জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে (ইউএনআরডব্লিউএ) নিষিদ্ধ করে আইন পাস করেছে ইসরায়েল। আগামী তিন মাসের মধ্যে সংস্থাটি ইসরায়েল ও পূর্ব জেরুজালেমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না।
ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে সোমবার সন্ধ্যায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় দুটি বিল পাস হয়েছে।
বিলটি উপস্থাপন করার সময় নেসেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক ও নিরাপত্তা কমিটির চেয়ারম্যান ইউলি এডেলস্টাইন ইউএনআরডব্লিউএকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য ঢাল হিসেবে ব্যবহার’ করার অভিযোগ করেন।
তিনি আরও বলেন, “সন্ত্রাসী সংগঠন হামাস ও ইউআরপব্লিউএর মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ইসরায়েল এটি সহ্য করতে পারে না।”
ইউএনআরডব্লিউএ কর্মীদের সঙ্গে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের যোগাযোগও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে গাজা ও পশ্চিম তীরে সংস্থাটির কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়বে।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করতেই হয় সংস্থাটিকে। কারণ তারাই গাজার সব সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই এলাকায় সাহায্য সরবরাহে ইউএনআরডব্লিউএর জন্য এই সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইসরায়েলে ইউএনআরডব্লিউএর কর্মীদের আর কোনো আইনি সুরক্ষা দেওয়া হবে না। এমনকি পূর্ব জেরুজালেমে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ও বন্ধ করে দেওয়া হবে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “এসব আইন বাস্তবায়ন করা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সমাধান এবং গোটা অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হবে।”
অন্যদিকে ইউএনআরডব্লিউএর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেছেন, “এটি ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ আরও বাড়াবে।”
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের এই পদক্ষেপের প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি একে ‘সম্পূর্ণ ভুল’ বলে অভিহিত করেছেন। আর দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টার্মার বলেছেন, “এই আইনগুলো ইউএনআরডব্লিউএর ফিলিস্তিনিদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কাজকে অসম্ভব করে তুলবে এবং গাজার সমগ্র আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তাকে ঝুঁকিতে ফেলবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, গাজায় মানবিক সহায়তা বিতরণে ইউএনআরডব্লিউএ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই অঞ্চলের বিশ লাখেরও বেশি মানুষ সংস্থাটির সহায়তা ও সেবার ওপর নির্ভরশীল।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, “ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ইউএনআরডব্লিউএ কর্মীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।” তবে তিনি গাজায় অব্যাহত মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে, এমনটাও বলেন।
সোশাল মিডিয়া এক্সে নেতানিয়াহু বলেন, “আমরা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত, যাতে ইসরায়েল তার নিরাপত্তার ঝুঁকি না নিয়ে গাজার বেসামরিক জনগণের জন্য মানবিক সহায়তা দিতে পারে।”
কয়েক দশক ধরেই ইসরায়েল ইউএনআরডব্লিউএর বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে আসছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই বিরোধিতা আরও বেড়েছে।
ইসরায়েলের দাবি, ইউএনআরডব্লিউএ কর্মীরা গাজায় হামাসের সঙ্গে যোগসাজশ করেছে। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ১৯ জন ইউএনআরডব্লিউএ কর্মী অংশ নিয়েছিল।
জাতিসংঘ ইসরায়েলের অভিযোগ তদন্ত করেছে এবং অভিযুক্ত নয়জন কর্মীকে বরখাস্ত করেছে। তবে জাতিসংঘ জানিয়েছে যে, ইসরায়েল তাদের অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ সরবরাহ করেনি।
ইউএনআরডব্লিউএ বলছে, হামাসের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ শুধুমাত্র সংস্থাটির কাজ পরিচালনার জন্য।
ইউএনআরডব্লিউএ দীর্ঘদিন ধরে গাজার লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাসহ বিভিন্ন সেবা ও সহায়তা দিয়ে আসছে।
যুদ্ধ শুরুর পর সংস্থাটি বেসামরিকদের কাছে মানবিক সহায়তা পাঠানোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। গাজার প্রায় সব ফিলিস্তিনিই সংস্থাটির সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।
ইউএনআরডব্লিউএর কমিশনার জেনারেল ফিলিপ লাজারিনি এই নিষেধাজ্ঞাকে ‘অন্যতম নজিরবিহীন’ ঘটনা বলে নিন্দা করেছেন। তিনি বলেন, এটি জাতিসংঘের চার্টারের বিপরীত এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ইসরায়েল রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতার লঙ্ঘন”।
তিনি বলেছেন, “গাজার বাসিন্দারা এরই মধ্যে নির্মম অবস্থা সহ্য করছে। এর ফলে সেখানে সাড়ে ছয় লাখের বেশি শিক্ষার্থীকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করবে। এটি পুরো প্রজন্মের শিশুদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।”
ইউএনআরডব্লিউএ সংস্থায় পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজার প্রায় ২৫ লক্ষাধিক মানুষ নিবন্ধন করেছে।
উত্তর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী এখনও হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। সেখানে কয়েক লাখ মানুষ অসহনীয় পরিস্থিতিতে বসবাস করছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক শুক্রবার বলেছেন, “ইসরায়েলি সেনাবাহিনী একটি সম্পূর্ণ জনসংখ্যাকে বোমা হামলা, অবরোধ ও অনাহারের ঝুঁকির মুখোমুখি করছে।”
গত এক বছরে ইসরায়েলের হাতে ৪২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
তথ্যসূত্র : বিবিসি।