Beta
শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

বাংলাদেশ প্রেমী এক ব্রাজিলিয়ান

জোসু পিরেস কোস্তা জোজো। ছবি : সংগৃহীত
জোসু পিরেস কোস্তা জোজো। ছবি : সংগৃহীত
[publishpress_authors_box]

মুখে মিষ্টি হাসিটা লেগেই থাকত। প্রথম দেখায় মনে হতো পাশের বাড়ির বড় ভাই। অথচ জোসু পিরেস কোস্তা জোজোর বাড়ি ব্রাজিলের সাও পাওলোয়। চাকরির সুবাদে ব্রাজিল ছেড়ে সস্ত্রীক এসেছিলেন বাংলাদেশে। নয় বছরের বেশি বগুড়ায় শহরে কাটিয়ে দেওয়া জোজোর অবশ্য কখনো মনে হয়নি ব্রাজিলের বাইরে আছেন তিনি? বাঙালির আতিথেয়তায় যেমন মুগ্ধ তেমনি তাঁকে ছুঁয়ে গেছে এ দেশের মানুষের ফুটবলপ্রেম।

দু-দুটি বিশ্বকাপ দেখেছেন বগুড়ায় বসে। দুবারই পথেঘাটে আর বাড়ির ছাদে ব্রাজিলের বিশাল পতাকা দেখে অবাকও হয়েছেন। এত দূরের একটা দেশে ব্রাজিলের জন্য ভালোবাসা দেখে হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের এই স্পোর্টস প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর চাইতেন বগুড়ার ক্রীড়াঙ্গনে সাহায্য করতে। তাই প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের বুঝিয়ে বিভিন্ন স্কুলে করেছেন ক্রীড়াসামগ্রী বিতরণ।

স্ত্রীকে নিয়ে ভলিবলের প্রশিক্ষণও দিয়েছেন ছাত্রছাত্রীদের। কয়েকটি স্কুলের শিক্ষক অসহযোগিতা করলেও দমে যাননি  জোজো। স্থানীয়দের সঙ্গে মিশতে শিখে ফেলেন বাংলা ভাষাটা। একজন ভিনদেশীর মুখে বাংলা শুনে মনেই হতো না তিনি ব্রাজিলিয়ান! ২০১৭ সালে ব্রাজিলে ফিরে গেলেও বাংলাদেশের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন নিয়মিত।

আজ (২১ ফেব্রুয়ারি) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সাও পাওলো থেকে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় বললেন, ‘‘পৃথিবীর একমাত্র জাতি হিসেবে তোমরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছো। মায়ের মুখের ভাষার স্বীকৃতি আদায় করেছো। এজন্যই আমি বাংলাদেশে এসে বাংলা ভাষাটা শিখেছিলাম। তোমাদের সংস্কৃতি জেনে মুগ্ধ হয়েছি। আরও খুশি হতাম যদি তোমরা ২১ ফেব্রুয়ারির বদলে ৮ ফাল্গুগনকে ভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারতে। তাহলে বাংলা ১২ মাসের নাম পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ত। বাংলাদেশের অসাধারণ সংস্কৃতিও জানতে পারত সারা বিশ্বের মানুষ।’’

স্ত্রী রেবেকার সঙ্গে জোজো।

বগুড়ায় ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন জোজো। এরপর দেশে ফিরে গেলেও সবসময় খোঁজ নেন বাংলাদেশের। মাঝখানে বগুড়া ঘুরে গেছেন দুইবার। বগুড়ার যে স্কুলগুলোতে ভলিবল প্রশিক্ষণ দিতেন, খোঁজ নিয়েছেন সেগুলোর।

বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষিকা রাবেয়া বেগমের সঙ্গে জোজো ও তার স্ত্রী রেবেকার আত্মার সম্পর্কই তৈরি হয়েছিল। রাবেয়া বেগম স্মৃতিকাতর হয়ে জানালেন, ‘‘জোজো আর তাঁর স্ত্রী খুবই আন্তরিকভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে আমাদের স্কুলের মেয়েদের। কোনো বিদেশির এভাবে এগিয়ে আসাটা সত্যিই প্রশংসনীয়। ওর মুখের বাংলা ছিল অসাধারণ। ভলিবল খেলার সুবাদে আমাদের স্কুলের অনেকে বিভিন্ন সার্ভিসেস দলে যোগ দিয়েছে। এটা সম্ভবই হত না, জোজো যদি এগিয়ে না আসতেন। ব্রাজিলে ফিরে গেলেও আমাদের স্কুলের ভলিবল নিয়ে নিয়মিত খোঁজ নেন তিনি। ওর কারণেই খেলাটা এখনও নিয়মিত চালু আছে স্কুলে।’’

স্ত্রীকে নিয়ে জোজো সবশেষ ভলিবলের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন মুরোইল আদর্শ স্কুলে। স্কুলটির ক্রীড়া শিক্ষক মোখলেসুর রহমান ভক্ত বনে গেছেন এই ব্রাজিলিয়ানের, ‘‘জোজোকে ভোলা কঠিন। ও চাকরি করত হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে। অথচ দিনভর প্রশিক্ষণ দিত ভলিবল। এখনও হোয়াটসঅ্যাপে খোঁজ নেয় আমাদের। নানা পরামর্শ দেয়। ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর-এই দিনগুলোতে নিয়ম করেই ফোন দেয় ও।’’

ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মানে বগুড়ায় থাকতে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি রিকশা রেসের আয়োজন করতেন জোজো। তিন মাথা থেকে রিকশা রেস শুরু হয়ে শেষ হত আমতলীতে। ৩৫ রিকশাওয়ালাকে নিয়ে করতেন বয়সভিত্তিক সাতটি বিভাগ। এই সাত বিভাগের সাত চ্যাম্পিয়নকে দেওয়া হতো একটি করে রিকশা। সেই রিকশার পেছনে ব্রাজিল ও বাংলাদেশের পতাকা আঁকা থাকত পাশাপাশি। বাকি ২৮ জনকে দেওয়া হত বিশেষ সম্মাননা।

বগুড়ায় গত দুই দশক কোনো রিকশার লাইসেন্স দেওয়া না হলেও এই সাতটি রিকশাকে লাইসেন্স দেওয়া নিশ্চিত করতেন স্থানীয় মেয়ররা। ২১ ফেব্রুয়ারি তার এই রিকশা রেস সাড়া ফেলত ভীষণ। এ নিয়ে অবশ্য প্রচারণা চাইতেন না জোজো, ‘‘বাংলাদেশে গিয়েছিলাম কাজ করতে, প্রচার পেতে নয়। ২১ ফেব্রুয়ারি রিকশা রেসটা সাড়া ফেলত বগুড়া জুড়ে। স্কুলে ভলিবল শিখিয়েও মজা পেতাম। তবে সব স্কুলে সমান সহযোগিতা পাইনি। অন্য স্কুলগুলোকে বুঝিয়েছি ব্রাজিল অলিম্পিকে যেমন ৩টি সোনা জিতেছে তেমনি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ৩বার। বাংলাদেশিদের সঙ্গে ব্রাজিলিয়ানদের অনেক মিল পেয়েছিলাম আমি। চেষ্টা করলে তোমরাও ভলিবলে ভালো কিছু করতে পারবে। এসব বুঝিয়েই ভলিবলের প্রশিক্ষণ দিতাম।’’।

 এ নিয়ে বিসিবির চাকুরে, বগুড়া ক্রীড়া সংস্থার সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও বগুড়ার ক্রীড়াঙ্গনে প্রায় ৩৫ বছর জড়িয়ে থাকা জামিলুর রহমান জামিল বললেন, ‘‘বাংলাদেশের প্রতি এক ব্রাজিলিয়ানের এমন ভালোবাসা সত্যিই বিরল। অন্য একটা প্রজেক্টের হয়ে কাজ করতে এসে বগুড়ায় তিনি প্রসার ঘটিয়েছিলেন ভলিবলের, বিশেষ করে স্কুলগুলোতে। তার আয়োজন করা রিকশা রেস সাড়া ফেলত বগুড়া জুড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারিতে তার কথা আলাদা করেই মনে হয়। ও চেষ্টা করত সবসময় বাংলা বলার। ভাষাটাকে হৃদয় দিয়েই ভালোবাসত ও।’’

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত