কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণার আয়োজনে দেড় থেকে আড়াই লাখ মানুষের সমাগম হবে বলে আশা করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যে প্লাটফর্মের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারত চলে যান শেখ হাসিনা।
সোমবার বিকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ- ডিএমপি হেডকোয়ার্টারে কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে এ প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ।
এ সময় তিনি বলেন, আগামীকাল (মঙ্গলবার) বড় আনন্দ বয়ে আনবে। তাদেরকে নতুন স্বপ্ন দেখাবে।
কী থাকবে মঙ্গলবারের ঘোষণাপত্রে এমন প্রশ্নের মাসউদ বলেন, “তেসরা অগাস্টের এক্সটেন্ডেড ভার্সন আগামীকাল হতে যাচ্ছে। ফ্যাসিস্টের পতনের পর নতুন প্রক্লেমেশন দিয়ে সেটাকে আমরা জাতির কাছে ডকুমেন্টেড করে তুলতে চাচ্ছি।”
তিনি বলেন, “মঙ্গলবারের ঘোষণাপত্রে এমন একটা সীমারেখা আগামী দিনের সরকারকে দিয়ে যাওয়া হবে, তার বাইরে যেন কোনো সরকার যেতে সাহস না করে।”
“বস্তাপচা রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে পহেলা জানুয়ারি থেকে নতুন রাজনীতির উদ্ভব হবে দেশে। সেই রাজনীতি কিসের ওপর ভিত্তি করে হবে সেটা আগামীকাল ডকুমেন্ট আকারে প্রকাশ করতে যাচ্ছি,” যোগ করেন মাসউদ।
তিনি বলেন, “বাহাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশের সকল সরকারই সীমারেখা অতিক্রম করেছে। মানুষের অধিকার হরণের সীমারেখা যাতে কেউ অতিক্রম করতে না পারে সেটা ভবিষ্যতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক তাদের জন্য চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের শক্তির পক্ষ থেকে সীমারেখা আমরা টানতে চাচ্ছি।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই ঘোষণাপত্র অনুষ্ঠান উপলক্ষে মঙ্গলবার সকাল থেকে শহীদ মিনারে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। বিকাল ৩টায় শুরু হবে মূল অনুষ্ঠান।
‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণার বিষয়ে রবিবার বাংলামোটরে নিজেদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
সেখানে তারা বলেন, আগামী ৩১ ডিসেম্বর দেশে মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে এবং আওয়ামী লীগ দল হিসেবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে বাংলাদেশে। ওইদিন ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করা হবে।
এর আগে শনিবার সন্ধ্যার পরই ফেইসবুকে ‘থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্বর, নাউ অর নেভার, প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন’- এমন সব স্ট্যাটাস ছড়িয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির শীর্ষ নেতাদের অনেকেই এমন পোস্ট দেন।
পোস্ট দেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদও।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ৩১ ডিসেম্বর জুলাই বিপ্লবের যে ঘোষণাপত্র ঘোষণা করার কথা রয়েছে তার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনও সম্পৃক্ততা নেই বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। রবিবার তিনি আরও জানিয়েছেন, সরকার বিষয়টিকে ‘প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবেই দেখতে চায়।
গত জুলাইয়ের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন মাসের মাঝামাঝি সময়ে চূড়ান্ত রূপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট পতন হয় টানা দেড় দশক ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকারের।
গত ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দুই সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ স্থান পান। পরে যুক্ত হন মাহফুজ আলম, যাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন সরকারপ্রধান ড. ইউনূস।
আওয়ামী লীগ সরকারের এই পতনকে ‘ফ্যাসিবাদী’ ব্যবস্থার পতন হিসাবে দেখেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা। এই ছাত্ররাই সরকারের নিয়োগকর্তা বলে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন ড. ইউনূস।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হওয়া সামষ্টিক অভিপ্রায় ও আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে রাষ্ট্রের সংস্কার, পুনর্গঠন ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে ৮ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’। এর আহ্বায়ক করা হয় নাসির উদ্দিন পাটোয়ারীকে এবং সদস্য সচিব করা হয় আখতার হোসেনকে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান এ পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধন হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।
রবিবার জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, “এই ঘোষণাপত্র পাঁচই অগাস্টেই হওয়া উচিত ছিল। না হওয়ার ফলে ফ্যাসিবাদের পক্ষের শক্তিগুলো ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। দুই হাজারের ঊর্ধ্বে শহীদ এবং ২০ হাজারের ঊর্ধ্বে আহতদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে তারা এই আন্দোলনের লেজিটেমেসিকে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।
“জুলাই অভ্যুত্থান, যে গণঅভ্যুত্থানটি হয়েছে…তার মধ্য দিয়ে মানুষ মুজিববাদী সংবিধানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এই যে মানুষ মুজিববাদী সংবিধানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তার একটি লিগ্যাল ডকুমেন্টেশন থাকা উচিত।”
তিনি বলেন, “সে জায়গা থেকে ৩১শে ডিসেম্বর ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে… ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান ঘিরে আমাদের যে গণ-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, ‘৭২ এর সংবিধানের বিপরীতে গিয়ে মানুষ যে রাস্তায় নেমে এসেছে এ অভ্যুত্থানে- সেটির প্রাতিষ্ঠানিক, দালিলিক স্বীকৃতি ঘোষণা করার জন্য আমরা ৩১ ডিসেম্বর ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে শহীদ মিনার থেকে আমাদের প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন ঘোষণা করবো।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যেই এই ঘোষণাপত্রের খসড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়েছে। তারা নিজ নিজ মন্তব্য ও বক্তব্য দিচ্ছেন, যা ৩১ ডিসেম্বর জুলাই প্রোক্লেমেশনে দেখা যাবে।
নেতারা আরও জানিয়েছেন, এই কর্মসূচি হবে দলীয় ব্যানারহীন। তবে এতে উপস্থিত থাকবেন জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনে নিহত এবং আহতদের পরিবারের সদস্য, ছাত্র, শ্রমিক, রাজনৈতিক দল, শিক্ষাবিদসহ সমাজের নানা অংশের মানুষ।
যানবাহন পার্কিংয়ে পুলিশের নির্দেশনা
ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মঙ্গলবার ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ তুলে ধরার আয়োজনকে ঘিরে সারাদেশ থেকে আসা যানবাহন পার্কিংয়ের বিষয়ে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
সোমবার ডিএমপি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, গাবতলী হয়ে ঢাকা মহানগরে আসা যানবাহনগুলো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও আগারগাঁও এলাকার পুরাতন বাণিজ্য মেলা মাঠে পার্কিং করবে।
সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী প্রবেশ পথ দিয়ে আসা যানগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় পার্কিং করবে। এছাড়া আব্দুল্লাহপুর হয়ে প্রবেশ করা যানবাহনগুলো ৩০০ ফিট এলাকায় পার্কিং করবে।