ওয়ান-ইলেভেনের সরকার আমলে সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতির অভিযোগে হয়েছিল দুটি মামলা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পরের বছরই দলটির সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলাটি বাতিল করে দেয় উচ্চ আদালত।
কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাটি ঝুলছিল বিচারিক আদালতে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় ২০২৩ সালের ১৯ মার্চ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচারও শুরু হয়েছিল।
কিন্তু এক বছর বাদে ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। তার ধারবাহিকতায় ছয় মাস পর এই মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে খালেদা জিয়াও পেলেন খালাস।
বুধবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক রবিউল আলমের দেওয়া রায়ে খালেদা জিয়াসহ মামলার আসামি আটজনকেই বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
১০ বছর আগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা বাতিলে যে যুক্তিটি দেখিয়েছিল হাই কোর্ট; বুধবারের রায়ে বিচারিক আদালতও বলেছে একই কথা। আদালতের ভাষ্যে, মামলাটি দুটি ছিল রাজনৈতিক হয়রানিমূলক।
বাংলাদেশের তিনটি গ্যাস ক্ষেত্রের কাজ কানাডীয় কোম্পানি নাইকোকে দেওয়ার আলোচনা শুরুর সময় ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের সেই সরকারে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা।
দর কষাকষি চললেও তখন তাদের সঙ্গে আর চুক্তি হয়নি। তবে ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় যাওয়ার পর খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন ২০০৩ সালে নাইকোকে কাজ দেওয়ার চুক্তি হয়।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দুই নেত্রী যখন কারাবন্দি, তখন তাদের বিরুদ্ধে নাইকোর সঙ্গে অস্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি ও দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন দুটি মামলা করে।
একটি মামলা হয় শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। আরেকটি মামলা হয় খালেদা জিয়া ও তার সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়, ঘুষ নিয়ে নাইকোকে কাজ দিয়েছিলেন তারা।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০১০ সালের ১১ মার্চ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা নাইকো দুর্নীতি মামলাটি বাতিল করে হাই কোর্ট।
আদালত তখন বলেছিল, শেখ হাসিনাকে হয়রানি করা উদ্দেশ্যে স্বার্থান্বেষী মহল মামলাটি করেছিল। বিচারিক আদালতের মামলাটি আমলে নেওয়াও বেআইনি হয়েছিল বলে আদালতের পর্যবেক্ষণে করা হয়।
তখন বিএনপি থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, একই অভিযোগে একজনের বিরুদ্ধ মামলা বাতিল হলেও আরেকজনের বিরুদ্ধে মামলা কীভাবে চলতে পারে?
তবে সেই আপত্তির মধ্যেও মামলাটি সচল ছিল। খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে গেলেও কোনও ফল পাননি।
এর মধ্যে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে খালেদা জিয়া দুর্নীতি একটি মামলায় সাজার রায়ের পর কারাগারে যান। নাইকো দুর্নীতি মামলাও গড়াতে থাকে।
২০০৭ সালে তেজগাঁও থানায় করা দুদকের এই মামলায় পরের বছরই খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছিল দুদক। তাতে প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়েছিল।
খালেদা জিয়া অন্য মামলায় দণ্ড নিয়ে কারাগারে গেলেও দুই বছর পর দেশে কোভিড মহামারি দেখা দেওয়ার পর তাকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়ে নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিল সরকার।
সেই সময়ের মধ্যে ২০২৩ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ ৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ হয় ঢাকার জজ আদালতে।
এরমধ্য গত বছরের আগস্টে অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেন রাষ্ট্রপতি। অন্য সব মামলায়ও তিনি অব্যাহতি পেতে থাকেন।
অসুস্থ খালেদা জিয়া মুক্তির ছয় মাস পর গত ৭ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যে যান। তার এক মাস পর গত ৫ ফেব্রুয়ারি নাইকো মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। ৬৮ সাক্ষীর মধ্যে ৩৯ জনের সাক্ষ্য নিয়ে আদালত বুধবার রায়ের দিন ঠিক করে।
রায়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে খালাস পান সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দীন সিদ্দিকী,বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সাবেক জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব সিএম ইউসুফ হোসাইন, ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ও বাগেরহাটের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ এইচ সেলিম ।
খালেদা জিয়ার সরকারের দুই মন্ত্রী মওদুদ আহমদ ও এ কে এম মোশাররফ হোসেন এবং বাপেক্সের সাবেক সচিব মো. শফিউর রহমান মারা যাওয়ায় তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
রায়ে বিচারক বলেন, রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য খালেদা জিয়াসহ অন্য আসামিদের এই মামলায় জড়িত করা হয়েছে। আসামিরা কেউই আর্থিকভাবে লাভবান হয়নি।
রায় দেওয়ার আগে বিচারক বলেন, “প্রশ্ন হতে পারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে কীভাবে আসামির আত্মপক্ষ শুনানি করা হচ্ছে। ডিএলআর এর ১৭ থেকে ২১ পর্যন্ত এ বিষয়ে বলা আছে। কোনও আসামি আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরায় থাকলে তার অনুপস্থিতিতে আত্মপক্ষ শুনানি করা যায়। আবার রায়ও দেয়া যায়। সেই অনুযায়ী রায় দেওয়া হচ্ছে।”
মামলার প্রধান আসামি খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে থাকায় আদালতে হাজির হতে পারেননি। তারপক্ষে আইনজীবী হাজিরা দেন। জামিনে থাকা অন্য আসামিরা আদালতে হাজির হন। সব আসামি খালাস পাওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
রায়ের পর্যবেক্ষণে এই বিচারক বলেন, “একই ধরনের মামলা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও ছিল। যেহেতু ওই মামলা চলে নাই, তবুও এ মামলার ফুল ট্রায়াল হয়েছে।
“আসামি সেলিম ভূঁইয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। চার দিনের রিমান্ডেও ছিল। তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়। পরে অবশ্য তা প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়। সেখানেও বলেছেন তাকে শারীরিক, মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে।”
বিচারক বলেন, “সেলিম ভূঁইয়াকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে ফোর্স করে ১৬৪ নেওয়া হয়েছে। সে কারণে এই ১৬৪ কে ট্রু বলার সুযোগ নেই। এর উদ্দেশ্য হলো গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, কাশেম শরীফসহ অন্যদের জড়িত করার জন্য কিন্তু জোরপূর্বক এ ১৬৪ গ্রহণ করা হয়েছে।
“রাজনৈতিক কারণে এবং হয়রানি করার জন্য সাবেক প্রদানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ অপর আসামিদের জড়িত করা হয়েছে। আসামিরা কেউই আর্থিকভাবে লাভবান হয়নি।”