বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার পদক্ষেপকে বেসরকারি উদ্যোগ বলার পর সরকারের পক্ষ থেকেই ‘অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
সোমবার রাতে সরকারের এই আকস্মিক ঘোষণা আসার পর জরুরি বৈঠক ডেকে কয়েক ঘণ্টা আলোচনার পর মধ্যরাতে আগের অবস্থান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা বলেছে, ঘোষণাপত্র সরকারই দেবে, তবে তারা শহীদ মিনারে সমাবেশ করবে।
গত শনিবার থেকে ফেইসবুকে ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট, জরুরি সংবাদ সম্মেলন আর জরুরি বৈঠকের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে মঙ্গলবার প্রথম প্রহরে নাটকীয়তার অবসান হলেও এর মধ্যদিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের দূরত্বের বিষয়টি সম্পষ্ট হয়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা শনিবার ফেইসবুকে ৩১ ডিসেম্বর কিছু করার ইঙ্গিত দিয়ে একের পর এক পোস্ট দিলে তা নিয়ে দেখা দেয় ব্যাপক কৌতূহল।
পরদিন জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে জানানো হয়, ৩১ জানুয়ারি অর্থাৎ মঙ্গলবার ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে তারা ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ উপস্থাপন করবে।
তাতে দেশে ‘মুজিববাদী সংবিধানের কবর’ রচিত হবে এবং আওয়ামী লীগ দল হিসেবে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেন আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ।
পাঁচ মাস পর ঘোষণাপত্র দেওয়ার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “এই ঘোষণাপত্র ৫ই আগস্টেই হওয়া উচিৎ ছিল, না হওয়ার ফলে ফ্যাসিবাদের পক্ষের শক্তিগুলো ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। যে গণ অভ্যুত্থানটি হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে মানুষ মুজিববাদী সংবিধানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তার একটি লিগ্যাল ডকুমেন্টেশন থাকা উচিৎ।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই কর্মসূচির সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক কমিটিও যোগ দেয়।
এরপর সেদিনই সাংবাদিকদের প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল বলেন, “আমরা এটিকে প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ (বেসরকারি উদ্যোগ) হিসেবেই দেখছি। সরকারের সঙ্গে এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।”
এই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকারের কিছু জানা নেই বলে জানান সহকারী প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার।
তারপরও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শহীদ মিনারের কর্মসূচি নিয়ে এগোতে থাকে। সোমবার আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে সাংবাদিকদের বলেন, “মঙ্গলবারের ঘোষণাপত্রে এমন একটা সীমারেখা আগামী দিনের সরকারকে দিয়ে যাওয়া হবে, তার বাইরে যেন কোনও সরকার যেতে সাহস না করে।”
এর ঘণ্টা খানেক পরেই সংবাদ সম্মেলন ডেকে প্রেস সচিব শফিকুল বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
“জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হবে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই ঘোষণাপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানোর পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এনিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলার ওপর জোর দিয়েছিলেন।
সেই প্রেক্ষাপটে সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে প্রেস সচিব বলেন, “গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত করা হবে। এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিত, ঐক্যের ভিত্তি ও জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত হবে।
“আমরা আশা করছি, সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই সর্বসম্মতিক্রমে এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে এবং জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।”
সরকার এই সিদ্ধান্ত জানানোর পর রাতেই ঢাকার বাংলামটরে নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে জরুরি বৈঠকে বসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এর মধ্যরাতে সংবাদ সম্মেলনে এসে তাদের মুখ্য সমন্বয়ক হান্নান মাসউদ বলেন, সরকারই ঘোষণাপত্র দেবে।
“সরকার আমাদের প্রক্লেমেশনের ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে, আমাদের বিজয় হয়েছে। আমরা অবশ্যই শহীদ মিনারে একত্রিত হব। যে কর্মসূচি আমরা দিয়েছি, আমরা একত্রিত হব। সরকার প্রক্লেমেশনের পক্ষে যে অবস্থান নিয়েছে, আমরা শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে তাতে সমর্থন জানাব। প্রক্লেমেশন কীভাবে হবে কালকে আমরা সেখানে বলে দেব।”
অর্থাৎ মঙ্গলবার শহীদ মিনারে সমাবেশ হলেও সেখানে পূর্ব ঘোষণা অনুসারে ‘বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ উপস্থাপন হবে না।