মন্দিরের লাড্ডু নিয়ে রাজনীতিতে শোরগোল দেখে দৃশ্যত উষ্মা প্রকাশ করল ভারতের সর্বোচ্চ আদালত; বলল, রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনা ঠিক নয়।
ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের তিরুপতি মন্দিরের লাড্ডুতে পশুর চর্বি মেশানোর অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় দেশটির সুপ্রিম কোর্টের এই মন্তব্য আসে বলে এনডিটিভি জানিয়েছে।
সম্প্রতি ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের তিরুপতি জেলার তিরুমালায় অবস্থিত শ্রী ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের মিষ্টি লাড্ডু নিয়ে দেশজুড়ে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্বের সব থেকে সম্পদশালী হিন্দু তীর্থগুলোর অন্যতম সেই মন্দিরের দেবতাকে ধর্মীয় নৈবেদ্য দেওয়ার জন্য ঘিয়ের তৈরি শ্রীভরি লাড্ডুতে পশুর চর্বি মেশানোর অভিযোগ উঠেছে।
বিষয়টি নিয়ে এতটাই রাজনৈতিক তিক্তটা সৃষ্টি হয়েছে যে তা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে।
সেই মামলার শুনানিতে সোমবার অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইড়ুর উদ্দেশে আদালত বলে, “আপনি সাংবিধানিক পদে রয়েছেন। আশা করব, ভগবানকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখবেন।”
স্পর্শকাতর এই বিষয় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জনসমক্ষে যে মন্তব্য করেছেন, তা ভালো চোখে দেখেননি বিচারপতি বিআর গাভাই ও বিচারপতি কেভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চ।
মামলার শুনানিতে বলা হয়, গুজরাটের সরকারি ল্যাবরেটরিতে লাড্ডু পরীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়েছে তাতে মাছের তেল, পশুর চর্বি মেশানো রয়েছে। ওই রিপোর্ট নিয়ে বিশেষ তদন্তকারী দল তদন্ত করছে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ, “যদি প্রশাসন তদন্তেরই নির্দেশ দিয়ে থাকে, তাহলে তা নিয়ে জনসমক্ষে মন্তব্য করার প্রয়োজন কোথায়? গুজরাটের ল্যাবরেটরি রিপোর্ট দিয়েছে গত জুলাইয়ে। মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেন সেপ্টেম্বরে। রিপোর্টও খুব স্পষ্ট নয়। ধর্ম ও রাজনীতিকে একসঙ্গে মেশাতে দিতে পারি না।”
বিতর্কের শুরুটা হয়েছিল অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর একটি চমকপ্রদ অভিযোগ দিয়ে। তার দল তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) বর্তমান বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শরিক।
তার অভিযোগ, অন্ধ্র প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই এস জগন মোহন রেড্ডি এবং তার নেতৃত্বাধীন পূর্বতন যুবজন শ্রমিক রাইথু কংগ্রেস পার্টির (ওয়াইএসআরসিপি) সরকার থাকাকালে তিরুমালা মন্দিরে প্রসাদ হিসাবে যে লাড্ডু তৈরি ও বিতরণ করা হত, তাতে নাকি পশুর চর্বির মিশ্রণ থাকত।
নাইডুর দাবি, জগন মোহনের আমলে মন্দিরের লাড্ডু তৈরি করতে যে ঘি ব্যবহার করা হতো, তা বিশুদ্ধ ছিল না। কারণ তাতে মেশানো থাকত পশুর চর্বি। তবে তিনি ক্ষমতায় আসার পর এখন মন্দিরের ঐতিহাসিক লাড্ডু আবারও খাঁটি ঘি দিয়েই তৈরি করা হচ্ছে।
অন্ধ্র প্রদেশে নাইডু নেতৃত্বাধীন সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে গত ১৮ সেপ্টেম্বর অন্ধ্র প্রদেশের বিজয়ওয়াড়ায় এনডিএ শরিকদলগুলোর একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকেই গুরুতর এই অভিযোগ করেন চন্দ্রবাবু নাইডু।
গুজরাটের ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের পরীক্ষাগারের একটি রিপোর্টের বরাতে তিনি এই দাবি করেন। গত ১৭ই জুলাই ওই লাড্ডুর নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং ২৩শে জুলাই পরীক্ষা শেষ হয়।
তবে ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টির নেতৃত্ব এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন আখ্যা দিয়ে অস্বীকার করেছে। তাদের পালটা দাবি, রাজনৈতিক ফায়দা লুটতেই ভিত্তিহীন এই অভিযোগ করছেন চন্দ্রবাবু। এর মধ্য দিয়ে তিনি তাদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদের তাস খেলছেন।
ওয়াইএসআরসিপি ভারতের বর্তমান প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের শরিক।
পুরো বিষয়টিকেই চন্দ্রবাবু নাইডুর চাল বলে অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চিঠিও দেন জগন মোহন রেড্ডি। পরে বিষয়টি নিয়ে আদালতে জনস্বার্থ মামলাও হয়। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জগন মোহন রেড্ডি ধর্মবিশ্বাসে একজন খ্রিস্টান।
সেই মামলারই শুনানি হয় সোমবার। শুনানি শেষে আদালত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে।
বিচারপতি বিআর গাভাই এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, “স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম তৈরি করে তদন্ত করছেন। এখনও তদন্ত শেষ হয়নি। তার আগে সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করার কী প্রয়োজন ছিল? মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগকে সম্মান জানানো উচিৎ।”
বিচারপতি বিশ্বনাথন বলেন, “আপনি যদি ঘিয়ের গুণগত মান নিয়ে নিশ্চিত নাই হবেন, তা হলে তদন্ত চলাকালে সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খোলার কী দরকার ছিল? তদন্তেরই বা কী প্রয়োজন?”
আদালত আরও বলে, পরীক্ষাগারের রিপোর্টে ভেজাল থাকার উল্লেখই প্রমাণ নয় যে, ব্যবহৃত ঘি বিশুদ্ধ ছিল না। লাড্ডু তৈরিতে যে এই ঘিই ব্যবহৃত হয়েছে তারই বা প্রমাণ কী? এ ছাড়া রিপোর্টে এই ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে যে আরও পরীক্ষার প্রয়োজন আছে।
আদালতের আরও প্রশ্ন, লাড্ডুর ঘি-ই কি পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছিল? ঘিয়ের কোন নমুনা ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল তা একেবারেই স্পষ্ট নয়।
ওয়াইএসআরসিপির অভিযোগ, নাইডু ক্ষমতা পাওয়ার পর ১০০ দিন পেরিয়ে গেলেও তেমন কিছু অর্জন করতে পারেননি এবং এখন তার ব্যর্থতাগুলো থেকে মনোযোগ সরাতেই ইস্যুটিকে ব্যবহার করছেন।
ভারতজুড়ে রাজনৈতিক নেতারাও বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এক্স-এ পোস্ট করেছেন, বিষয়টির পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করা দরকার।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেপি নাড্ডা লাড্ডু নিয়ে রিপোর্ট চেয়েছেন এবং কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশিও বিস্তারিত তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
আরও এক ধাপ এগিয়ে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বান্দি সঞ্জয় মন্দিরটির পরিচালনা কমিটি টিটিডি-তে অন্যান্য ধর্মের লোকদের নিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছেন।
ভোপালে হিন্দুত্ববাদী কর্মীরা জগন মোহন রেড্ডির কুশপুত্তলিকা পোড়ায় এবং তাকেই এই কাজের জন্য দায়ী করে।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর সদস্যরা রেড্ডির বাড়ির বাইরে বিক্ষোভ করেছে, স্লোগান দিয়েছে। তারা তার বাড়ির গেট ও দেয়াল গেরুয়া রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে, যে রঙের পোশাক হিন্দু পুরোহিতরা পরেন। এটি বিজেপি এবং অন্যান্য হিন্দু দলের পতাকারও রঙ।
বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়াতেও উত্তেজনা তৈরি করেছে। লাড্ডু, #TirupatiLaddu, #TirupatiLadduControversy এবং #TirupatiLadduRow-এর মতো হ্যাশট্যাগ সহ, এক্সে (আগের টুইটারে) কয়েকদিন ধরে ট্রেন্ডিং ছিল।
অনেকে একে হিন্দু বিশ্বাসকে আঘাত করার ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো রেড্ডির মাথায় মুসলিমদের টুপি লাগানো ছবিও ছড়িয়ে দিয়েছে।