ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শেষ দিন ৫ আগস্ট ঢাকার মিরপুরে মহিউদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে করা মামলার শুনানির এক পর্যায়ে কাঁদলেন এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার।
সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জি. এম. ফারহান ইসতিয়াকের আদালত শুনানি নিয়ে মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেছে।
মামলায় বলা হয়, গত ৫ আগস্ট মিরপুর মডেল থানার সামনে আন্দোলন করছিল ছাত্র-জনতা। সেখান দিয়ে যাওয়ার পথে আসামিদের গুলিতে আহত হন মহিউদ্দিন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ আগস্ট মারা যান তিনি।
এ ঘটনায় তার মামাতো ভাই গত ১২ সেপ্টেম্বর মিরপুর মডেল থানায় হত্যা মামলাটি করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ওই আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত ৫ আগস্টই ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। মিরপুর-কাফরুল এলাকায় দলটির কয়েকবারের এই সংসদ সদস্যকে গত ১৮ অক্টোবর গুলশানের একটি বাসা থেকে আটক করে পুলিশ।
পরদিন তাকে মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ইকরামুল হক সাজিদকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় রিমান্ডে নেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে ইকরামুল হক সাজিদ ও মহিউদ্দিন হত্যাসহ আন্দোলনকেন্দ্রিক আরও মামলা রয়েছে।
মহিউদ্দিন হত্যা মামলার শুনানিতে কামাল আহমেদ মজুমদার আদালতের কাছে অনুমতি নিয়ে কিছু বলতে চান। আদালত তাকে সেই অনুমতি দেয়।
এসময় তিনি দাবি করেন, মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি-নির্যাতন করা হচ্ছে। সব সময় আন্দোলনকারীদের পক্ষে বলেছেন। শেখ হাসিনাকে বারবার দাবি মেনে নিতে বলায় গণভবনে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল।
কামাল মজুমদার বলেন, “এভাবে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি, নির্যাতন করা হচ্ছে। এই সরকারকে উদ্দেশ করে বলতে চাই, দেশে আইনের শাসন থাকলে এমনটা হতো না। মামলা করছে, বাদীর খবর নেই। একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে নির্যাতন করছে।
“পরিবারের সদস্যদেরও নির্যাতন করছে। তারা বাড়িতে থাকতে পারছে না। জায়গা-জমি দখল করে নিচ্ছে। মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।”
এসময় হাত উচিয়ে আদালতকে হাতকড়া দেখিয়ে তিনি বলেন, “এটাই কি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার অলংকার। এজন্যই কি দেশ স্বাধীন করেছিলাম।”
এসময় কান্না করে দেন প্রায় ৭৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিক।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন বলেও এসময় দাবি করেন দলটির মনোনয়নে কয়েকবার নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য।
কামাল মজুমদার আদালতকে বলেন, “আমি কোনও অন্যায়, দুর্নীতি করিনি। অথচ আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। এর বিচার চাই। আদালতের প্রতি আমাদের সম্মান, শ্রদ্ধা রয়েছে। যারা মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করছি।”
শুনানিতে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, “তিনি একজন ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা না। রাজস্ব ফাঁকি দিতে রাজনীতিতে নাম লেখান। এলাকায় অবৈধভাবে বিশাল ব্যবসা তৈরি করে নিয়েছেন। আন্দোলনের সময় মিরপুরে জঘন্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মনে হচ্ছে, তিনি কোনও নতুন গ্রহ থেকে এসেছেন।”
এরপর কামাল আহমেদ মজুমদারের বক্তব্যের জবাব দেন তিনি।
বাদীর খবর নেই- এ বিষয়ে তিনি বলেন, “এখন বাদী আসবে কেন? বিচারের সময় বাদী আসবেন।”
মিথ্যা মামলার অভিযোগের বিষয়ে ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, “এমন নিষ্ঠুর, নির্মমভাবে বাচ্চাদের খুন করা হয়েছে। আর উনি বলছেন মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। ইসরায়েল গাজায় মুসলিমদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি করেছে। এরাও তাই করেছে। পেট্রল দিয়ে লাশ পুড়িয়ে দিয়েছে। আর উনি বলছেন মিথ্যা মামলা।”
পরিবারের সদস্যদের হয়রানির অভিযোগ নিয়ে তিনি বলেন, “অবৈধ অর্থ তো শুধু আপনার নামে রাখেননি। আর ভোগ করছে পরিবারের সদস্যরা। চিন্তা করেন, এমন কাজ করলে পরিণাম তো পরিবারকে ভোগ করতেই হবে। সম্পত্তি লুট করেছেন। সরকারের সম্পদ তো রাখেননি। দখল করে নিয়েছেন।”
কামাল মজুমদার হাত উচিয়ে আদালতকে হাতকড়া দেখিয়ে ‘এটাই কি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার অলংকার’ বলে যে বক্তব্য দেন সে প্রসঙ্গে ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, “যারা মুক্তিযোদ্ধা, আপনাদের কারণে তাদের সম্মানহানি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মাটির নিচে মিশিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
“আওয়ামী লীগ কি মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র এজেন্সি? কেন মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করলেন? আর আজ বলছেন মুক্তিযোদ্ধা। আমি বলছি, আপনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলবেন না। গুম, খুন, আয়নাঘর এগুলো কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল? মুক্তিযুদ্ধকে কলংকিত করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। জনগণকে খুশি অথবা কাজ না করলে এমন পরিণাম ভোগ করতে হয়।”
এসময় কামাল মজুমদার বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলছেন, আমি ব্যবসায়ী। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি শুরু করেছি। আর গর্বের সাথে বলতে চাই, সরকারের সাথে ব্যবসা নিয়ে কোনও সম্পর্ক নাই। কোনও কারচুপির আশ্রয় নেইনি। ট্যাক্স দিয়েছি নিয়মিত।”
তিনি আরও বলেন, “মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি গর্বিত। আইনজীবী যা বলছেন, সত্য না। এলাকায় স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট করেছি। উন্নয়ন করেছি। কোনও লোকের কাছ থেকে এক কাপ চা-ও খাইনি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি। বাজার সিন্ডিকেট থেকে শুরু করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি।”
ক্ষমতাচ্যুত সরকারের এই প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, “আমি সব সময় আন্দোলনকারীদের পক্ষে বলেছি। শেখ হাসিনাকে বলেছি, দাবি মেনে নেন। বারবার বলেছি। যার কারণে আমার গণভবনে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। আর চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে চাই, সরকারি জমি দখল করিনি বা কোনও জমি বরাদ্দ নেইনি।”
শুনানি শেষে আদালত তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন।