বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে বিচার কাজ থেকে বিরত রাখা হাই কোর্টের বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিন পদত্যাগ করেছেন। তাকে নিয়ে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলে অনুসন্ধান চলা অবস্থায় রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে বিচারপতি শাহেদ নুরউদ্দিনের পদত্যাগের খবর দেওয়া হয়।
তাতে বলা হয়, “সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক অনুসন্ধান পরিচালনানাধীন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতি জনাব শাহেদ নূরউদ্দিন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতির মাধ্যমে মহানাম্য রাষ্ট্রপতির নিকট নিজ স্বাক্ষরযুক্ত পদত্যাগপত্র প্রেরণ করেছেন।”
সংবিধানের ৯৬ (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রে পদত্যাগ করেছেন বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিন। তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ হলে সরকার থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলাসহ আরও বেশ কয়েকটি আলোচিত মামলার রায় দিয়েছিলেন শাহেদ নুরউদ্দিন। তখন তিনি ঢাকার জজ ছিলেন।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক হিসাবে ওই মামলার রায়ে শাহেদ নূরউদ্দিন বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ ওই হামলা ছিল একটি দলকে ‘নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা’।
আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার এই মামলায় তিনি বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়েছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে দিয়েছিলেন যাবজ্জীবন সাজা।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ১ ডিসেম্বর আপিলের রায়ে সব আসামিকে খালাস দেয় হাই কোর্ট। এই রায়ে বলা হয়, বিচারিক আদালত আইনের ভিত্তিতে বিচারটি করেনি।
ডিসেম্বরে এই রায়ের সময় হাই কোর্ট বিভাগেই ছিলেন শাহেদ নুরউদ্দিন। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০১৯ সালে হাই কোর্টের অতিরিক্ত বিচারক হিসাবে নিযুক্ত হন তিনি।
তবে অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘স্বৈরাচারের দোসর’ হিসাবে চিহ্নিত করে যে কয়েকজন বিচারককে অপসারণের দাবি তোলে, তার মধ্যে শাহেদ নুরউদ্দিনের নামও ছিল।
বিক্ষোভকারীরা গত ১৬ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করলে তাদের দাবির মুখে প্রধান বিচারপতি হাই কোর্ট বিভাগের ১২ বিচারককে বিচার কাজ থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেন। ওই ১২ জনের একজন শাহেদ নূরউদ্দিন।
এরপর গত ৭ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে জানানো হয়, উচ্চ আদালতের কয়েকজন বিচারকের বিষয়ে তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে নির্দেশনা দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
গত ২০ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হয়। এ রায়ের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের পরিবর্তে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফেরে।
রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৬(৫)(বি) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন বিচারপতির বিষয়ে তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের নিকট নির্দেশনা পাঠান। সে অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তদন্ত শুরু করে।
সেই তদন্তের মধ্যেই বিচারপতি শাহেদ নুরউদ্দিন পদত্যাগ করলেন।
এর আগে গত ১৯ নভেম্বর হাই কোর্ট বিভাগের তিন বিচারব পদত্যাগ করেন। তারা হলেন- সালমা মাসুদ চৌধুরী, কাজী রেজা-উল হক ও এ কে এম জহিরুল হক।
এই তিন বিচারকের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ উঠলে ২০১৯ সাল থেকে তাদের বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শাহেদ নূরউদ্দিন ১৯৮৩ সালের ২০ এপ্রিল মুন্সেফ হিসাবে বিচার বিভাগে যোগ দেন। তারপর ধাপে ধাপে হাই কোর্ট বিভাগে নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি।
২০২৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ৬৭ বছর পূর্ণ হলে নিয়ম অনুযায়ী তার অবসরে যাওয়া কথা ছিল। তবে দুই বছর আগেই তিনি অবসর নিলেন।
বিচারক জীবনে ঢাকার সনি হত্যা মামলা, সাবেক এমপি আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলা, সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান হত্যা মামলা, অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান মণ্ডল হত্যা মামলা, সাবেক ডেপুটি স্পিকার হুমায়ন খান পন্নীর স্ত্রী সুলতানা পন্নী হত্যা মামলা, পুলিশ টেলিকম হত্যা মামলা, ফরিদপুরের সাংবাদিক গৌতম হত্যা মামলা, ওয়ার্ড কমিশনার সায়েদুর রহমান নিউটন হত্যা মামলা, কলেজ শিক্ষক কৃষ্ণ কাবেরী হত্যা মামলার রায় শাহেদ নূরউদ্দিনই দিয়েছিলেন।