দিল্লির কবরস্থানে একটি নামফলক লেখা আছে উর্দু আর ইংরেজিতে। যাকে নিয়ে লেখা তার নাম গের্দা ফিলিপসবর্ন। তিনি মারা গেছেন ১৯৪৩ সালের ১৪ এপ্রিল। মর্মর পাথরে কার নামের ঠিক নিচে লেখা আছে ‘আপাজান’। আরও লেখা আছে, তিনি ১৯৪৩ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার জন্য কাজ করেছেন।
ভারতে মুসলমানদের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হলো জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া। রাজনৈতিক আন্দোলনে এখানকার শিক্ষার্থীরা ঐতিহাসিক ভাবেই সরব। ২০১৯ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের সময়ও প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কেন জড়িয়ে ছিলেন গের্দা ফিলিপসবর্ন? দূরদেশ থেকে আসা জার্মান ইহুদি এই নারী কী করে একজন ‘আপাজান’ হয়ে উঠলেন?
এসব প্রশ্নের উত্তর আছে বন্ধুত্ব ও জীবনের মানে খোঁজার মাঝামাঝি কোথাও; অভিমত গবেষক মার্গ্রিট পারনাউয়ের।
’জামিয়াস আপাজান: দ্য মেনি লাইফওয়ার্ল্ডস অব গের্দা ফিলিপসবর্ন’ বইটির লেখক মার্গ্রিট পারনাউ এক দশক ধরে জামিয়া নিয়ে গবেষণা করেছেন।
এই পুরো সময় আপাজানের কথা অনেকবার তার সামনে এসেছে; এরপরও মার্গ্রিট পারনাউ যেন সব জেনে উঠতে পারছিলেন না। তার মনে হয়েছিল গের্দা ফিলিপসবর্ন রহস্যে মোড়া কেউ একজন।
এমনকি আজকের দিনে অনেক শিক্ষার্থীও জানেনা কে ছিলেন ফিলিপসবর্ন? জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কী অবদান রয়েছে?
ইতিহাসবিদ এবং অ্যাকটিভিস্ট সাঈদা হামিদ বলেন, “তাকে (ফিলিপসবর্ন) নিয়ে লেখালেখির প্রয়োজন আছে; এসব শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে হবে, ভবিষ্যত প্রজন্মের ভালোর জন্যই।”
ফিলিপসবর্নের জার্মান মেমসাহেব থেকে জামিয়ার আপাজান হয়ে ওঠার গল্প শুরু হয় ১৯৩৩ সালে।
জাকির হোসেন, মুহাম্মদ মুজিব এবং আবিদ হোসেনের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে ওই বছর ভারতে আসেন ফিলিপসবর্ন। বার্লিনে পড়ালেখা করতে গিয়ে পরিচয় হয় তাদের।
এই তিন পুরুষ জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হয়ে ওঠেন এক সময়। রাজনীতিতেও এদের প্রত্যেকেই সক্রিয় ছিলেন। এদের মধ্যে জাকির হোসেন ১৯৬৭ সালে ভারতের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের ৩ মে রাষ্ট্রপতি দায়িত্বে থাকা অবস্থাতেই মারা যান তিনি।
স্বাধিকার আন্দোলনে অংশ নেওয়া তিন পুরুষ প্রায়ই ফিলিপসবর্নের কাছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি নিবেদিত একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ভাবনা নিয়ে বলতেন।
ব্রিটিশ ভারতে আমলে খুব বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। আর যে কয়েকটি ছিল তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি সরকারি অর্থ বরাদ্দ পেতো। ফিলিপসবর্নের তিন বন্ধুর স্বপ্ন ছিল, জামিয়া হবে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে মুসলমান ছেলেমেয়েরা নিজেদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলবে। তিন জন পুরুষ চাইতেন, হিন্দু ও মুসলমানদের মাতৃভূমির জন্য একতাবদ্ধ হওয়ার বার্তা দেবে এই প্রতিষ্ঠান।
বন্ধুদের এসব কথা ফিলিপসবর্নের মনে গভীর ছাপ ফেলে। ১৮৯৫ সালে এক ধনী পরিবারে জন্ম নেন ফিলিপসবর্ন। যুদ্ধ, শিল্পায়ন এবং ইহুদি বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ায় তার ছন্দময় জীবন ওলটপালট হয়ে যায়।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে নিপীড়িত হওয়া, স্বাধীনতার জন্য আকাঙ্ক্ষা করা এবং পরিবর্তনের একটি হাতিয়ার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত হওয়া কেমন লাগে,
মার্গ্রিট পারনাউ লিখেছেন, ফিলিপসবর্ন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন নিপীড়িত হওয়ার, স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার এবং দিন বদলের চাবিকাঠি হয়ে ওঠার অর্থ কী।
তাই পড়ালেখা শেষ করে বন্ধুরা যখন বার্লিন ছেড়ে ভারতে চলে এলেন জামিয়া গড়ে তুলতে, ফিলিপসবর্ন নিজেও আর বসে থাকেননি।
যদিও আধুনিক বার্লিন ছেড়ে ভারতে দরিদ্রতার মাঝে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব সহজ ছিল না।
পারনাউ বলছেন, বন্ধু জাকির হোসেন অনেকবারই ফিলিপসবর্নকে মানা করেছিল।
”কিন্তু ফিলিপসবর্ন বারবার জাকিরের সঙ্গে ভারতে আসতে চান। আর প্রতিবার তাকে নেতিবাচক হুঁশিয়ারি ও উপদেশ শুনতে হয়েছে।”
অন্যদিকে মোহাম্মদ মুজিব ভাবছিলেন, একজন অবিবাহিত, সঙ্গীহীন তরুণী জামিয়াতে কীভাবে মানিয়ে নেবে?
কারণ সেসময় পর্দার অন্তরালে থেকে পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে হতো নারীকে।
বন্ধুদের শত সতর্কতাতেও দমে যাননি ফিলিপসবর্ন।
মাসখানেকের মধ্যেই জামিয়ার অনেকের সঙ্গে সুসস্পর্ক গড়ে তুললেন তিনি। এমনকি জামিয়ার প্রাইমারি স্কুলে পড়ানোও শুরু করলেন। বাকি শিক্ষকদের মতো তিনিও খুব সামান্য বেতন নিতেন।
জার্মানিতে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল ফিলিপসবর্নের। তার পাঠদানের কৌশল শিক্ষার্থীদের ভালো লেগে যায়।
ফিলিপসবর্নের কাঁধে কির্ডারগার্টেন হোস্টেলের ওয়ার্ডেন পদের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়।
ফিলিপসবর্ন আপাজান হয়ে ওঠেন তখন থেকেই, বললেন লেখক পারনাউ।
আপাজানের মমতা আর স্নেহের ডোরে বাঁধা পড়ে যায় হোস্টেলের শিশুরা। তিনি শিশুদের গোসল করিয়ে দিতেন, চুলে তেল দিয়ে দিতেন, সারাক্ষণ কাছে কাছে রাখতেন।
পারনাউ বলেন, ”যখন কোনো শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ত তিনি এমন ভাবে সেবা করতেন যে ওই অসুস্থ বাচ্চা তার মায়ের কথা কখনও মনে করত না।”
জামিয়ার মেয়েদের সামাজিক কাজে উৎসাহ দিতের আপাজান। শিশুদের জন্য পায়েম-ই-তালিম নামে জার্নালে সম্পাদনা পর্ষদে যোগ দিয়ে মেয়েদের শখ এবং জার্নালে লেখায় উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজেও সক্রিয় ছিলেন আপাজান। বক্তৃতা লিখে দিতেন, শিক্ষকতা ও রাজনীতির যে কোনো বিষয়ে এগিয়ে আসতেন তিনি।
কিন্তু ভারতে সাত বছর কাটানোর পর হুট করে থমকে যেতে হলো তাকে।
তখন ব্রিটেন যুদ্ধ বাঁধিয়েছে জার্মানির সঙ্গে। ফলে ব্রিটিশ ভারতে থাকা জার্মান নাগরিকদের সন্দেহের চোখে দেখা হতো। সন্দেহভাজনকের আটক করে ক্যাম্পে রাখা হতো। তাদের পানি ও খাবারের কষ্ট দেওয়া হতো; কম্বল দেওয়া হতো না।
১৯৪০ সালে এমন এক ক্যাম্পে জায়গা হয় ফিলিপসবর্নেরও। তিনি ভীত হয়ে পড়েন। কারণ বন্দিদের তখন জার্মানি পাঠিয়ে দেওয়া হতো, যেখানে হিটলারের নির্দেশে ইহুদিদের নিধন চলছিল।
এতকিছুর পরও ক্যাম্পের অন্য বন্দিদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে চেষ্টা করতেন ফিলিপসবর্ন। কেউ অসুস্থ হলে সেবা করতেন তিনি।
কয়েক মাস বন্দিদশায় কাটানোর পর গ্যাস্ট্রিক আলসার দেখা দেয় ফিলিপসবর্নের। তাকে কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য রেখে আবারও ক্যাম্পে ফেরত আনা হয়। এরপর এক বছর কেটে যায় সেখানেই।
ক্যাম্প থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও জামিয়ায় চলে আসেন এই নারী। যদিও ততদিনে তার শরীরে আলসার থেকে ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে। দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এরপরও পায়েম-ই-তালিমে লিখে যেতেন শিশুদের জন্য।
১৯৪৩ সালের এপ্রিলে ফিলিপসবর্ন মারা যান। জামিয়া পরিবারের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
সাঈদা হামিদ বললেন, ”তিনি পরিবার থেকে বহু মাইল দূরে মারা গেলেন বটে, কিন্তু তাদের মাঝে রইলেন যারা তাকে ভালোবাসে।”
ফিলিপসবর্ন মারা যাওয়ার অনেক পরে জামিয়ার হোস্টেল ও ডে কেয়ার সেন্টার আপাজান নামে উৎসর্গ করা হয়।
তথ্যসূত্র : বিবিসি