দেশে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়নসহ ১১ দফা দাবি জানিয়েছে অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ফোরাম।
স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মাসদার হোসেন মামলার আলোকে বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় এবং সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনসহ এই ১১ দফা দাবি দ্রুত বাস্তবায়নের আহবানও জানিয়েছেন সাবেক বিচারকরা।
মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে ‘বিচার বিভাগ পুনর্গঠন ও সংস্কার প্রস্তাব’ শিরোনামে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন সংগঠনের নেতারা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার বাদী অবসরপ্রাপ্ত বিচারক মাসদার হোসেন।
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত বহুল আলোচিত মামলাটি মাসদার হোসেনই করেছিলেন ১৯৯৪ সালে। তখন তিনি জেলা জজ ও জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের মহাসচিব ছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, “দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চলা অসহনীয় নিপীড়নের অবসান ও ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসকের বিদায় হয়েছে।”
এসময় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তিনি স্বাগত ও অভিনন্দন জানান।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত অবসরপ্রাপ্ত বিচারকেরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় প্রদানকারী সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে জনতার আদালতে বিচারের দাবিও জানান।
বিচারক ড. সাজ্জাদ হোসেন বাবু বলেন, “সে সময়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবের নির্দেশনার আলোকে আদেশ না দেওয়ায় আমাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। বিচারকেরা কি আদেশ দেবেন তার সবকিছুই আইন মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার জন্য এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।”
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ‘স্বৈরাচার সরকারের’ গোড়াপত্তন করেছিলেন দাবি করে তিনি এজন্য তাকে জনতার আদালতে এনে বিচার করা উচিত বলে মন্তব্য করেন।
আরেক বিচারক আব্দুর রহমান বলেন, “সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী আদেশ না দেওয়ায় আমাকে তাৎক্ষণিক কয়েক জায়গায় বদলি করা হয়। জামিনযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও বিএনপির এক নেতাকে জামিন দেওয়ায় আমাকে চট্টগ্রাম থেকে বদলি করে বরিশালে দেওয়া হয়। বিবেকের তাড়নায় আমি তখন চাকরি ছেড়ে দেই।”
কোনও বিচারককেই স্বাধীনভাবে বিচার কাজ করতে দেওয়া হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ফোরামের ১১ দফা দাবিতে রয়েছে : বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত ও দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় আইনের সংশোধন করতে হবে, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচারকদের স্বাধীন করতে হবে, বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতিসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন ও অন্যান্য কার্যাদি সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের অধীনে আলাদা সচিবালয় গঠন করতে হবে, মাসদার হোসেন মামলায় দেওয়া বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে, ভবিষ্যতে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা বিলুপ্তি এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সংবিধানের আমূল সংস্করণ করতে হবে। সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রনয়ন করতে হবে।
এছাড়া যেসব বিচারক আচরণবিধি লঙ্ঘন করে স্বৈরাচারী সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য প্রকাশ্যে সরকারকে সমর্থন করে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী কাজ করেছে, জামিন যোগ্য মামলায় জামিন না দিয়ে শত সহস্র নিষ্পাপ মানুষকে কারাগারে পাঠিয়েছে, রিমান্ড আদেশ দিয়ে হয়রানি ও নির্যাতনের সুযোগ করে দিয়েছে এবং ফরমায়েশী রায় দিয়ে শাস্তি দিয়েছে তাদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
বিচারিক আদালতের সকল স্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ন্যায় বিচার পরিপন্থী স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে কাজ করা বিচারকদের বদলী করে সৎ ও নিরপেক্ষ বিচারকদের পদায়ন করতে হবে, সুপ্রিমকোর্টের বর্তমান রেজিস্ট্রার জেনারেলসহ সব বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং আইন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত স্বৈরাচারী সরকারের সহযোগী বিশেষ করে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম সারওয়ার, যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহা ও শেখ গোলাম মাহবুব, মাহাবুবুর রহমান সরকার (বর্তমানে জেলা জজ, নরসিংদী), এ.এইচ.এম. হাবিবুর রহমান জিন্নাহ (সদস্য, যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইব্যুনাল), শহিদুল আলম ঝিনুকসহ (তথ্য কমিশনার ও সাবেক আই.জি.আর) সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সব কর্মকর্তাকে দ্রুত অপসারণ করে সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে।
চুক্তিভিক্তিক বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ বাতিল করে সেখানে যোগ্য ও নিরপেক্ষ অবসর প্রাপ্ত বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে, উচ্চ আদালতে কর্মরত বিচারপতিদের যারা শপথ ভঙ্গ করে, আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে বিদায়ী স্বৈরশাসককে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন, যাদের কারণে বিচার বিভাগ আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তাদেরকে অপসারণ করে বিচারের আওতায় আনতে হবে, আপিল বিভাগে কর্মরত যে সব বিচারপতি আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে শপথ ভঙ্গ করে রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি স্বৈরশাসককে তাদের অপকর্মে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদেরকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে।