ঢাকার শিশু মেলা এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন জুলাই আন্দোলনে আহতরা। তাদের বেশিরভাগই জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের দেখতে গিয়েছিলেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার সারাহ কুক। তারা এক ঘণ্টারও বেশি সময় হাসপাতাল পরিদর্শন করেন; বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাঁধে বিপত্তি।
তারা হাসপাতালে ভর্তি সবার সঙ্গে দেখা না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন আহতদের কয়েকজন। এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের গাড়ি আটকে দেন তারা।
এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও ব্রিটিশ হাই কমিশনার অন্য একটি গাড়িতে করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান। এরপর অর্ধশতাধিক আহত হাসপাতালের সামনে আগারগাঁও-শ্যামলী সড়কে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। বিকাল ৪টার দিকেও সড়কে অবস্থান নিয়ে ছিলেন তারা। এসময় সেখানে সেনাবাহিনী ও পুলিশের অনেক সদস্যকে দেখা যায়।
সবশেষ রাত ৯টায়ও জুলাই আন্দোলনে আহতদের সড়কেই দেখা গেছে। তবে এ পর্যন্ত তাদের দাবি মেনে আসেননি স্বাস্থ্য উপদেষ্টা আসেননি।
যদিও সন্ধ্যার দিকে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ স্নিগ্ধ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে যান। তিনি তাদের সহায়তার আশ্বাসও দেন। কিন্তু এরপরও সড়ক ছেড়ে যাননি আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনকারী মো. হাসান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা স্বাস্থ্য উপদেষ্টার জন্য রাত ১০টা পর্যন্ত সময় দিয়েছি। এর মধ্যে তিনি না এলে পরবর্তী কর্মসূচি দেব।”
আহতদের আন্দোলনের কারণে শ্যামলী থেকে আগারগাঁওমুখী সড়ক দিয়ে দুপুর থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় আশপাশের সড়কে তীব্র যানজটে সৃষ্টি হয়েছে।
‘আমাদের ঠিক মতো চিকিৎসা ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না’
সড়কে নেমে আসা আহতদের একজন কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী মো. রাসেল। তিনি জানান, গত ৩০ জুলাই কলেজের সামনে আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা রড ও হকিস্টিক দিয়ে ডান হাত ও ডান পা ভেঙে ফেলে তার। এরপর থেকে হাসপাতালে হাসপাতালেই জীবন কাটছে তার।
বর্তমানে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের বি ওয়ার্ডের ১৭ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন রাসেল। এই ওয়ার্ডে তার মতো ৪৬ জন আন্দোলনকারী চিকিৎসা নিচ্ছেন।
রাস্তায় নেমে আসার কারণ জানতে চাইলে কলেজছাত্র রাসেল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আজ উপদেষ্টা হাসপাতালে এসেছিলেন আহতদের দেখতে। কিন্তু তিনি হাসপাতালে আসার পর হাতেগোনা কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করেন। বাকি সময় ছিলেন হাসপাতাল পরিচালকের সঙ্গে। আন্দোলন করে আমরাই তো তাদের ক্ষমতায় বসিয়েছি, এখন আমাদের কথা ভুলে গেছে তারা।”
তিনি বলেন, “আমরা অনেকদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কিন্তু আমাদের ঠিক মতো চিকিৎসা ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না। ভেবেছিলাম উপদেষ্টা এসে আমাদের সাবার সঙ্গে দেখা করবেন। আমাদের কথা শুনে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তার সেই সময় হয়নি, এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।”
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতদের স্মৃতি ধরে রাখতে, তাদের পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করতে এবং আহতদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে গত ১২ সেপ্টেম্বর গঠন করা হয় ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনকে ইতোমধ্যে ১০০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে সরকার। ব্যক্তিপর্যায়ে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি প্রবাসীদের কাছ থেকেও সহযোগিতা নেওয়া হবে ফাউন্ডেশনে।
আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছে প্রত্যেকের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে পাঁচ লাখ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। আহতরা পাবেন সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবে।
তবে ক্ষতিপূরণ হিসাবে এক লাখ টাকা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন আহত কলেজছাত্র রাসেল।
এখন পর্যন্ত ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে ১ লাখ টাকা পেয়েছেন জানিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এই ক্ষতিপূরণ কী পর্যাপ্ত? সেটাও সবাই পায়নি। আহতদের ভালো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তবে সব কিছুর আগে তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।”
‘চিকিৎসার জন্য গরু বিক্রি’
তবে এখনও কোনও ক্ষতিপূরণই পাননি বলে জানালেন আরেক আহত আল হোসাইন, যিনি পড়ালেখা শেষ করে বেকার জীবন কাটাচ্ছেন।
আল হোসাইন জানান, গত ১৬ জুলাই বিকালে ঢাকার সায়েন্সল্যাব এলাকায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের পিটুনিতে ডান পায়ের হাড় ফেটে যায়। তিন মাস চিকিৎসার পরও ঠিক মতো হাঁটতে পারেন না তিনি। তবে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।
ছাড়া পাওয়ার পরও এই আন্দোলনে কেন- সকাল সন্ধ্যার এমন প্রশ্নে তিনি জানান, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার আসার কথা শুনে হাসপাতালে এসেছিলেন নিজের সমস্যা জানাতে। তার চিকিৎসার জন্য বাড়ির গরু বিক্রিও করতে হয়েছে।
আল হোসাইন বলেন, “শেরেবাংলা কৃষি ইনিস্টিউট থেকে ডিপ্লোমা শেষে এখনও বেকার আমি। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও ভালো না। আন্দোলনে আহত হওয়ার পর এখনও কোনও সহায়তা পাইনি। বাড়ির গরু বেঁচে নিজের চিকিৎসা করিয়েছি।”
এই আন্দোলনকারীর অভিযোগ, অনেক চেষ্টার পর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের হেল্পলাইনে যোগাযোগ করেও সাহায্য পাননি।
আল হোসাইন বলেন, “জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে সাহায্যের জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু কোনও খবর নেই। তাদের হেল্পলাইন নম্বর ১৬০০০ তে ফোন দিলেও সহজে ধরে না। অনেক চেষ্টার পর ফোন ধরলে বলে- দেখতেছি। কিন্তু সেই দেখা আর শেষ হয় না।”
তিনি বলেন, “যাদের ডাকে আমরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আহত হয়েছি, তাদের কানে এখন আমাদের ডাক পৌঁছায় না। গত ১০ নভেম্বর জিরো পয়েন্টে গিয়ে সমন্বয়ক সারজিস আলমের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও পারিনি।
“ভেবেছিলাম আজ স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে নিজের সমস্যার কথা বলব। এজন্য হাসপাতালে আসলাম। কিন্তু লাভ হলো না। তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেলেন।”
‘স্ট্রেচার নিতে ৩-৫শ’ টাকা ঘুষ’
সড়কের মাঝে ক্র্যাচ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরেক আহত মো. স্বপন (২০)। তিনি জানান, গত ১৯ জুলাই ধানমন্ডি ৭ নম্বর এলাকায় আন্দোলন চলাকালে বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
মাদ্রাসাশিক্ষার্থী স্বপন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখনও পা ঠিক হয়নি। চিকিৎসার জন্য বারবার হাসপাতালে আসতে হয়। কিন্তু হাসপাতালে আসলে চিকিৎসকরা শুধু ঘুরান। একবার ৩ তলা পাঠান, আরেকবার বলেন ৪ তলায় যেতে। এই ভাঙা পা নিয়ে বারবার ওঠানামা করা আমার জন্য খুব কষ্টের। আর হাসপাতালে আসার পর স্ট্রেচারটাও পাই না আমরা। স্ট্রেচার নিতে গেলে ৩-৫শ’ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এর নাম কী চিকিৎসা সহায়তা?”
তিনি বলেন, “এসব সমস্যা বলতে চেয়েছিলাম স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে। কিন্তু তিনি দেখা করেননি। তাই বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছি। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা এসে দেখা করার আগ পর্যন্ত সড়ক ছাড়ব না আমরা।”
কাঠফাটা রোদের মধ্যে পায়ে স্টিলের ফ্রেম লাগানো অবস্থায় হুইল চেয়ারে বসেছিলেন মো. হাসান। ঢাকা আইডিয়াল স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তিনি।
গত ৫ আগস্ট দুপুরে যাত্রাবাড়ী এলাকায় ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন হাসান। প্রথমে চিকিৎসা নেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে তাকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসা শেষে বর্তমানে পঙ্গু হাসপাতালের এ ওয়ার্ডের ৪র্থ তলায় ৪২ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন তিনি।
সড়কে নামা আহতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পঙ্গু হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ২ শতাধিক আন্দোলনকারী চিকিৎসাধীন এখনও। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ২ শতাধিক আন্দোলনকারী।
পায়ের ক্ষতস্থান দেখিয়ে হাসান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “৩ মাস চিকিৎসা করানোর পরও এখনও ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত ঝরছে। তাহলে কীভাবে সুচিকিৎসা হচ্ছে আমাদের? আন্দোলনের সময় আমরা গুরুত্বপূর্ণ ছিলাম। এখন আমাদের গুরুত্ব শেষ হয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামতে হয়েছে আমাদের। আমাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক, যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক।”