জামায়াতে ইসলামী ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে- বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীর এমন বক্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া এল তার রাজনৈতিক মিত্র দলটির কাছ থেকে।
রবিবার এক অনুষ্ঠানে রিজভী ওই বক্তব্য দেওয়ার পরপরই জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম একটি বিবৃতি দেন। তাতে বিএনপিকেই ‘মোনাফেক’ বলেন তিনি।
আরবি শব্দ মোনাফেকের অর্থ হচ্ছে প্রতারক বা ভণ্ড ব্যক্তি। রবিবারের বক্তব্যে এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রিজভী। পাল্টায় তাকেও একই কথা শুনতে হলো।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ যখন রাজনীতির মাঠে অনুপস্থিত, তখন বিএনপি ও জামায়াতের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেখা যাচ্ছে।
কী বলেছিলেন রিজভী
বিএনপি নেতা রিজভী রবিবার ঢাকার চন্দ্রিমা উদ্যানে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারতের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় একাত্তরে জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থান তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “৫ আগস্টের আগে ব্যাংক লুট ও দখল করেছিল আওয়ামী লীগ আর ৫ আগস্টের পর ব্যাংক দখল করছে একটি ইসলামী দল।”
“৫ আগস্টের পর একটি রাজনৈতিক দলের আত্মসাৎ দেখেছে জনগণ। কারা পায়ের রগ কাটে তাদের চেনে জনগণ। এখন ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে একাত্তরের বিরোধিতাকারী জামায়াত,” বলেন রিজভী, যিনি এক সময় রাকসুর ভিপি ছিলেন এবং সেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের দাপট।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জামায়াত শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করতে চায় বলেও মন্তব্য করেন রিজভী।
ধর্মকে আশ্রয় করে জামায়াতের রাজনীতির সমালোচনা করতে গিয়ে ‘মোনাফেকি’ শব্দটি বলেন তিনি।
“ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করে জামায়াত। কিন্তু ইসলাম মানে তো বারবার মোনাফেকি করা নয়।”
পাল্টা বিবৃতি জামায়াতের
রিজভীর ওই বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলামের বিবৃতিতে বলা হয়, “বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে ‘ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে হাসিনাকে ক্ষমা করতে চায় জামায়াত’ মর্মে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বিভ্রান্তিকর, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
“কারা দলীয় টিম নিয়ে ভারত সফর করে ভারতের সাথে সখ্য করার চেষ্টা করেছেন, তা জনগণ খুব ভালো করেই জানেন।”
ঘোলা পানিতে মাছ শিকার নিয়ে বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে রফিকুল বলেন, “এ জাতীয় বক্তব্য বিগত কয়েক দশক যাবৎ প্রচার করা হচ্ছে। রগ কাটা, ঘোলা পানিতে মাছ শিকার, ৭১ এর বিরোধিতা এ সব বক্তব্য জনগণ বহু পূর্বেই প্রত্যাখ্যান করেছে।
“জনাব রিজভী জামায়াতের বিরুদ্ধে এসব কথা উচ্চারণ করে কী অর্জন করতে চান, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। জামায়াত রগকাটা ও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের রাজনীতি কখনও করেনি।”
মোনাফেকি নিয়ে বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে রফিকুল বলেন, “জামায়াত ‘ইসলাম’ নিয়ে রাজনীতি করে না। ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতি করে। জামায়াতে ইসলামী কখনও মোনাফেকি করেনি।
“জনাব রিজভী অবশ্যই অবগত আছেন ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত জোটকে এড়িয়ে ভিন্ন মতের লোকদের সাথে জোট করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে ঐক্য করা হয়েছিল, তা কী জাতির সাথে মোনাফেকি নয়? জনগণ এই রাজনৈতিক ছন্দ পতনের ইতিহাস ভুলে যায়নি।”
বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক
একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছিল পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমানের শাসনকালে।
গত শতকের ৮০ এর দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় জামায়াতে ইসলামী কোনও জোটে ছিল না। ১৯৮৬ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১০টি আসনও জিতেছিল।
১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছিল জামায়াত, সেটাই তাদের আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের সূচনা। সেই সংসদে বিএনপির কাছ থেকে সংসদে দুটি নারী আসন পেয়েছিল জামায়াত।
তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন শুরু হলে বিএনপির সঙ্গে ছেড়ে সেই আন্দোলনে যোগ দেয় জামায়াত।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর আবার পুরনো মিত্র বিএনপির কাছে ভেড়ে জামায়াত; ১৯৯৯ সালে তাদের বন্ধন মজবুত হয়ে ওঠে জোট গঠনের মধ্যদিয়ে। চারদলীয় জোটে শুরু থেকেই জামায়াত ছিল।
২০০১ সালে খালেদা জিয়া সরকার গঠনের সময় জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মো. মুজাহিদকে মন্ত্রী করেন।
জরুরি অবস্থা পেরিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিএনপি জোটের পরিসর বাড়িয়ে ১৮ ও ২০ দলীয় জোট গঠন করলেও জামায়াত ছিল।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে একের পর এক জামায়াত নেতাদের দণ্ড এবং শাহবাগ আন্দোলনের পর জামায়াত থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করে বিএনপি।
যুদ্ধাপেরাধের বিচারে শীর্ষ নেতাদের সাজার প্রতিবাদে আন্দোলনে বিএনপিকে পাশে না পাওয়ার অভিযোগ তখন তোলেন জামায়াতের নেতারা। তবে ২০১৪ সালে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতও ভোট বর্জন করে।
২০১৮ সালে বিএনপি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। ভোটের দুই মাস আগে ওই বছরের ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রকাশ্যে আসে।
ওই ফ্রন্টে জামায়াত ছিল ছিল না, ২০ দলীয় জোট আছে কি না, তাও বিএনপি স্পষ্ট করছিল না। তবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনহারা জামায়াতের নেতারা সেবার বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে ভোটে অংশ নিয়েছিল।
নির্বাচনের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আর বেশি দিন সক্রিয় থাকেনি। এরপর সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙা করতে যুগপৎ আন্দোলনের কৌশল নেয় বিএনপি।
যুপপৎ কর্মসূচির শুরুতে জামায়াত থাকলেও পরে তাদের তেমন সক্রিয়তা দেখা যায়নি। বিএনপি-জামায়াত জোট আছে কি না, সেই প্রশ্নে কোনও দলের নেতারাই স্পষ্ট করে কিছু বলছিলেন না।
এরপর গত মার্চ-এপ্রিল মাসে রমজানে ইফতার পার্টিতে দুই দলের নেতাদের পারস্পরিক অংশগ্রহণ সম্পর্কে জোড়া লাগার ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
অভ্যুত্থানের পর শুরুতে দুই দলের নেতারা আওয়ামী লীগের ফিরে আসা ঠেকাতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা বললেও দিন যত গড়াচ্ছে, তাদের দূরত্ব বাড়তেই দেখা যাচ্ছে।