আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় যে বাঙালি আছে, সে খোঁজ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের দূতাবাসও আছে রাজধানী নাইরোবিতে। কিন্তু একটি ‘বাংলাদেশ’ও যে রয়েছে দেশটির এক শহরে!
এই বাংলাদেশ পাওয়া যাবে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মোম্বাসায়। সেখানে বিশাল এক বস্তি আছে, যেখানে প্রায় সাত লাখ মানুষের বাস। এই বস্তিটির নামই বাংলাদেশ।
সেখানে নানা সংস্থা কিংবা প্রতিষ্ঠানের নাম ফলকে ফলাও করে বাংলাদেশ লেখাটি পাওয়া যায়। ‘সেন্ট প্যাট্রিকস ক্যাথলিক চার্চ, বাংলাদেশ’, ‘সেন্ট মারিজ বাংলাদেশ কমপ্রিহেসসিভ স্কুল’- এই নামগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশ কমিউনিটি ক্লিনিকের ছবিও মিলবে গুগলে।
এটাই শেষ নয়, সেখানে একটি ফুটবল একাডেমিও রয়েছে, যার নাম ‘বাংলাদেশ ট্যালেন্ট একাডেমি, মোম্বাসা’। তাদের ফেইসবুক পাতায় লেখা আছে, এটি বাংলাদেশ বস্তির একটি প্রতিভা অন্বেষণ কেন্দ্র, যেখানে ১০ বছর বয়সী ছেলে ও মেয়েদের ক্রীড়া প্রশিক্ষণ চলে।
দূর আফ্রিকার দেশে কেন বাংলাদেশই হলো একটি বস্তির নাম? এর উত্তর খুঁজতে গেলে হয়রানই হতে হয়।
বাংলাদেশের সঙ্গে কেনিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও তা যে খুব গভীর, তেমন কোনও ইঙ্গিত নেই। দুটি দেশ কমনওয়েলথের সদস্য, ন্যাম জোটেও একসঙ্গে আছে। এর বাইরে ঘনিষ্ঠতার নজির নেই।
বাংলাদেশ থেকে কিছু ওষুধ রপ্তানি হয় কেনিয়ায়, আর পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির বাজার খুলতে ২০১২ সালে তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর কেনিয়া সফরের খবর মেলে। এর বাইরে বাংলাদেশের আরও কোনও মন্ত্রী দেশটি সফরের কোনও খবর পাওয়া যায় না।
কেনিয়া তার কিছু ভূমি বাংলাদেশকে ইজারা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, সেদেশে বাংলাদেশের এক হাই কমিশনারের ভাষ্যে এমন খবর পাওয়া যায়, কিন্তু তার আর কোনও অগ্রগতির খোঁজ মেলে না। তবে কেনিয়ার সঙ্গে ক্রিকেটে বাংলাদেশের দ্বৈরথ এক সময় ছিল আলোচিত। এই দেশটিকে হারিয়েই বাংলাদেশ প্রথম আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
কেনিয়ায় কত বাংলাদেশি রয়েছেন কিংবা সেই সমাজে তাদের সক্রিয়তার খবর মেলে না। বাঙালিদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কিছু খবর ফেইসবুকে মেলে, তবে তাতে ভারতীয় বাঙালিদের তৎপরতাকেন্দ্রিক।
তাহলে বস্তির সঙ্গে কীভাবে বাংলাদেশ নাম জড়ালো কীভাবে- তা নিয়ে ইন্টারনেট ঘেঁটে যেটুকু ধারণা পাওয়া যায়, এক এশীয়ের জমিতে এই বস্তিটি গড়ে উঠেছে। আর বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় এই বস্তিতে গাদাগাদি করে মানুষের বসবাসই এই নামকরণের নেপথ্যে।
তবে আসলে এটাই কি কারণ, সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনও তথ্য ইন্টারনেটে না মিললেও এই বস্তির একটি তথ্য বেশ আলোচিত, তা হলো নিজস্ব মুদ্রা লেনদেন পদ্ধতি।
বাংলা-পেসা
বাংলাদেশ বস্তি প্রথম নজরে দেখলে সিলিকন ভ্যালির সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার প্রদর্শনের জন্য একদমই উপযুক্ত জায়গা বলে মনে হয় না। তারপরও বস্তিটি সর্বাধুনিক অর্থ ও মুদ্রা ব্যবস্থার এক দুর্দান্ত পরীক্ষা ও প্রমাণের স্থান হয়ে উঠে।
২০১৮ সালের আগস্ট থেকে বস্তির বাসিন্দারা একে অন্যের সঙ্গে ছাগল, টমেটো ও কাঠকয়লার কেনাবেচা করছেন একটি স্থানীয় ব্লকচেইন-ভিত্তিক ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহার করে।
এর প্রবক্তারা বলছেন, ভাগ্য সহায় হলে, এই ডিজিটাল মাইক্রো-ইকোনমি বা ব্যাষ্টিক-অর্থনীতি সেখানকার জনগোষ্ঠীসহ আশেপাশের অন্যদেরও দারিদ্র্য থেকে বের করে আনবে।
২০১৮ সালের ৭ আগস্ট বাংলাদেশ বস্তিতে ‘বাংলা-পেসা’ নামের ডিজিটাল টোকেন চালু হয়। কেনিয়াভিত্তিক গ্রাসরুটস ইকোনমিকস এই ডিজিটাল টোকেন চালু করে। প্ল্যাটফর্মটি ব্যাঙ্কর স্মার্ট টোকেনের মাধ্যমে ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্রেতা ও বিক্রেতাদের পরস্পরের সন্ধান দেয়। এতে তারা দ্রুত নগদ লেনদেন করতে সক্ষম হয়।
তবে বাংলাদেশ বস্তিতে ২০১৩ সাল থেকেই বাংলা-পেসা নামের একটি কাগজের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। বস্তির বাসিন্দারা সেটিকে সরকারি মুদ্রা ব্যবস্থার বাইরে একটি বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।
বাংলা-পেসা আদতে কোনো মুদ্রা নয়। এটি গচ্ছিত রেখে তারা পণ্য কেনা-বেচা করেন। এর জন্য একজন স্থানীয় ব্যবসায়িক প্রতিনিধি থাকেন, যিনি গ্যারান্টার হিসাবে কাজ করেন।
এটি ছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্যে সাহায্য করার জন্য মুনাফাবিহীন একটি উদ্যোগ। একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে চালু হয়েছিল এই প্রকল্প।
সেসময় অর্থনৈতিক মন্দার বাজারে মোম্বাসার জনবহুল বাংলাদেশ বস্তির দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে আর্থিক লেনদেনে সাহায্য করতে তৈরি হয়েছিল এই বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থা।
বস্তির বাসিন্দারা জার্মানিতে ছাপা কাগজের এই মুদ্রা ব্যবহার করে আসছিলেন স্কুলের বেতন, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, গির্জার চাঁদা ইত্যাদি পারিবারিক ব্যয় মেটানোর কাজেও।
২০১৮ সালে সেই কাগুজে নোটেরই ডিজিটাল সংস্করণ চালু করে গ্রাসরুটস ইকোনমিকস। কাগুজে নোটটিও গ্রাসরুটস ইকোনমিক্সেরই ছিল।
ব্যাঙ্করের কমিউনিটি কারেন্সি ডিরেক্টর এবং গ্রাসরুট ইকোনমিক্সের প্রতিষ্ঠাতা উইল রুডিক বলেছেন, “বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারগুলো প্রতি সপ্তাহে ভেঙে পড়ত এবং এর বাসিন্দারা খুব কমই খাবার খেতে পেত।”
রুডিক ব্যাখ্যা করে বলেন, “সমস্যাটা হলো, কেনিয়ার মুদ্রা শিলিং সরবরাহ ও চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্য কথায়, বাংলাদেশ বস্তিতে প্রচুর পণ্য যেত, কিন্তু সেগুলো কেনার জন্য নগদ অর্থ ছিল না।”
বাংলাদেশ বস্তির বাসিন্দা এমা ওনিয়াঙ্গো বলেন, বাংলা-পেসা টোকেন আসার আগে সঞ্চয় করার মতো কোনও অর্থই ছিল না।
তিনি বাংলাদেশ বস্তির মানুষদেরকে বাংলা-পেসা ব্যবহার করা শেখান।
গ্রাসরুট ইকোনমিক্স বাংলাদেশ বস্তির প্রতিটি বাসিন্দার জন্য ২০০টি করে টোকেন তৈরি করেছে। যেহেতু টোকেনগুলোর জন্য সুদ দিতে হয় না, তাই তাদের মূল্য বজায় রাখার জন্য স্থানীয় লেনদেনে অবিরামভাবে ব্যয় করতে হয়। এটি বাজারের সঙ্গে তালমিলিয়ে একটি মাইক্রো-অর্থনীতি তৈরি করে।
এর ফলে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য স্থির ও স্থিতিশীল হারে চলতে থাকে। এতে কেনিয়ান শিলিংয়ের ওপরও চাপ কমে। ফলে বাসিন্দারা তা অন্যত্র ব্যয় করার সুযোগও পান, এমনকি তুচ্ছ কাজের জন্যও।
ওনিয়াঙ্গো বলেন, “লোকে এখন আনন্দ-ফুর্তি করতেও যেতে পারে।”
ব্যাঙ্কর প্রটোকল বাংলা-পেসার বিনিময়ে বস্তির বাসিন্দাদের অন্য যে কোনও মুদ্রা সরবরাহ করে। এর ফলে তারা প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীগুলোতেও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে এবং বিদেশি পণ্যও কিনতে পারে।
প্রটোকল হল এক ধরনের ফ্লোট, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জোগান ও চাহিদার সঙ্গে বাংলা-পেসার মানের সমন্বয় করে।
ব্যাঙ্করের যোগাযোগ পরিচালক নেট হিন্ডম্যান বলেন, লেনদেনের এই জটিল সিস্টেমটিতে প্রটোকল ছাড়া হিসাব রাখা কঠিন। এই প্রক্রিয়ার ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে গ্রাসরুট ইকোনমিক্স একটি সুস্থ-স্বাভাবিক আঞ্চলিক অর্থনীতির সূচনা করতে সক্ষম হয়েছে, যা আফ্রিকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
এই ডিজিটাল টোকেন ব্যবহারের জন্য স্মার্টফোন দরকার হয়। তবে সেটাও কোনেও সমস্যা নয়। কারণ একটি বিস্ময়কর ব্যাপার হলো কেনিয়ার মানুষেরা গরিব হলেও প্রচুর স্মার্টফোন ব্যবহার করেন।
টোকেনটি চালু করার পরপরই স্কুল শিক্ষক থেকে শুরু করে দোকানদার, মাছ বিক্রেতাসহ অনেকেই ৫০০টি করে টোকেন নিয়েছেন। স্থানীয় ২৫০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এই টোকেন ব্যবহার করা যায়, যারা আগে থেকেই তাদের লেনদেনে বাংলা-পেসার কাগুজে টোকেনও ব্যবহার করছিল।
বাংলা-পেসা ডিজিটাল টোকেনে অর্থ প্রদান করা খুবই সহজ এবং তা সামনাসামনিই করা হয়। বস্তিবাসীরা বিক্রেতাদের কাছে নির্দিষ্ট পণ্য বা পরিষেবা নিয়ে ব্যাঙ্কর অ্যাপ ব্যবহার করে মূল্য হিসেবে টোকেন স্থানান্তর করে। এরপর লেনদেনটি ইথেরিয়াম নেটওয়ার্কের একটি সাইডচেইনে অঙ্কিত হয়। বাজার-সদাই থেকে শুরু কেরে স্কুলের ফি, চুল কাটা, নির্মাণ কাজ ও আবর্জনা সংগ্রহসহ প্রায় সব ধরনের কাজেই এই ডিজিটাল টোকেনে লেনদেন করা যায়।
যাদের স্মার্টফোন নেই তাদেরকেও এই ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে ব্যাঙ্কর টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে মুদ্রাটি বিনিময়ের সুযোগ করে দিয়েছে।
এই সাফল্যের পথে উইল রুডিককে অনেক নাটকীয়তারও মুখোমুখি হতে হয়েছে। সরকারি মুদ্রার সমান্তরালে কাগজের ভাউচার চালু করা একটি বিদ্রোহের মতো ছিল। যে কারণে ২০১৩ সালে স্থানীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের একটি দলসহ রুডিককে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। আদালতে ছয় মাস ধরে লড়ার পর রুডিক ও তার সঙ্গীরা মুক্তি পান। রুডিক বলেন, “আমরা কোনও আইন ভঙ্গ করিনি।”
বদলে যাচ্ছে আফ্রিকা
গ্রাসরুটস ইকোনমিকস পুরো আফ্রিকাকেই বদলে দিচ্ছে। কেনিয়া ছাড়াও কঙ্গো, নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায়ও বাংলা-পেসার মতো কমিউনিটি ডিজিটাল মুদ্রা চালু করেছে তারা।
এর দেখাদেখি ব্লকচেইন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সিরও ব্যাপক প্রচলন হচ্ছে। বাংলাদেশ বস্তি থেকে ব্লকচেইন এখন পুরো কেনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। একাধিক কোম্পানি ব্লকচেইন নিয়ে কাজ শুরু করেছে দেশটিতে।
গ্রাসরুটস ইকোনমিকস বাংলাপেসার আরেক নাম দেয় সারাফু। এই নামে আরও একাধিক স্থানীয় জনগোষ্ঠীতে কমিউনিটি মুদ্রা চালু হয়েছে।
ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ ও ২০২১ সালের মধ্যে সারাফুর ব্যবহার দ্রুত বেড়েছে। এই সময়ে সারাফুর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০০ শতাংশ বেড়ে ৫৮ হাজার ৬০০ জনে দাঁড়ায়। একই সময়ে এর মাধ্যমে তারা প্রায় ৩০ লাখ মার্কিন ডলার লেনদেন করেন।
কোভিড-১৯ মহামারীর সময় বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক চাপ স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোকে পণ্য ও পরিষেবার মূল্য পরিশোধের জন্য এই বিকল্পের দিকে ঠেলে দেয়।
সারাফু এখন ইউনিসেফ, রেড ক্রস ও ডব্লিউএফপির মতো মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলোর জন্যও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য নগদ অর্থের বিকল্প হিসেবে কমিউনিটি মুদ্রা পরীক্ষা করার একটি সফল মডেল।
২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে আফ্রিকায় ১০৫.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্রিপ্টোকারেন্সি পেমেন্ট পাঠানো হয়েছিল, যা আগের বছরের তুলনায় ১২০০ শতাংশ বেশি। রেমিটেন্স পাঠানোর জন্যও ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার বাড়ছে। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাব-সাহারান আফ্রিকায় যে ৪৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠানো হয়, তার মধ্যে ৫৮২ মিলিয়ন ডলারই যায় ডিজিটাল মুদ্রার মাধ্যমে।
আর আফ্রিকায় এই পেমেন্ট ও রেমিটেন্স গ্রহণকারী শীর্ষ তিনটি দেশ হল নাইজেরিয়া, কেনিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এরা বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহারকারী শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যেও রয়েছে।
কেনিয়াতে ক্রিপ্টোকারেন্সি গ্রাহক ৪০ লাখেরও বেশি, যারা দেশটির জনসংখ্যার ৮ শতাংশ।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, ফোর্বস, দ্য আফ্রিকা রিপোর্ট, ডিক্রিপ্ট ডট কো