Beta
শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪

স্লোগান নিয়ে কেন তুলকালাম লোকসভায়

মঙ্গলবার লোকসভায় শপথ নেওয়ার সময় আসাদউদ্দিন ওয়াইসি (বামে), রাহুল গান্ধী (মাঝে), ছত্র পাল সিং গাঙ্গওয়ার (ডানে)।
মঙ্গলবার লোকসভায় শপথ নেওয়ার সময় আসাদউদ্দিন ওয়াইসি (বামে), রাহুল গান্ধী (মাঝে), ছত্র পাল সিং গাঙ্গওয়ার (ডানে)।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

ভারতের ১৮তম লোকসভার প্রথম অধিবেশন ছিল মঙ্গলবার। সেদিন নবনির্বাচিত বিধায়করা শপথ নেন। আর শপথ নিতে গিয়ে ‘জয় ফিলিস্তিন’ স্লোগান দিয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেন আসাদ উদ্দিন ওয়াইসি।

তেলেঙ্গানা রাজ্যের হায়দরাবাদ থেকে অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন পার্টির হয়ে নির্বাচিত হয়েছেন আসাদ উদ্দিন ওয়াইসি। শপথ নেওয়ার এক পর্যায়ে তিনি জয় ফিলিস্তিন স্লোগান দেওয়ায় ক্ষেপে ওঠেন বিজেপির (ভারতীয় জনতা পার্টি) বিধায়করা।

বিজেপির বিধায়করা ওয়াইসির বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন। তাদের মতে, তিনি পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অন্য জাতির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করছেন। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওয়াইসি।

তার দাবি, ওই স্লোগানের মধ্যে ভারতের সংবিধান পরিপন্থী কিছু ছিল না। ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে মহাত্মা গান্ধী কী বলেছিলেন, সেই বিষয়টিও পড়ে দেখতে বলেন ওয়াইসি।

জয় ফিলিস্তিন স্লোগানকে কেন্দ্র করে সেদিন পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলোর বিধায়করা পাল্টাপাল্টি স্লোগান দেন। এসব স্লোগানের কিছু ছিল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে।

বিজেপির এমপিদের ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানের বিপরীতে বিরোধীরা বন্দে মাতরম, জয় হিন্দ, জয় বাংলা, জয় মমতাসহ বিভিন্ন স্লোগান দেন। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের একজন বিধায়ক ‘আল্লাহু আকবার’ বলেও স্লোগান দেন।

ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সহমর্মিতা ও সমর্থন পোষণ করে ভারত। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ১৯৬০ সালে ফিলিস্তিনের গাজায়ও সফর করেছিলেন।

তবে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে গত তিন দশকে ইসরায়েলের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে দেশটির। ফলে দেশটির সরকারগুলো এখন ইসরায়েলের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সম্পর্ক এবং ফিলিস্তিনের প্রতি ঐতিহাসিক সমর্থন, এই দুটি বিষয়ের মধ্যে সতর্কভাবে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে।

কী বলেছিলেন ওয়াইসি

শপথ নেওয়ার সময় ওয়াইসি উর্দুতে বলেন, “আমি, আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, যিনি লোকসভার সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়েছি। আল্লাহর নামে শপথ করছি যে, আমি ভারতের সংবিধানের প্রতি আন্তরিক এবং অনুগত থাকব। আমি ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব ও অখণ্ডতা বজায় রাখব এবং এই পদের অধীনে আমাকে অর্পিত দায়িত্ব আমি আনুগত্যের সঙ্গে পালন করব।”

তারপর শপথ মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার আগে তিনি “জয় ভীম, জয় মিম, জয় তেলেঙ্গানা, জয় ফিলিস্তিন” স্লোগান দেন।

‘জয় ভীম’ হল একটি দলিতপন্থী স্লোগান, যা ভারতীয় সংবিধানের দলিত প্রতিষ্ঠাতা ভীমরাও আম্বেদকরকে নির্দেশ করে। দলিতরা ঐতিহাসিকভাবে ভারতীয় সমাজের জটিল বর্ণভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসের তলানিতে অবস্থান করে।

মিম হল উর্দু বর্ণমালার একটি অংশ যা ইংরেজিতে ‘এম’ এর প্রতিনিধিত্ব করে এবং ওয়াইসি এর মাধ্যমে তার দল অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীনকে (এআইএমআইএম) বুঝিয়েছেন, যা এমআইএম (মিম) নামেও পরিচিত। আর তেলেঙ্গানা ওয়াইসির রাজ্যের নাম।

ওয়াইসি কে

আসাদুদ্দিন ওয়াইসি ২০০৪ সাল থেকে তেলেঙ্গানার হায়দরাবাদ নির্বাচনী এলাকা থেকে পাঁচবার লোকসভার সদস্য হয়েছেন। তিনি সেখানকার একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার বাবা সালাহউদ্দিন ওয়াইসি ১৯৮৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত হায়দরাবাদ থেকে ৬বার এমপি হয়েছিলেন।

ওয়াইসি ২০০৮ সাল থেকে এআইএমআইএম-এর সভাপতি। আঞ্চলিক এই দলটির ইশতেহারে মুসলিমদের অধিকার, সব ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বৃহত্তর অধিকার, পাশাপাশি দলিত অধিকারের কথা বলা হয়েছে। ওয়াইসি পার্লামেন্টে তার বক্তৃতার জন্যও পরিচিত।

অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে এআইএমআইএম বিজেপির নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সে (এনডিএ) যোগ দেয়নি। এমনকি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গেও যায়নি।

তার বিরুদ্ধে কি কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে

জয় ফিলিস্তিন বলায় ওয়াইসি সমালোচনা ও অভিযোগের মুখে পড়েছেন যে, তিনি ভারতের সংসদে দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিনের প্রতি আনুগত্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিজেপি এমপিরা বলছেন, ওয়াইসি ভারতীয় সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।

বিজেপির তথ্য প্রযুক্তি প্রধান অমিত মালভিয়া মঙ্গলবার এক্সে পোস্ট করেছেন, “বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী আসাদুদ্দিন ওয়াইসিকে তার লোকসভা সদস্যপদ থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে, একটি বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য, সেটি হল ফিলিস্তিন।”

মালভিয়া ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২-এর একটি ধারা পোস্ট করেছেন। এতে বলা আছে, ভারতের নাগরিক হয়ে কেউ বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখালে তাকে পার্লামেন্ট থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা যাবে।

তবে অন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়াইসি কোনও নিয়ম ভঙ্গ করেননি। আর তাছাড়া তিনি একা নন, এদিন আরও অনেক এমপি শপথ গ্রহণ শেষে বিতর্কিত স্লোগান দিয়েছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও হিন্দি অধ্যাপক অপূর্বানন্দ আল জাজিরাকে বলেছেন, “আমি মনে করি না ওয়াইসিকে অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে। কারণ শপথ নেওয়ার সময়, প্রায় সব সদস্যই বিভিন্ন ধরণের বিতর্কিত স্লোগান দিয়েছিলেন।”

অপূর্বানন্দ ব্যাখ্যা করে বলেন, এর আগের নির্বাচনগুলোর পরে শপথ নেওয়ার সময় এমপিরা সাধারণত শপথের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতেন। তবে এবারের নির্বাচন একটু ভিন্ন ছিল এবং বিভিন্ন ধরনের ইস্যু ছিল। পরিবেশ-পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়ায় এমপিরাও নিজেদের ভিন্নভাবে প্রকাশ করার প্রয়োজন অনুভব করেন।

তিনি বলেন, “এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি ও কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। মোদীর দল এক দশক ক্ষমতায় থাকার পর প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু মিত্রদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করতে পেরেছে।”

অপূর্বানন্দ আরও উল্লেখ করেছেন যে, ওয়াইসির জয় ফিলিস্তিন শ্লোগানটি তার আনুষ্ঠানিক শপথ শেষ করার পরে এসেছিল। এর আগে তিনি ভারতের প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, “ফিলিস্তিনকে অভিনন্দন জানানো ভারতের সংবিধান লঙ্ঘন করে না। শপথ নেওয়া শেষ করার পর কিছু বললে তা আর রেকর্ড করা হয় না।”

এমনকি বিজেপির রাধা মোহন সিং, যিনি সভাপতির আসনে ছিলেন, তিনিও বিক্ষুব্ধ বিজেপি সংসদ সদস্যদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন এই বলে যে, শপথ গ্রহণের পরে যে স্লোগান দেওয়া হয়েছে তা রেকর্ডে যাবে না।

তবুও পার্লামেন্ট বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেছেন যে, তিনি এ ব্যাপারে নিয়মগুলো খতিয়ে দেখবেন।

বিজেপি বিধায়কদের বিতর্কিত স্লোগান

বিজেপির ছত্রপাল সিং গাঙ্গওয়ার “জয় হিন্দু রাষ্ট্র” দিয়ে তার শপথ শেষ করেন। বিজেপির আদর্শিক পরামর্শদাতা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আহ্বান জানিয়ে আসছে।

গাঙ্গওয়ারের স্লোগানের প্রতিবাদে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের এমপিরাও পাল্টা স্লোগান দিয়েছেন। ভারত সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। তাই সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব এই স্লোগানে আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, “এটি সংবিধানের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে যায়।”

আরেক বিজেপি এমপি অতুল গর্গ তার শপথ নেওয়ার পর বলেছিলেন ‘নরেন্দ্র মোদী জিন্দাবাদ’। বিরোধীরা তাকে নিন্দা জানানো শুরু করলে তিনি রেগে গিয়ে ফের মঞ্চে উঠে আসেন। এবার তিনি আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেজেওয়ারের উল্লেখ করে ‘ড. হেজেওয়ার জিন্দাবাদ’ বলেন।

সংবিধান হাতে শপথ কংগ্রেস বিধায়কদের

কংগ্রেস দলের নেতা রাহুল গান্ধী ও সমাজবাদী পার্টির যাদবসহ অনেক বিরোধী এমপি মোদির অধীনে বিজেপির কথিত বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হাতে ভারতীয় সংবিধানের একটি অনুলিপি ধরে শপথ নেন।

মঙ্গলবার ১৯৭৫ সালে কংগ্রেসের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক জাতীয় জরুরি অবস্থা জারির বার্ষিকীও ছিল। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের আগে হাজার হাজার সমালোচক এবং রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। নাগরিক স্বাধীনতা স্থগিত করা হয়েছিল, এবং গণমাধ্যমের ওপরও দমন-পীড়ন চালানো হয়।

বিজেপি বিধায়করা সেসময় কংগ্রেসের সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে কংগ্রেস ও ইন্ডিয়া জোটের বিধায়কদের ভণ্ড বলে নিন্দা করেন।

মোদীও মঙ্গলবার এক্সে পোস্টে করেছন, “যারা জরুরি অবস্থা জারি করেছে, তাদের আমাদের সংবিধানের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করার অধিকার নেই।”

অধ্যাপক অপূর্বানন্দের মতে, মঙ্গলবারের শপথ অনুষ্ঠান থেকে শুরু হওয়া অগণিত বিতর্কগুলো সামনের দিনে ভারতের আরও জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করছে।

তিনি বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে ভোট শেষের পরই নির্বাচনও শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এবার নির্বাচন এখনও শেষ হয়নি। এই যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে এবং ফলাফল ঘোষণার পরও শেষ হয়নি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত