Beta
শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

ভোটে আওয়ামী লীগকে চায় জাতীয় পার্টি

ঢাকার বনানীতে নিজের কার্যালয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
ঢাকার বনানীতে নিজের কার্যালয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
[publishpress_authors_box]

অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে দেখতে চায় জাতীয় পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের দাবি করছেন, তার দল ও আওয়ামী লীগের প্রতি এখনও দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের সমর্থন রয়েছে।

৬ ডিসেম্বর পালনে শনিবার ঢাকার বনানীতে দলের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে এক আলোচনা সভায় এই দাবি করেন জি এম কাদের।

নব্বইয়ের গণ আন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতনের দিনটি অন্য রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরাচার পতন দিবস হিসাবে পালন করলেও জাতীয় পার্টি সংবিধান সংরক্ষণ দিবস হিসাবে পালন করে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাতীয় পার্টিও রয়েছে চাপে। ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হিসাবে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও সম্প্রতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের বাইরে রাখার দাবিও রয়েছে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের।

এই প্রেক্ষাপটে শনিবারের আলোচনা সভায় জি এম কাদের বলেন, “কাউকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে হলে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে যেন সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”

নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, “যদি নির্বাচন হয়, সকলের পার্টিসিপেশন দরকার আছে। যতই বলেন, না বলেন ওই একতরফা করে শেখ হাসিনা নির্বাচন করেছেন, তার জন্য আমরা তাকে হেয় মনে করছি।

“এখন আপনারা একই জিনিস করবেন? সেইভাবেই করতে চাচ্ছেন? এটা হবে দুর্ভাগ্যজনক।”

কোনও দলের কর্মকাণ্ড আইন বিরুদ্ধ না হলে সে দলকে নির্বাচন এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা উচিৎ হবে না বলেও মন্তব্য করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।

তিনি বলেন, “তাদের মধ্যে যদি কেউ সন্ত্রাসী কাজ করে, তাকেই ধরে শাস্তি দেবেন। এটাই নিয়ম। একটি সংগঠনের সব লোকই কি খারাপ?

“যদি সেই সংগঠনের উদ্দেশ্য বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখল হয়, সমাজের জন্য ক্ষতিকর হলে সেই সংগঠনকে বাদ রাখা যায়। আর কোনও ব্যক্তি যদি ক্ষতিকারক হয়, সেটা ন্যায়বিচারের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। মব ট্রায়ালের মাধ্যমে নয়।”

আলোচনা শেষে সাংবাদিকরা জি এম কাদেদের কাছে প্রশ্ন রাখেন- জাতীয় পার্টি নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে চায় কি না?

জবাবে তিনি বলেন, “অব কোর্স, সব দল থাকবে। সব দলকে আসতে হবে। রেজিস্ট্রেশন দিয়েছেন, তাহলে তাকে কেন আসতে দিবেন না?”  

রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, তাতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে না রাখার সমালোচনাও করেন কাদের।

‘৫০ শতাংশ সমর্থন’ আওয়ামী লীগ-জাপার

অতীতের নির্বাচনগুলোর ফলাফলের পরিসংখ্যান তুলে ধরে জি এম কাদের দাবি করেন, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির জনসমর্থন সারাদেশে এখনও ৫০ শতাংশের বেশি। এই দাবির সপক্ষে তিনি ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল তুলে ধরেন।

২০০১ সালে বিএনপি ১৯৩ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। তাদের ভোটের হার ছিল ৪০ দশমিক ৯৭ শতাংশ। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬২টি আসন পেলেও ভোটের হার ছিল ৪০ দশমিক ১৩ শতাংশ। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোটের হার ছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।

২০০৮ সাল আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসনে বিজয়ী হয়, ৪৮ দশমিক ০৪ শতাংশ ভোট পায় এবং বিএনপি ৩০টি আসনে জয়ী হয়ে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৭ দশমিক ০৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৭টি আসনে জয় পেয়েছিল।

এরপর ২০১৪, ২০১৮ এর নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল। তবে তাদের ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের সমালোচনাও সইতে হয়েছে। এই বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি না এলেও জাতীয় পার্টির ফল ছিল তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ।

জি এম কাদের সর্বশেষ তিনটি নির্বাচনকে বাদ রেখেই ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের ভোটের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, “এই দুটি নির্বাচনে কোনও কারচুপি হয়নি। অন্য দলগুলোর কথা না বললেও আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি, এ দুটি দলকে বাদ দিয়ে যদি হিসেব করেন, তাহলে দেখবেন ৫০ শতাংশের বেশি মানুষকে জাতীয় ঐক্যের (ড. ইউনূসের উদ্যোগ) বাইরে রাখা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমরা সবাই জানি, একটি বিল্ডিং যখন বানানো হয়, এতে একটি সাইড যদি বসে যায় এবং আরেকটি সাইড দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে বিল্ডিংয়ের মধ্যে ক্র্যাক হয় (ফাটল), তখন বিল্ডিং ভেঙে যেতে পারে। আমরা দেখছি, এই ক্র্যাক সৃষ্টি করা হয়েছে।”

অন্তর্বর্তী সরকার কোনও দলকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে, আবার কোনও দলকে ওপরে রাখছে অভিযোগ করে কাদের বলেন, “৫০ শতাংশের বেশি অংশকে উনারে যে ডায়ালগের বাইরে রাখে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। এতে করে আমি মনে করি জাতিগতভাবে ভুল বোঝাবুঝি ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে।

“কাজেই আমরা যেটা বুঝতে পাচ্ছি, আমরা চাই বা না চাই, দেশে একটা ঘৃণা, সংঘাতময়- অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। দেশের মধ্যে একটি অংশ অবাঞ্ছিত বা ঘৃণিত হচ্ছে, আরেকটি অংশ তারা পবিত্র ভালোরূপে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার থেকে এটাই চেষ্টা করছে।”

৫০ শতাংশ মানুষকে বাদ দিয়ে সুন্দর রাষ্ট্র বিনির্মাণ সম্ভব নয় উল্লেখ করে কাদের বলেন, “অনেকের কাছ থেকে শুনি যে, সত্য-মিথ্যা জানি না, তাদের মধ্যে আলাপ রয়েছে- দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোলাই ভাল। তার মানে দুষ্টু গরুকে উনারা রাখবেন না। ৫০ শতাংশ লোককে যদি দুষ্টু হিসেবে আপানারা বাদ দিয়ে সুন্দর একটি দেশ তৈরি করবেন, এটা কি বাস্তব সম্মত কথা?”

‘কিংস পার্টি হচ্ছে’

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দল গঠনের চেষ্টা করছে দাবি করে জি এম কাদের বলেন, তা হলে নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকবে না।

“অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেই একটি দল গঠন করছে বলে আমরা বুঝতে পারছি। সরকারে থেকে দল গঠনের তারা চেষ্টা করছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আসছিল, কোনও কিংস পার্টি থাকবে না। এটা হলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে না।

“ডিসি-এসপিসহ পুলিশের লোকেরা কার কথা শুনছে? এখানে আমাদের লোকেরা ভোট দিতে পারবে, কি পারবে না! আমাদের কর্মীরা দাঁড়াতে পারবে কি, পারবে না! তাদেরকে মামলা-মোকাদ্দমা দিয়ে এখনই জেলখানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”

ঢাকার বনানীতে নিজের কার্যালয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
ঢাকার বনানীতে নিজের কার্যালয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

নেতা-কর্মীদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ

জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর নানা নির্যাতন-নিপীড়ন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। সাংবিধানিক অধিকার হিসাবে তাদের শান্তিপূর্ণভাবে সভা, সমাবেশ ও মিছিল করতে দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

জি এম কাদের বলেন, “আমাদের পার্টি অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তখনও ঘোষণা আসেনি, আমরা অবাঞ্ছিত। গণমাধ্যমে সেলফ সেন্সরশিপ চলছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সত্যিকার অর্থে আছে কি না?

“নির্বিচারের যেখানে-সেখানে আমাদের লোকদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে। আদালতকে বাধ্য করা হচ্ছে। এসব মামলা দেখিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। জামিন দেওয়া হচ্ছে না। সব মামলাগুলো ভূয়া।”

এক নম্বর অগ্রাধিকারে ‘গুরুত্ব নেই’

রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে একটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে মন্তব্য করে কাদের বলেন, “রাষ্ট্র সংস্কার ছাড়া বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়া সম্ভব না। এটাই আপনাদের এক নম্বর অগ্রাধিকার থাকবে। এটা করার জন্য জাতীয় ঐক্য লাগবে। তবে সরকার এক নম্বর বাদ দিয়ে ভিন্ন জায়গায় অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

“এদেরকে (জুলাই-আগস্ট) কে হত্যা করেছে, এর প্রতিশোধ নিতে হবে। বিচার তো করতেই হয়। অপরাধীর বিচার হতে হবে। এ প্রতিশোধ নিতে গিয়ে একটি হত্যাকাণ্ডে হাজার-হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষকে জড়িত করা হচ্ছে।”

অগ্রাধিকার দিয়ে হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে গিয়ে এর প্রভাব প্রশাসনের মধ্যে পড়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই বলেও মনে করেন জি এম কাদের।

“আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, জুডিসিয়ারিতে ধাক্কা দিয়েছেন। বিভিন্নভাবে তাদেরকে মামলা-মোকাদ্দমার মধ্যে ফেলেছেন। তাদেরকে বের করে দিয়েছেন, ডিমোশন দিয়েছেন। তারা রাষ্ট্রের সার্ভেন্ট। শেখ হাসিনাকে সাপোর্ট করেছে তার চাকরি বাঁচানোর জন্য করেছে। শেখ হাসিনার অপকর্মে ইচ্ছা করে জড়িত নাও হতে পারে। ঢালাওভাবে লোকদের বাদ দিয়েছেন। তারা আপনাদের কথা শুনছে না। শক্তি হারিয়ে ফেলছেন। প্রশাসন কন্ট্রোলে নেই।”

অন্তর্বর্তী সরকার শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে গেছেন এবং সরকার তার ইচ্ছা শক্তি ধ্যান-ধারণা বাস্তবায়ন করতে পারছে না বলেও দাবি করেন তিনি।

এই আলোচনা সভায় জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারও ছিলেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত