পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার এক নদীর নাম মাইনী। ১০৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬২ মিটার চওড়া এই নদী খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা থেকে প্রবাহিত হয়ে রাঙামাটির লংগদু উপজেলার কাচালং নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
গত শতকের ষাটের দশকের আগে মাইনী নদীর ওপর দিয়েই রাঙামাটির হাটগুলোতে যেতেন ব্যবসায়ীরা।
একসময়ের স্রোতোস্বিনী এই নদী এখন ধুঁকছে। শুকিয়ে এটি এখন মৃতপ্রায়।
মাইনী নদীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে কয়েক মাস আগে এটির নৌপথ খননের উদ্যোগ নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড খাগড়াছড়ি।
রাঙামাটির লংগদু উপজেলার মাইনীমুখে বন বিভাগের বিশ্রামাগার এলাকার অংশে চার মাস আগে শুরু হয় খনন কাজ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদীরক্ষার এই পদক্ষেপ মাইনী নদী ও এর তীরসংলগ্ন জনবসতির জন্য নিঃসন্দেহে আনন্দের।
কিন্তু লংগদুর মাইনীমুখে বন বিভাগের বিশ্রামাগার এলাকার অংশে খনন কাজ শুরুর পরপরই এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মীরা উদ্বেগ জানাতে থাকেন। কারণ নদী খননের বালি ফেলা হচ্ছে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে।
অভিযোগ উঠেছে, বাংলাদেশের বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাইয়ের বিস্তীর্ণ অংশ মাইনী নদীর বালি দিয়ে ভরাটে জড়িত স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদেরই এক চেয়ারম্যান। বাজার সম্প্রসারণের নামে এই পরিবেশবিধ্বংসী কাজ করছেন তিনি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বন বিভাগের বিশ্রামাগারের পাশে মৃতপ্রায় মাইনী নদীতে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে নদী খননের কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। আর নদী খননের বালি লোহার পাইপ দিয়ে মাইনীমুখ বাজারের পাশে কাপ্তাই হ্রদে ফেলা হচ্ছে।
এতে কাপ্তাই হ্রদের অংশবিশেষ পরিণত হচ্ছে বালুচরে। এই কাজের জন্য আগেই কাপ্তাই হ্রদে মাটি দিয়ে বাঁধ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কাপ্তাই হ্রদে বাঁধ দেওয়া জায়গাটির আয়তন আনুমানিক দুই থেকে তিন একর। বাঁধের বাইরে কাপ্তাই হ্রদের অংশটি এরই মধ্যে চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কমেছে মাছ চাষের পরিসর।
এছাড়া হ্রদ ভরাটের ফলে বাজার এলাকার নৌঘাটগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মাইনীমুখ বাজার সম্প্রসারণের জন্য নদী খননের বালি দিয়ে কাপ্তাই হ্রদ ভরাট করা হচ্ছে বলা হলেও মূলত মাইনীমুখ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কামাল হোসেন কমলের নেতৃত্বে স্থানীয় ভূমিদস্যু চক্র হ্রদ ভরাট করে প্লট বিক্রি করবে।
এজন্য এরই মধ্যে স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে শুরু করে সাংবাদিকদের ‘ম্যানেজ’ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির ১০টি উপজেলা নিয়ে বিস্তীর্ণ কাপ্তাই হ্রদে পানির রুলকার্ড অনুযায়ী ১২০ মিনস সি লেভেল (এমএসএল) পর্যন্ত কোনও ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ সম্পূর্ণ নিষেধ। এছাড়া ২০২২ সালে হাইকোর্টের এক আদেশে কাপ্তাই হ্রদের দখল ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশও দেওয়া হয়।
মাইনী নদীর বালি দিয়ে কাপ্তাই হ্রদ ভরাটের ঘটনাকে ‘পরিবেশবিধ্বংসী কাজ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) রাঙ্গামাটি জেলার সভাপতি মো. ওমর ফারুক।
তিনি বলেন, “নৌপথ খননের বালি দিয়ে হ্রদ ভরাট করা হলে সেক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের অপরাধ। আমি প্রশাসনকে অনুরোধ জানাব, এ ধরনের অপতৎপরতা ঠেকাতে যেন দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয়।”
অভিযোগ রয়েছে, মাইনীমুখ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন হ্রদ ভরাট কাজের নেতৃত্ব দিলেও তার পেছনে পরোক্ষভাবে আছেন লংগদু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল দাশ বাবু।
অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে বাবুল দাশ বলেন, “আমার কথা কেন আসছে, জানি না। বাজার জেলা পরিষদের। এখানে আমার বা ইউপি চেয়ারম্যান কামাল হোসেনের ব্যক্তিগত কোনও স্বার্থ নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদী খননের বালিগুলো তো কোথাও না কোথাও ফেলতে হবে, তাই হ্রদে ফেলা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “লংগদুর মাইনীমুখ বাজার গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় হাটের দিন ফরেস্ট রেস্ট হাউজের জায়গাতেও বাজার বসে। জনগণের স্বার্থেই বাজারটির সম্প্রসারণ দরকার।
“আর কাপ্তাই হ্রদের যে অংশ এখন ভরাট হচ্ছে, সেখানে ইউনিয়ন পরিষদ ও মাইনীমুখ মডেল হাই স্কুলের এক একর জায়গা আছে। জায়গা ভরাট হলে স্কুলের বাচ্চারা খেলাধুলা করতে পারবে। এসব কারণে বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
স্থানীয়দের অভিযোগ, মাইনীমুখ বাজারের পাশে বাজার সম্প্রসারণের নামে হ্রদ ভরাট করা শুরু হলে ঘটনাস্থলে যায় উপজেলা প্রশাসন। তবে এ ঘটনায় শাস্তিমূলক কোনও ব্যবস্থা নেয়নি তারা। কাউকে সতর্কও করা হয়নি।
বরং দেখা গেছে, কাপ্তাই হ্রদের নির্দিষ্ট অংশে লাল পতাকা টাঙিয়ে দিয়েছে প্রশাসন, যাতে স্থানীয়রা লাল পতাকার অংশের ভেতরের জায়গা দখল বা ব্যবহার করতে না পারে।
তবে তাদের অভিযোগের বিষয়ে লংগদু উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, “পানি উন্নয়ন বোর্ড লাল পতাকা দিয়ে লে-আউট দিয়েছে, যাতে করে স্থানীয়রা কাপ্তাই হ্রদের খাস জায়গা ব্যবহার ও চাষাবাদ না করে।
“লে-আউটের বাইরের জায়গা কেন ভরাট করা হচ্ছে, সেটি পানি উন্নয়ন বোর্ড ভালো জানবে। তবে আমি যতদূর জানি, সেখানে মাইনীমুখ ইউনিয়ন পরিষদ ও বিদ্যালয়ের মাঠের জায়গা রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের স্থায়ী ভবন নির্মাণ ও বিদ্যালয়ের মাঠ সম্প্রসারণের কাজে কাপ্তাই হ্রদ ভরাট করা হতে পারে।”
খোদ ইউপি চেয়ারম্যান কামাল হোসেন মাটি ভরাটের কাজে সম্পৃক্ত থাকায় কেউ প্রতিবাদ জানানোর সাহস পাচ্ছে না বলে জানিয়েছে স্থানীয় কয়েকজন।
তাদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে কামাল হোসেন বলেন, “মাইনীমুখ বাজার ওই এলাকার বড় বাজার। তবে হাটবারে বাজার বসার মতো পর্যাপ্ত জায়গা থাকে না। তাই বাজারটি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
“মাইনী নদীর খনন শুরু হলে আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলি, নদী খননের বালি যদি এখানে ভরাটের জন্য ফেলা হয়, তাহলে আমাদের সুবিধা হবে। তাই জায়গা ভরাটের জন্য এখানে বালি ফেলা হচ্ছে। এর সঙ্গে অনেকেই জড়িত।
“হ্রদ ভরাটের অনুমতির বিষয়টি আমার জানা নেই। সেটা পানি উন্নয়ন বোর্ড বলতে পারবে। এখানে একটা গ্রুপ ভাগ বণ্টন করতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। এ কারণে তারা ‘কাপ্তাই হ্রদের ক্ষতি হচ্ছে, মাছের প্রজননক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে’- এসব অভিযোগ তুলছে।”
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে এলে হ্রদ ভরাটের তোড়জোড় শুরু হয়। হ্রদটির বিভিন্ন অংশ একের পর এক দখল হয়ে যাচ্ছে। কাপ্তাই হ্রদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কারণে দখলদার ও ভূমিদস্যুরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
বাজার সম্প্রসারণের বিষয়ে মাইনীমুখ বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, “কলাবাজার, গরু বাজার ও কাঠ বাজারের কারণে বাজারের জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
“মৌখিকভাবে চেয়ারম্যান কামাল হোসেন আমার সঙ্গে সমন্বয় করেছেন যে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বালি যদি এখানে ফেলা হয়, তাহলে বাজারটা সম্প্রসারণ করা যাবে। মাটি ভরাটের পর জায়গাটি জেলাপ্রশাসক নিতে পারেন বা বাজার সম্প্রসারণের জন্য দিতে পারেন।”
মাইনী নদীর বালি দিয়ে কাপ্তাই হ্রদ ভরাটের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড খাগড়াছড়ির উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুর রহমান বলেন, “আমার প্রকল্পের স্টাডিতেই উল্লেখ আছে, ড্রেজিং করা বালি যদি কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা স্কুল চায়, তাহলে আমরা সেসব দান করে দিতে পারব।
“এক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে, পরিবহনের খরচ ওই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা স্কুল কর্তৃপক্ষ দেবে। মাইনীমুখ ইউপির চেয়ারম্যানসহ স্থানীয়দের চাহিদার ভিত্তিতে তাদের বালিগুলো দেওয়া হচ্ছে।”
কাপ্তাই হ্রদ ভরাটের বিষয়ে রাঙামাটির জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, “আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোনও অভিযোগ আসেনি। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে সরেজমিন পরিদর্শন করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
হ্রদ ভরাটের বিষয়ে রাঙামাটির জেলাপ্রশাসক মোশারফ হোসেন খান কিছু জানেন না দাবি করলেও পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের (রাঙামাটির অতিরিক্ত দায়িত্ব) সহকারী পরিচালক আফজারুল ইসলাম বলেন, মাইনী নদী খননের বালি দিয়ে কাপ্তাই হ্রদ ভরাটের বিষয়টি তিনি জানেন। এ নিয়ে তদন্তও শুরু হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “হ্রদ ভরাটের ঘটনায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, বাজার সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ স্থানীয় নেতাদের নাম প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।”