Beta
বুধবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫

খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রায় নানা প্রশ্ন বিএনপির মধ্যেই

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৭ আগস্ট নয়া পল্টনে বিএনপির এই সমাবেশে খালেদা জিয়ার ভিডিও ভাষণ প্রচার করা হয়। ফাইল ছবি
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৭ আগস্ট নয়া পল্টনে বিএনপির এই সমাবেশে খালেদা জিয়ার ভিডিও ভাষণ প্রচার করা হয়। ফাইল ছবি
[publishpress_authors_box]

চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া বিদেশ যাবেন, এই দাবি বিএনপিরই ছিল; কিন্তু দলটির কর্মীদের ধারণা ছিল, চেয়ারপারসন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরবেন। কিন্তু তার ফেরার আগেই চেয়ারপারসনের বিদেশযাত্রার সিদ্ধান্তে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তাদের মনে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২৮ আগস্ট দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এক বক্তব্য এবং সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎ তাদের এই সন্দেহে ভিত্তি দিচ্ছে।  

মির্জা ফখরুল সেদিন বলেছিলেন, তারা এখনও ওয়ান-ইলেভেনের কথা ভুলে যাননি। তাই আবার যখন ‘ওই চেহারাগুলো’ সামনে আসে, তখন যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হয়।

কারও নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেছিলেন, ওয়ান-ইলেভেনের মতো বিরাজনীতিকীকরণের চেষ্টা উড়িয়ে দিতে পারছেন না তিনি।

২০০৭ সালে রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে সেনাবাহিনীর সমর্থনে গঠিত হয়েছিল অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকার। তাদের তৎপরতায় ‘মাইনাস টু’ হয়ে উঠেছিল আলোচিত। এর মানে হচ্ছে, দুই নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেওয়া।

তখন চাপের মধ্যেও খালেদা জিয়া দেশ ছাড়তে রাজি হননি বলে পরে বিএনপি নেতাদের কথায় উঠে আসে। শেখ হাসিনা বিদেশ গেলেও বাধা উপেক্ষা করে ফেরার কথা তিনি নিজেই পরে বলেছিলেন।

তখন খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করলেও রাজনৈতিক চাপের মুখে তাদের ছেড়ে দিয়ে দুই বছর পর নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন সেই সরকার।

সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর টানা দেড় দশক শাসন করে দেশ। তার মধ্যে দুর্নীতির মামলায় দণ্ড নিয়ে খালেদা জিয়াকে কারাগারে যেতে হয়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সেই সরকারের পতন ঘটলে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। অন্যদিকে খালেদা জিয়া মুক্তি পান।

চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানোর দাবি বিএনপি আগে থেকেই ছিল। মুক্তি পাওয়ার পর সেই পথ খুললেও স্বাস্থ্যগত জটিলতার কারণে তা পেছানোর কথা বিএনপি নেতারা বলে আসছিলেন। তারা এটাও বলেছিলেন যে খালেদা জিয়া বিদেশ গেলে তারেক রহমান দেশে ফিরে দলের হাল ধরবেন।

কিন্তু খালেদা জিয়া কবে যাবেন, তার কোনও দিন-তারিখ সুনির্দিষ্ট করে বলছিলেন না বিএনপি নেতারা।

গত ২ জানুয়ারি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান বিএনপি চেয়ারপারসনের বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার পর তা নিয়ে সব মহলে কৌতূহল দেখা গিয়েছিল; যদিও বলা হচ্ছিল, সেটা নিছকই সৌজন্য সাক্ষাৎ।

তবে তার তিন দিন পর রবিবার আকস্মিকভাবে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, মঙ্গলবার খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য যাবেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা রবিবার রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা রবিবার রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যান। এরপর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান যে তার নেত্রী চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার লন্ডন যাবেন।

তারেক রহমানের ফেরার কোনও দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার আগে খালেদা জিয়ার বিদেশ যাত্রা নিয়ে তাই নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে, যারা সিদ্ধানত গ্রহণের পর্যায়ে নেই।

তাদের নেত্রী কি পুনরায় দেশে ফিরবেন, নাকি ফিরবেন না? তারেক রহমানের ফেরা কি হবে? অসুস্থ হলেও খালেদা জিয়ার উপস্থিতি তাদের সাহস জোগাত, এখন তিনি না থাকলে, তারেক রহমান না ফিরলে দল কী করে চলবে? এমন অস্বস্তিকর সব প্রশ্ন জাগছে তাদের মনে।

বাংলাদেশের রাজনীতির দুই খেলোয়াড় খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে ‘ব্যাটলিং বেগমস’ হিসাবে চিত্রিত করা হতো।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা ‘মাইনাস’ হয়েছেন, এখন খালেদা জিয়াকেও কি ‘মাইনাস’ করা হচ্ছে? এসন শঙ্কাও কাজ করছে বিএনপির কর্মীদের মনে।

বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি তো ঠিক বুঝতে পারছি না, কোন দিকে যাচ্ছে সবকিছু।”

ঢাকা মহানগর উত্তরের এক নেতা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এত বছর অপেক্ষা করলাম, নির্যাতিত হলাম। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটল। কিন্তু আমরা এখনও ধোঁয়াশার মধ্যেই আছি।

“হাই কমান্ডের কোনও কিছুই আমাদের কাছে স্পষ্ট না। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত ম্যাডাম দেশেই থাকবে, তেমনটাই জানতাম। এখন দেখি উলটো। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কবে আসবে দেশে, সেটাও জানি না আমরা।”

ঢাকা মহানগরের আরেক নেতা বলেন, “ম্যাডাম যাওয়ার পর আমাদের আর কোনও অভিভাবক থাকবে না।

“বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী ‘মাইনাস টু’ নিয়েও ভাবতে হচ্ছে আমাদের। যদিও দেশের জনগণ, জাতীয়তাবাদী নেতাকর্মীরা এটা হতে দেবে না। তারপরেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।”

তবে বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা আশ্বস্ত করছেন, এমন শঙ্কার কোনও কারণ নেই।

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রাজনৈতিক বাজারে কতজন কত কথা বলে, জল ঘোলাও করে। এতে দোষের কিছু নেই।

“ম্যাডামের বিদেশ সফর তার উন্নত চিকিৎসার জন্য। যার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আমরা বলে আসছিলাম। তার পরিবার থেকেই বারবার আবেদন করা হয়েছিল, কিন্তু ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার অবৈধ ভাবে তার বিদেশ যাত্রার আবেদন বাতিল করে দেয়। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে, বিদেশ যাত্রায় বাধা নেই, তাই যাচ্ছেন। এখানে রাজনৈতিক কোনও ইঙ্গিত নেই।”

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৭ আগস্ট নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন তারেক রহমান। ফাইল ছবি

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাসও এই ধরনের শঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ব্যাপারটা তো খুবই সহজ। আমি-আপনি যেমন যাই চিকিৎসার প্রয়োজনে, তিনিও যাচ্ছেন। তার যাওয়ার ডিমান্ড রয়েছে, ডিমান্ড ফুলফিল হচ্ছে। আর সে ডিমান্ড একটাই… সেটি হলো উনার উন্নত চিকিৎসা।”

দলীয় নেতা-কর্মীদের শঙ্কার কথা জানানো হলে তিনি বলেন, “এখানে শঙ্কার কিছু নেই। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাহেবও সময় সুযোগ বিবেচনায় দেশে ফিরবেন।

“আর তার নির্দেশনাতেই দলীয় সমস্ত কিছু এতদিন চলছিল। এখনও সেভাবেই চলবে। বিশেষ কোনও পরিবর্তন তো হচ্ছে না।”

মঙ্গলবার রাতে কাতারের আমিরের পাঠানো একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডন যাবেন খালেদা জিয়া। বিমানবন্দর থেকেই তাকে নেওয়া হবে দ্য লন্ডন ক্লিনিকে। সেখানেই তার চিকিৎসা চলবে।

তিনি কবে নাগাদ দেশে ফিরবেন, সে বিষয়ে বিএনপি কিছু জানাতে এখনই পারছে না। সাংবাদিকদের প্রশ্নে মির্জা ফখরুল বলেন, এটা নির্ভর করবে চিকিৎকদের ওপর।

গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে ছাড়া পেয়ে ২০০৮ সালে সপরিবারে লন্ডন গিয়ে এখনও সেখানেই রয়েছেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। লন্ডনে বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়ে তিনি মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাবেন, এমনটাই জানিয়েছেন বিএনপির নেতারা।

তারা আরও বলেছেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার সামগ্রিক সমন্বয় করবেন তারেকের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান। তার সঙ্গে বাংলাদেশে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরাও থাকবেন।

৭৯ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া হৃদরোগ, ফুসফুস, লিভার, কিডনি, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন। তার লিভার সিরোসিস ধরা পড়ে কয়েক বছর আগে। এর মধ্যে তার হৃদপিণ্ডে স্টেন্ট বসানো হয়, বসানো হয় পেস মেকারও।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত