদ রহমান ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট আবদুস সালাম।
এর মধ্য দিয়ে এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয় ইসলামী ব্যাংক। মূলত এরপর থেকেই ব্যাংকটির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ে; চড়তে থাকে দাম।
ডিএসইর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এক মাসের ব্যবধানে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ। গত ২৫ আগস্ট ব্যাংকটির শেয়ারের দর ছিল ৪৪ টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে গিয়েছিল দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক। তবে অন্তর্বর্তী সরকার তাদের থেকে মুক্ত করেছে।
এখন ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালক হওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি ব্যবসায়িক গ্রুপ ব্যাংকটির শেয়ার কিনছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তাই ব্যাংকের শেয়ারের ওপর ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা সত্ত্বেও এর দাম বাড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ব্যাংক দখলের পর সেখান থেকে নামে-বেনামে বিপুল অঙ্কের ঋণ উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে এস আলমের নামে। বর্তমানে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, সিআইডি ও দুদক এস আলম গ্রুপ ও এর চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো তদন্ত করছে।
গত ২৭ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদ প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় গত সাড়ে সাত বছরে ব্যাংক থেকে নেওয়া সব ঋণ পুনঃনিরীক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্রোকারেজ হাউসের কর্ণধার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মালিকানা বদলের ফলে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা যেমন দুর্বল হয়ে গিয়েছিল, তেমনি অনিয়মের ঘটনাও ঘটেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের ধারণা, ব্যাংকটি পরিচালনায় গুণগত পরিবর্তন হবে। এমনকি পুরনো শেয়ারধারীদের কেউ কেউ আবার মালিকানায় ফিরতে পারে। এসব কারণে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের দর বাড়তে পারে।”
“এর বাইরে ব্যাংকটির দর অস্বাভাবিক বাড়ার ক্ষেত্রে কোনও কারসাজি হচ্ছে কি না—তা তদন্তের জন্যই ডিএসইকে নির্দেশ দিয়েছে বিএসইসি,” বলেন তিনি।