বাংলাদেশ ফুটবল দলের সঙ্গে ৩ বছর পার করে হাভিয়ের কাবরেরা আবার পরীক্ষার মুখে। ডিসেম্বরে তার চুক্তি শেষ হচ্ছে। নতুন চুক্তি হবে নাকি হবে না- এ নিয়ে ধোঁয়াশা আছে ফুটবল ফেডারেশনেই। তবে পরিসংখ্যান তার পক্ষে শক্ত অবস্থান না নিলেও বাংলাদেশ ফুটবলের চরিত্র বদলের নায়ক হিসেবে থাকবেন এই স্প্যানিশ ফুটবল কোচ। তার অধীনেই বাংলাদেশ দলের মাঠের খেলা ও ফুটবলারদের মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন যোগ হয়েছে। তাই হয়তো ফুটবলারদের মধ্যেও তুমুল জনপ্রিয় কাবরেরা।
ফুটবলাররা কী বলছেন
সাবেক বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন এই কোচকে নিয়ে প্রশ্ন তুললেও বিস্ময়কর তথ্য হলো, দলের ভেতর ৯০ ভাগ ফুটবলারই তার ভক্ত। ফোনে কথা বলেই এই ধারণা পাওয়া গেছে। জাতীয় দলের অধিনায়ক তপু বর্মনের ব্যাখ্যা, “আমার চোখে কাবরেরা হলেন প্রতিপক্ষকে নিয়ে দুর্দান্ত বিশ্লেষণ করতে পারা একজন কোচ। খুব নিখুঁতভাবে কাটাছেঁড়া করেন এবং ওই দলের বিশেষ খেলোয়াড়দের তিনি চিহ্নিত করতে পারেন। প্রতিপক্ষের সঙ্গে ম্যাচের কোন সময় কীভাবে খেলতে হবে, তা আমাদের বুঝিয়ে দেন ব্ল্যাকবোর্ডে এঁকে। ট্রেনিং মাঠেও সেটা করে দেখান।”
এই ডিফেন্ডার মনে করেন, “কাবরেরা বড় পরিবর্তনটা এনেছেন আমাদের মানসিকতায়। আমাদের সাহস বাড়িয়েছেন। ভুল করলেও তিনি বলেন ‘আবার চেষ্টা করো।’ তার অধীনে বাংলাদেশ দল এখন অগের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী।” ম্যাচের ফল হার-জিত যাই হোক, এই দল এখন আত্মবিশ্বাসী হয়ে ইতিবাচক ফুটবল খেলতে শিখেছে। তাদের খেলা দেখলে এটা বোঝা যায়।
দলের তরুণ সদস্য মজিবুর রহমান জনি মনে করেন, “প্রত্যেক কোচের আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে। কাবরেরার দর্শন হলো, ‘মাঠে গিয়ে লড়াই করো।’ তিনি কখনও নির্দিষ্ট কিছু খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করে থাকেন না। যে যখন ভাল খেলে তাকেই ম্যাচে সুযোগ দেন।” এই মিডফিল্ডার তার কোচকে দশে দশ দিতে চান, “প্রতিটা ফুটবলারের পারফরম্যান্স সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা আছে। কাকে কোথায় ব্যবহার করতে হবে, সেটা তার চেয়ে ভাল কেউ জানে না। এই স্প্যানিশ কোচকে দশে দশ দেবো আমি।”
সাফল্য-ব্যর্থতার পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা
সাধারণত হার-জিতের পরিসংখ্যান দিয়েই কোচের পারফরম্যান্স যাচাই করা হয়। বাংলাদেশ অধ্যায়ে কাবরেরার পরিসংখ্যান উৎসাহব্যাঞ্জক নয়। গত তিন বছরে ৩২ ম্যাচে ৮ জয়ের পাশাপাশি আছে ১৭টি হার, বাকি ৭ ম্যাচ ড্র। এর মধ্যে ২০২৪ সালের হিসাবটা একটু বেশিই খারাপ। ৮ ম্যাচ খেলে পেয়েছে মাত্র ২টি জয়। বাকি ৬ ম্যাচই হারে বাংলাদেশ। তবে এর ৪টি ম্যাচ খেলতে হয়েছে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের কঠিন প্রতিপক্ষ ফিলিস্তিন, অস্ট্রেলিয়া ও লেবাননের সঙ্গে, যারা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
পরিসংখ্যানে সবসময় দলের রঙ বদলের ছবিটা পাওয়া যায় না। এটা দেখা যায় মাঠের খেলায়, যেখানে লড়াইয়ের গল্প থাকে, উন্নতির ছাপ থাকে। এমনকি আগামীর সম্ভাবনার ইঙ্গিতও থাকে। তপু-রাকিবদের পায়ে সেরকম ইতিবাচক ফুটবলের সাক্ষ্য দেবে ২০২৩ সালে বেঙ্গালুরু সাফ ফুটবল। টুর্নামেন্ট শুরুর আগেও এই দল নিয়ে কেউ স্বপ্ন দেখেনি। বেঙ্গালুরু গিয়ে সেই দলই এমন দুর্দান্ত ফুটবল খেলতে শুরু করেছিল যা দেখে সবাই চমকে গিয়েছিল।
তারা চমৎকার পাসিং ফুটবল খেলছে, আক্রমণে উঠছে, গোলের সুযোগ তৈরি করছে- এটা ছিল এক অবিশ্বাস্য রূপান্তর। মালদ্বীপ ও ভুটান, দুই দলের বিপক্ষেই ৩-১ গোলের ব্যবধানে জিতে বাংলাদেশ সেমিফাইনালে পৌঁছে কুয়েতের সঙ্গে রীতিমতো সমানে-সমান লড়াই করেছে। ১-০ গোলে হারলেও বাংলাদেশ শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়াই করেছিল। এটাই হলো কোচের দেওয়া বিশ্বাস ও সাহস। বেঙ্গালুরু সাফে ফাইনালে পৌঁছাতে না পারলেও তার আগের দুই দশকে বাংলাদেশের এমন দাপুটে ফুটবল খেলার স্মৃতি মনে করা কঠিন।
শুধু দাপটে খেললে ফুটবল ম্যাচ জেতা যায় না, এর সঙ্গে দরকার এমন দু-একজন তারকা যারা পার্থক্য গড়ে দেবেন। ফরোয়ার্ড লাইনে রাকিব-মোরসালিন-ফাহিমদের মতো ভাল ফুটবলার থাকলেও গোল করার বিশেষ মানুষটি নেই। বাংলাদেশের ফুটবলে এটা দীর্ঘকালীন সংকট। তাই বেশিরভাগ সময় ভাল খেলা ও দাপটের ছবিটা স্কোরলাইনে ফুটে ওঠে না। সুতরাং কোচের হাতে ম্যাচ জয়ের কী রসদ ছিল, এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
কাবরেরা থাকতে চান
জাতীয় দলের কোচ হাভিয়ের কাবরেরা এশিয়ান কাপে বাংলাদেশ দলের গ্রুপিং দেখে বেশ চ্যালেঞ্জ অনুভব করছেন। গ্রুপে তিনি লড়াইয়ের সুযোগ দেখেন। পয়েন্টের স্বপ্ন দেখেন। এই স্প্যানিশ কোচ বলেছেন, “বাংলাদেশ দলের কোচ থাকতে পেরে আমি খুশি। দলটি উন্নতি করছে। তিন বছর আমরা কী করেছি, সেটা দেখানোর দারুণ সুযোগ আছে পরের বছরে।” এই কোচের কথায় পরিষ্কার, তিনি বাংলাদেশে থাকতে চান এবং ২০২৫ সালে তার দল ভাল ফল দিতে পারে।
কিন্তু তখন কি কাবরেরা এই দলের সঙ্গে থাকতে পারবেন? তার চুক্তি শেষ হচ্ছে এই ডিসেম্বরে, নবায়ন নিয়ে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, “প্রেসিডেন্টের (বাফুফে সভাপতি) সঙ্গে নতুন চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা চলছে। আরও কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা বাকি। (চলমান চুক্তিতে) এখনও ২০ দিন সময় আছে।”
কাবরেরা বনাম বাটলার ও বাফুফের ভাবনা
জাতীয় দলের কোচ নিয়ে বাফুফের ভাবনা এখনও স্পষ্ট নয়। সাবেক বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন শেষ দিকে কাবরেরাকে ছাঁটাইয়ের হুমকি দিয়েছিলেন কয়েকবার। বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্সে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। এই সংক্রমনটা ছড়িয়েছে নতুন সভাপতি তাবিথ আউয়ালের মধ্যেও। তার পরিকল্পনায় আছে দুই কোচ। হাভিয়ের কাবরেরার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে পিটার বাটলারকে। অনেকে বলেন, সালাউদ্দিন আগেই কাবরেরাকে তাড়িয়ে পিটার বাটলারের হাতে জাতীয় দলের দায়িত্ব তুলে দিতে চেয়েছিলেন। এর পেছনে কমিশন বাণিজ্য থাকারও গুঞ্জন শোনা যায়।
সম্প্রতি পিটার বাটলারের অবস্থানটা শক্তিশালী হয়ে গেছে মেয়েদের সাফ জয়ের কৃতিত্বে। তবে ইংলিশ কোচের কৃতিত্ব কতটুকু, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সিনিয়রদের বাদ দিয়ে এই কোচ নিজের পছন্দের একাদশ গড়ে হারতে বসেছিলেন পাকিস্তানের কাছে। ড্রয়ে কোনোরকমে রক্ষা পান। পরে মেয়েদের দলে সিনিয়ররা বিদ্রোহ করেন এবং তাদের চাপে সিনিয়রদের রেখেই দল গড়তে বাধ্য হন বাটলার। সেই দলই চ্যালেঞ্জ নিয়ে টানা দুই ম্যাচে ভারত ও নেপালকে হারিয়ে শিরোপা জেতে। মজার ব্যাপার হলো, মেয়েরাই এখন বাটলারকে কোচ হিসেবে চান না। তাই তাকে পুরুষ দলে ‘পাস’ খেলে দেওয়ারও সম্ভাবনা আছে।
এখন নতুন বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল কী করবেন? পুরুষ জাতীয় দল ব্যবস্থাপনা কমিটিও রেখেছেন নিজের হাতে। কয়েকবার ফোন করলেও সভাপতিকে পাওয়া যায়নি। বাফুফে সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তুষার বলেছেন, “কাবরেরা ও বাটলারের চুক্তি শেষ হচ্ছে এই ডিসেম্বরে। তাদের সঙ্গে নতুন চুক্তির ব্যাপারে এখনও কোনও নির্দেশনা পাইনি আমি। আমার ধারণা, নির্বাহী কমিটির সভায় বিষয়টা চূড়ান্ত হবে।”
তবে বাফুফের আরেকটা সূত্র বলছে, কাবরেরার সঙ্গে নতুন চুক্তি নিয়ে সভাপতি দ্বিধায় থাকলেও পিটার বাটলার থাকছেন।