ঠিকঠাক নকশা করতে না পারায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুর কাজ ১০ বছরেও শুরু করা যায়নি। সময় গড়ানোর সঙ্গে বাড়ছে প্রকল্পের ব্যয়। প্রথমে যেখানে এই রেল ও সড়ক সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১৬৩ কোটি। সেই ব্যয় এখন প্রায় ১০ গুণ বাড়িয়ে ১১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকায় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
দীর্ঘদিন এই সেতুর দাবি জানিয়েছেন এলাকার (চট্টগ্রাম-৮ আসন) সংসদ সদস্য মইন উদ্দীন খান বাদল। ২০১৯ সালের নভেম্বরে মারা গেছেন তিনি। এ সেতুর এ দাবিতে সংসদ থেকে পদত্যাগের হুমকিও দিয়েছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একাংশের সভাপতি বাদল।
প্রকল্পটির জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) থেকে ৭২ কোটি ৪০ লাখ ডলারের সহজ শর্তের ঋণ দিচ্ছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা। ১৫ বছরের রেয়াত কালসহ মাত্র ০.৫ শতাংশ হারে ৪০ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) চূড়ান্ত চুক্তি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, সম্প্রতি ‘কালুর ঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর রেল-কাম-রোড সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পটির মূল্যায়ন করা হয়েছে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায়। প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য একনেক সভায় উপস্থাপনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে রেল সংযোগে ব্রিটিশ আমলে ১৯৩১ সালে প্রায় ৭০০ মিটার দৈর্ঘ্যের স্টিলের কাঠামোয় এই সেতু নির্মাণ করা হয়। ১৯৬২ সালে সেতুটির ডেক পরিবর্তন করে রেল-কাম সড়ক সেতুতে রূপান্তর করে গাড়ি চলাচলের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর থেকে এই সেতু দিয়ে রেলের পাশাপাশি দক্ষিণ চট্টগ্রামের গাড়ি চলাচল বাড়তে থাকে। তখন কর্ণফুলী নদীর ওপর একমাত্র সেতু হওয়ায় ভারি যানবাহনের চাপ এই সেতুকেই বহন করতে হতো। ফলে ওই সময়েই সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চলছিল জোড়াতালি দিয়ে।
এই সেতুর ওপর থেকে চাপ কমাতে ১৯৮৮ সালে নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় কর্ণফুলী নদীর ওপর প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ শাহ আমানত সড়ক সেতু তৈরি করে গাড়ি চলাচলের সুযোগ করে দেওয়া হয়।
তবে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে সেতুটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে আবারও ঘণ্টায় মাত্র ১০ কিলোমিটার গতিতে কালুরঘাট রেল সেতুর ওপর একমুখী যানবাহন চলাচল শুরু করা হয়।
পরবর্তীতে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত শাহ আমানত সেতু মেরামত করে সীমিত পরিসরে যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করা হলেও কালুরঘাট রেল সেতু দিয়েও যাত্রী ও মালবাহী বাস-ট্রাক চলাচল অব্যাহত রাখতে হয়েছে।
২০১২ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর দ্বিতীয় শাহ আমানত সড়ক সেতু নির্মাণের পর কালুরঘাট রেল সেতুর ওপর থেকে ভারী যানবাহন চলাচল কমে আসে। যদিও রেল ও ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে সেতুটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে।
যেভাবে এল কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণ প্রকল্প
২০১০ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সেবার জন্য ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং মিয়ানমার সীমান্ত ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি জরাজীর্ণ কালুরঘাট রেল সেতুর পরিবর্তে একটি রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণে উদ্যোগ নেয় রেল মন্ত্রণালয়।
রেল বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০১২ সালে তাইওয়ানের রেলসেতু অবকাঠামো নির্মাণ প্রকৌশল ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওয়াইকন কোম্পানি লিমিটেড, দেশীয় প্রতিষ্ঠান স্মেক, এইস কনসালট্যান্ট লিমিটেড এবং ইঞ্জিনিয়ার কনসোর্টিয়াম যৌথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করে।
সমীক্ষায় রেলের জন্য সিঙ্গেল লাইন ও সড়কের জন্য দুই লেনের একটি রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের পরামর্শ আসে। সমীক্ষায় কর্ণফুলী নদীর পানি স্তর থেকে সেতুর ব্যবধান (নেভিগেশন) মাত্র ৭ দশমিক ৬২ মিটার ধরে ২০১৪ সালে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা।
২০১৪ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইডিসিএফ থেকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার প্রস্তাব পাঠায় ইআরডি।
১ হাজার ১৬৩ কোটি থেকে যেভাবে সাড়ে ১১ হাজার কোটি
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট রেল মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এই প্রকল্পে দুই লেনের সড়ক এবং এক লেনের রেলসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ওই সমীক্ষা অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলন করে ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট প্রকল্পটির চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হয়।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের নকশা দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। রেল ও সড়ক পথে চলাচলের আলাদা নকশা এবং সড়কের জন্য দুই লেনের পাশাপাশি ডাবল রেললাইন স্থাপনের নির্দেশ দিয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন না দিয়ে ফেরত দেন তিনি।
এরপর ইডিসিএফ নতুন নকশার জন্য ২০২১ সালের অক্টোবরে দায়িত্ব দেয় দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান ‘দহওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কো-অপারেশন জেভিকে।
দ্বিতীয় ওই নকশায় কালুরঘাট রেল-কাম সড়ক সেতুটি পদ্মাসেতুর আদলে দ্বিতল সেতু তৈরির নকশা করা হয়। ওই নকশা অনুযায়ী সেতুর নিচতলায় ডাবল লাইনে রেল এবং উপরের তলায় দুই লেনে গাড়ি চলার কথা ছিল। ওই নকশায় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট রেল মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ২০২২ সালে প্রকল্পের দ্বিতীয় নকশাটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলে প্রধানমন্ত্রী ফেরত পাঠান। তিনি একতলা সেতুতেই ডাবল রেললাইন ও যানবাহন চলাচলের জন্য দুই লেন বিশিষ্ট সড়ক সেতুর নকশা করার নির্দেশ দেন। তারপর নতুন এই নকশা করা হয়েছে।
নতুন নকশা অনুযায়ী সেতুর দুই পাশে দুই লেন করে চার লেনের সেতু তৈরি করা হবে। এক পাশে চলবে ট্রেন, অন্যপাশে বাস-ট্রাকসহ সাধারণ যানবাহন।
এ বিষয়ে রেল বিভাগের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম সলিমুল্লাহ বাহার সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, এখন প্রকল্পের ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, “নতুন নকশায় এই সেতুর নেভিগেশন (পানি থেকে সেতুর উচ্চতা) বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৫ মিটার। প্রথম প্রস্তাবে নেভিগেশন ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৬২ মিটার। নতুন নকশায় নেভিগেশন ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ২ মিটার।”
এই পরিকল্পনাবিদ বলেন, “২০১৮ সালে বিআইডব্লিউটিএ নদীর ওপর সেতু তৈরির ক্ষেত্রে ন্যূনতম নেভিগেশন বাধ্যতামূলক করে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী এবং কর্ণফুলী নদীতে ভবিষ্যতে কত বড় জাহাজ চলাচল করতে পারে সেই সম্ভাব্যতা নতুন নকশায় আমলে নেওয়া হয়েছে।”
প্রকল্পটির ব্যয় এতো বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “নতুন নকশায় ভায়াডাক্টসহ এই সেতুর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৬ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ ভায়াডাক্টের জন্য জমি অধিগ্রহণেই ব্যয় হবে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।”
তিনি বলেন, প্রকল্পটির প্রথম নকশায় ২০১৫ সালের রেট শিডিউল ধরা হয়েছিল। ফলে ওই সময়ে প্রকল্পটির ব্যয় কম ধরা হয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী ব্যয় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বেড়ে যায়।
ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়াও প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ বলেও জানান রেল বিভাগের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম সলিমুল্লাহ বাহার।
২০১৫ সালে ৮০ টাকায় পাওয়া যেত এক মার্কিন ডলার, এখন লাগে ১১৮ টাকা।