Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪
Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪

এরশাদ পতন উৎসবের কনসার্ট ও নেপথ্যের কারিগর

কণ্ঠের কারণে এক সময় চাইমকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন খালিদ।
কণ্ঠের কারণে এক সময় চাইমকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন খালিদ।
Picture of সৈয়দ ফরহাদ

সৈয়দ ফরহাদ

১৯৯০ সাল। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। সামরিক শাসক এরশাদের পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে হতো শিক্ষার্থীদের। ঢাকা ইউনিভার্সিটির মল চত্বর নামে পরিচিত ‘মালরো চত্বরে’ কড়ই গাছের আড়াল নিয়ে চলেছে কত কত বন্দুকযুদ্ধ। অবশেষে উত্তাল আন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকারের পতন হলো ৬ ডিসেম্বর।

স্বৈরাচারের পতনের কয়েকদিন পরই ছিল বিজয় দিবস। এরমধ্যে ১৩ ডিসেম্বরে এক বৈঠকে বসেছিল বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন (বামবা)। তখন এই সংগঠনের প্রথম সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ফিডব্যাক ব্যান্ডের মাকসুদুল হক; আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ২৬ বছর বয়সের আশেপাশে থাকা এক যুবক।

তিন দিন পর বিজয় দিবসের পাশাপাশি বড় আকারে গণ আন্দোলনে এরশাদের পতনও উদযাপন করতে ওই যুবক প্রস্তাব রাখেন, সবগুলো ব্যান্ড নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে হোক ‘ওপেন এয়ার’ কনসার্ট।

এরশাদের পতনের পর জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে সবদলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির প্রয়োজন হয়। সকল বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ ৯ ডিসেম্বর ‘নিরপেক্ষ নির্দলীয় কেয়ারটেকার’ সরকার গঠন করেন। এই সরকারের দায়িত্ব ছিল একমাত্র দায়িত্ব ছিল তিন মাসের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা।

ঘটনাবহুল ওই ডিসেম্বরে প্রতিদিনই রাজনৈতিক ঘটনাবলী কোনও না কোনওদিকে বাঁক নিচ্ছিলো। তাহলে খোলা ময়দান আর খোলা মঞ্চে অসংখ্য দর্শক এবং শিল্পী-আয়োজকদের নিরাপত্তা কে দেবে? বামবা কি এমন কোনো ঝুঁকি নিয়ে কনসার্ট করবে? মাত্র তিন দিন হাতে নিয়ে কি কনসার্ট করা সম্ভব হবে?

পরের দিন সন্ধ্যায় আবারও সভা ডাকা হয়। এবার মাকসুদের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেলেন সেই যুবক। ঠিক হলো, রাজনীতিকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, যেন তারা এই আয়োজনে সহায়তা করেন।

ওই যুবক তখন ছাত্রলীগ করতেন। সেই সূত্রে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক। বামবা সভাপতির সম্মতি পেয়ে দেরি না করে নিজের বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। আর মাকসুদকে বলে গেলেন, রাতের মধ্যে বিস্তারিত জানাবেন।

রাতে মাকসুদকে ফোন করে যুবক জানালেন, “ম্যাক, তারা সবাই আমাদের সঙ্গে আছেন। চিন্তার কিছু নেই; তারাও চান এই কনসার্ট হোক।”

রেনেসাঁ ব্যান্ডের ফয়সাল সিদ্দিকী বগি তখন ধরেই নিয়েছিলেন, ওই রকম সময়ে কনসার্টের পরিকল্পনা করা নেহায়েত পাগলামি।

১৪ ডিসেম্বরে বামবা সভাতেও সদস্যদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তবে ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যার মধ্যে ১৪টি ব্যান্ড দল প্রস্তুত হয়ে যায় কনসার্টের জন্য।

এরমধ্যে জানা যায়, এই কনসার্টকে ঘিরে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। যুবকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে দ্রুত সভা করলেন মাকসুদ। আর তারপরই মাকসুদ লিখলেন বামবার দর্শন বাক্য – ‘ব্যান্ড সঙ্গীত অপসংস্কৃতি নয়’। 

এরকম অনেক বিপত্তি পেরিয়ে ১৬ ডিসেম্বর এলো বামবার সামনে। সেবার মল চত্বরে রীতিমত সাড়া ফেলেছিল বামবার প্রথম ওপেন এয়ার কনসার্টটি।

সেদিন মল চত্বরে কনসার্ট আয়োজনের নেপথ্যে কালো চশমা চোখে চুল ‍উড়িয়ে বাইক চালানো ওই যুবকটি কে?

ব্যান্ড সঙ্গীত জগতে এমন অনেক ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে খালিদের নাম। পরিবারের দেওয়া তার খালিদ আনোয়ার সাইফুল্লাহ নামটি অনেকেরই জানা নেই। তার পরিচয় হয়ে উঠেছিল ‘চাইমের খালিদ’ হিসেবেই। যদিও কণ্ঠের কারণে এক সময় চাইমকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

খালিদের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরপরই সকাল সন্ধ্যা যোগাযোগ করেছিল বাংলা ব্যান্ডের সোনালি সময়ের দুই যোদ্ধার সঙ্গে।

সোলসের পার্থ বড়ুয়া বিষণ্ন মনে কোনও কথাই বলতে পারলেন না। পরে ফোন করার অনুরোধ করে লাইন কেটে দিলেন। 

প্রথমে ফিডব্যাক ও পরে ঢাকা ব্যান্ডের লিড ভোকাল মাকসুদও শুরুতেই বললেন, “খালিদকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে কথা বলার মানসিক অবস্থা নেই।”

প্রয়াত খালিদ পৌঁছেছিলেন ৬০ বছর বয়সে। খালিদের চেয়ে মাকসুদ বয়সে খানিক বড় হবেন।

সঙ্গীত জীবনের অনেকটা পথ চলার নানা স্মৃতি নাড়া দিচ্ছে বলেই হয়তো মাকসুদ নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় নৈঃশব্দ ধারণ করতে চাইলেন।   

সেই আভাস দিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আমার মনটা খুবই খারাপ। আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। সে হঠাৎ চলে গেল এমন করে! আমি অনেক ডিসটার্বড আছি। আমি প্রচণ্ড ডিসটার্বড। আমি এই মুহূর্তে কোনো কথা বলতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করবেন।”

মাকসুদের প্রতিক্রিয়া পেতে ব্যর্থ হয়ে মাইলসের ভোকাল এবং বামবার বর্তমান সভাপতি হামিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো।

খবর পাওয়ার পর থেকেই বিষাদগ্রস্ত ছিলেন হামিনও। তবে সেই বেদনা প্রকাশে খুলে দিলেন স্মৃতির অর্গল। আর সেখান থেকেই জানা গেল, কেন খালিদের মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন মাকসুদ।

“স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন হিসেবে আমরা ওই কনসার্টটি করেছিলাম। এটা সম্ভব হয়েছিল তখন মাকসুদের প্রচণ্ড ইচ্ছা ও সুদূর পরিকল্পনার কারণে। মাকসুদের কাছ থেকেই শুনেছি, সেই সময় গ্রাউন্ডে পুরা কাজটা করেছিল কিন্তু খালিদ।”

হামিনের  স্মৃতিতে ‘রক অ্যান্ড রোল’ খালিদ

‘এ হৃদয় ভেঙে গেলে জানো কি তা লাগে না, লাগে না জোড়া’; এই তো ছিল চাইম ব্যান্ডের খালিদের গাওয়া একটি গানের কথা। তিনি মারা গেলেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে। এও কি হৃদপিণ্ড ভেঙে যাওয়া নয়? আগেও একবার কার্ডিয়াক আ্যারেস্ট হয়েছিল খালিদের। হৃদযন্ত্রে লাগানো ছিল স্টেন্ট।  এবার চূড়ান্তভাবে শ্রোতাদের হৃদয় ভেঙে দিয়েই চলে গেলেন খালিদ।

নব্বইয়ের লাখো তরুণ-তরুণীর প্রেমে ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাসে তার কণ্ঠের গান ছিল কষ্টের অনুভূতি ইথারে ছড়িয়ে দেওয়ার পাথেয়। সোমবার রাতে পার্থিব জীবনকে বিদায় জানালেন তিনি। শেষ ঠিকানা তার গোপালগঞ্জের গ্রামের বাড়ি।

হামিন আহমেদ শুরুতেই জানালেন, দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পর মাঝখানে অনেকদিন তার সঙ্গে খালিদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা ছিল। 

১৯৯১ সালে গঠনতন্ত্র তৈরির পর প্রথমবারের মতো বামবার নির্বাচন হয়। তাতে প্রথম নির্বাচিত সভাপতি হন হামিন আহমেদ।

স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে তিনি বলেন, “ওর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিক অ্যাসোসিয়েশন  গড়ে ওঠার শুরুর দিকেই।

“সেটি ছিল ১৯৮৭ সাল। চাইম বলতেই দুটো মানুষকে বোঝায় টুলু আর খালিদ। খালিদের গায়কীটা অসাধারণ ছিল। চাইম ব্যান্ডটির জনপ্রিয়তার মূল কারণই ছিল খালিদের গায়কী ঢংটা। মাকসুদ তখন এর প্রেসিডেন্ট ছিল, খালিদ প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি। এর পরের টার্মে আমি দায়িত্ব নেই। তখনও খালিদ কমিটি মেম্বার ছিল।”

এসব বলতে বলতে বিমর্ষ হামিন আবার বলে ওঠেন, “আমি খুবই মর্মাহত। এমন কোনও বয়সও হয়নি ওর যাবার।

“তবে ও রক অ্যান্ড রোল লাইফই লিড করেছে। শরীরের প্রতি তেমন যত্ন নিত না কখনোই। শিল্পী তো অনেকেই; কিন্তু সবার হয় না। কিন্তু গান শুনলেই বোঝা যেত ওর হয়, এটা খালিদ গাইছে।”

১৯৮৭ সালে বন্যার্তদের জন্য কনসার্ট করার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে বামবা।  ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ১৯৮৮ সালে কনসার্ট করে বামবা। এর পরের বছর একই জায়গায় বন্যার্তদের জন্য আবারও কনসার্ট হয়।

কনসার্টে খালিদ ‘নাতি খাতি বেলা গেল’ গানটি পরিবেশন করেছিলেন।

হামিন বলেন, “এটা ছিল একটা দারুণ হিট গান। ওদের লাইমলাইটে মনে হয় এই গানটাই নিয়ে আসল। খালিদ যখন চাইমের হয়ে গানটা গাইল, তখন পুরো কনসার্টে উন্মাতাল অবস্থা। বারবার বলবো, ও একদম রক আ্যান্ড রোল ছিল।

‘খুব সেন্টিমেন্টাল’ খালিদ শহরে বাইক নিয়ে ঘুরতে পছন্দ করতেন। একবার যাকে আপন করে নিতেন, তার জন্য ‘জীবনও দিতে পারতেন’।  

“ওহ, কালো চশমা! চুল উড়ছে! মটর বাইক! যাকে পছন্দ হলো তাকে হলো, না হলে হলো না …। রাজনীতি সচেতন ছিল।  আর্টিস্ট হিসেবে বলতে হয়, যদি হিমালয় হয়ে… গাইতো সেইরকম,” বলেন হামিন।

প্রথম অ্যালবাম ও খালিদ

খালিদের মৃত্যু মনে করালো ব্যান্ড গানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই

ব্যান্ড গানের শিল্পী খালিদের চলে যাওয়া আরও নানাভাবে ভাবিয়েছে হামিন আহমেদকে।

“খালিদের তো অসংখ্য গান আছে। উইনিংয়ের চন্দনের (জামান আলী চন্দন)  ওই দূর পাহাড়ের ধারে গানটা… একটা অ্যালবামের জন্যই তো ওর পুরস্কার পাওয়া উচিৎ ছিল। খালিদের চলে যাওয়া আরেকবার মনে করিয়ে দিল ব্যান্ড সঙ্গীতের কোনও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই।”

“খালিদ খুব ভালো গান গাইতো। যেটা চাইমকে অনেক হেল্প করছে। ওর যে গলার টোন, শুনলেই (শ্রোতারা) আকৃষ্ট হয়, গানটাকে নিজের ভেতরে নিয়ে গাইত। ‘নাতি খাতি বেলা গেল’ শুনলে এক ধরনের অনুভূতি কাজ করে; ‘সরলতার প্রতিমা’ শুনলে আরেক ধরনের; ইউ ক্যান ফিল ইট।”

বাংলা গানে ব্যান্ড সঙ্গীতের আবেদন ও অবদান তুলে ধরে হামিন আহমেদ বলেন, “মাইলস একাধারে আমেরিকার ৩০টা স্টেটে শো করেছে, যেখানে লোকজন কেবল মাইলসকে দেখতে আসছে। সোলস এখন করছে, কাঁপাচ্ছে। খালিদের গান তো এখনও মুখে মুখে ফেরে। সেই আমেরিকাতেও লোকজন ওই গান শুনতে চায়।

“খালিদ পেছনে চলে গেছে, ভালো লাগে না বলে। কিন্তু যে পরিমাণ গান বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতকে দিয়েছে … আমরা যদি একসঙ্গে না থাকি, কে মনে রাখবে খালিদকে? চাইমের টুলুও সেই কানাডার কোনও এক শহরে একা থাকে। সে বলে, আর্টিস্টরা তো এরকমই হয়। কিন্তু আর্টিস্টদের তো বাকিদের মনে রাখতে হবে। মনে হয়, এ ব্যাপারে বামবার একটা ভূমিকা নিতে হবে, আমরা এ ব্যাপারে খুব জরুরি আলোচনা করছি কিছুদিন হলো।”

কেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি জরুরি তা ব্যাখ্যা করে এই শিল্পী বলেন, “রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের স্বীকৃতি না আসলে, আমাদের নিজেদের বিকল্প বের করতে হবে। নিজেদের বলতে আসলে মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর একটা জায়গা থাকতে হবে ব্যান্ড সংগীত শিল্পীদের।

“গানগুলো নিয়ে যারা চলে গেলেন, এখন সবাইকে মনে করতে হবে। ৫০ বছর হলো বাংলা সঙ্গীতের একটি বিশেষ ধারা ব্যান্ড মিউজিকের। পপ, রক, বাংলা রক যাই বলা হোক না কেন বাংলাতেই গান গাই, বাংলা গানই তো করি।”

“আমাদের শোতে আমেরিকানরা দেখে তাজ্জব হয়ে যায় বাংলাদেশে এমন ব্যান্ড আছে। মিউজিক চ্যানেল গান বাংলার ‘উইন্ড অব চেইঞ্জ’ প্লাটফর্মে মাইলসের ‘ধিকি ধিকি আগুন জ্বলে’ গানটি শুনে আমেরিকার একজন বিখ্যাত প্রডিউসার বারবার বলছিলেন, আর ইউ শিওর এটা বাংলাদেশের প্রডাকশন?”

“বাংলা রককে নিয়ে আমাদের জেনারেশন কম ঝক্কি পোহায়নি। কম সমালোচনা সহ্য করতে হয়নি। লড়াই করে এ পর্যন্ত এসেছি।  স্ট্রাকচারড সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে ক্রিকেট এ পর্যন্ত এসেছে। এ খেলাটি বাদ দিলে, দ্বিতীয়তেই আপনাকে তারুণ্যের সামনে দাঁড় করাতে হবে বাংলা রক মিউজিককে। আমাদের, এই মিউজিশিয়ানদেরই দাঁড়াতে হয়। কুয়েটে কিছুদিন আগে গাইলাম। কে টিকবে এই ব্যান্ডগুলোর কাছে? তারুণ্যের আহ্বানের কাছে?”

কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের ছেলে হামিন খালিদের চলে যাওয়া মনে করে বলেন, “আমরা তো চলে যাচ্ছি একে একে। আমাদের নিয়ে এখনকার জেনারেশনের স্মৃতিও সেইভাবে নেই। এই কথাগুলো বলে তো যেতে হবে।

“বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের সেরকমভাবে কোনও রিকগনিশন নেই। অথচ বাংলা গানকে এগিয়েই তো নিয়ে গেছে ব্যান্ডগুলো। পপ, রক কালচার থেকেই সব হচ্ছে। আমরা যদি না থাকতাম ভারতের পাশে দাঁড়াইতেই পারতোই না বাংলা গান ও সংস্কৃতি।”

“আমরা (মাইলস) যে নিউ ইয়র্কে শো করলাম সব কয়টি টিকেট সোল্ড আউট হয়ে গেছে। আমরা যদি না থাকতাম অন্যান্য ভাষাভাষীর সংস্কৃতির আগ্রাসনেই হারিয়ে যাওয়া লাগতো বাংলাকে।”

খালিদ ও ফাহমিদা নবীর যুগলবন্দি অ্যালবামের প্রচ্ছদ

খালিদের জন্য সহশিল্পীদের আবেগ

মেলোডি রক গানের শিল্পী খালিদের মৃত্যুর খবর জানার পর ঢাকার গ্রিন রোডে তার বাসায় ছুটে আসেন অনেকে।  

প্রেম ভাঙা বিষাদ মাখা গানে খালিদের কণ্ঠ শ্রোতাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল;  শোক জানাতে এসে শ্রোতাদের মনের সেই কথাটাই বললেন সহশিল্পীরা।

খালিদ এবং ফাহমিদা নবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী জীবন থেকে বন্ধু। শিল্পী জীবনে দুজনের  ‘পথচলা এক সঙ্গে’। এক সঙ্গে ডুয়েট করেছেন তারা।

“ভাষাহীন হয়ে গেছি আসলে। একটা প্রাণবন্ত ছেলে ছিল। গাইতো দুঃখের গান। এই কারণে মানুষের খুব কাছাকাছি ও। কারণ দুঃখের গান দিয়ে মানুষের কাছাকাছি যাওয়া যায় … আর খুব হৃদয়গ্রাহী সেই গানগুলো। এই অপূরণীয় ক্ষতি … নেওয়া যাচ্ছে না।”

ভক্ত ও সহশিল্পীদের ভিড়ের মধ্যে থেকে তরুণ মুন্সীকে দেখিয়ে দিলেন ফাহমিদা নবীই; বললেন, “তরুণ মুন্সী ওর সুরকার।”

চাইম ব্যান্ডের ভোকাল খালিদ সাইফুল্লাহ সম্পর্কে তরুণ মুন্সীর চাচা হন।

তবে চাচা-ভাতিজা সম্পর্কের কারণে নয়, শ্রোতাদের কাছে এই জুটি বিশেষ হয়ে আছেন ‘সরলতার প্রতিমা’ গানটির জন্য; যার গীতিকার তরুণ মুন্সী। চাইমের ‘কীর্ত্তণখোলা’ অ্যালবামের অনেক গানের কথা ও সুর করেছেন এই তরুণ।

নব্বই দশকের শেষ দিকে প্রকাশের পরপরই জনপ্রিয় হয় সরলতার প্রতিমা গানটি। সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আগে এবং  এখনও জুয়েল-বাবু জুটির নাম দেখা গেলেও অনেকেই বলেন তরুণ মুন্সীই এই গানের সুর করেছিলেন।

এই গানটি সৃষ্টির সেই সময়কাল নিয়ে তিনি বলেন, ”আসলে তখন তো আমি বয়সে অনেক ইয়ং। কথা ও সুর করার প্রবণতা সেটা নিজের ভেতর ভালো লাগা থেকে …। 

“আমি তখন জুয়েল-বাবুদের সঙ্গে কাজ করছি একসঙ্গে। এক সঙ্গেই আসলে আমাদের জার্নি শুরু হয়েছে। আমার চাচা তো সব সময় সুরেলা গান মানুষকে শুনিয়েছেন। আমিও চেষ্টা করেছি উনার জন্য যখনই যেখানে …চাইমে হোক বা সরলতার প্রতিমার কথাই যদি বলি …সুরেলা গানটা যেন তার কণ্ঠে থাকে।”

“পরিবার এবং সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে, তার একজন সহকর্মী হিসেবে, আত্মীয় হিসেবে সবার কাছে এটাই চাওয়া থাকবে, তাকে গানের মাধ্যমে মনে রাখবেন। খালিদের এই যাত্রা শেষ হলো, কিন্তু তার গানটা যেন শেষ না হয়ে যায়। মানুষের মুখে মুখে যেন তার গানটা থাকে। ” 

খালিদের কণ্ঠ নিয়ে তরুণ মুন্সী বলেন, “সে মেলোডি কিং – এতে কোনো সন্দেহ নেই। উনার একজন ভক্ত হিসেবে বলতে পারি কিছু কিছু শিল্পীর গান আসলে কানের জন্য। কিছু কিছু শিল্পীর গান হৃদয়ের জন্য।”

“আমাদের দেশে গানের যে ধারাটা … তারমধ্যে ব্যান্ড সঙ্গীত বা সলো যাই হোক, খালিদ যে একটা কণ্ঠ ছিল সেটা আমার মনে হয় অনুকরণ করার মতো। … যতদিন বাংলা গান মানুষের কণ্ঠে থাকবে, একজন খালিদের গান তার কণ্ঠের জন্য শ্রুতিমধুর ব্যাপারটার জন্য চিরজীবী হয়ে থাকবে।”

“উনার ভক্তরা উনাকে সামনাসামনি যতটা না পায়, ফিতায় (ক্যাসেট) বা অনলাইন মাধ্যমে হোক … উনি অনেক বেশি পৌঁছানো শিল্পী। আমার মনে হয় উনার ধারণাই ছিল না, কী পরিমাণ মানুষ উনার কণ্ঠকে ভালোবাসে; উনার গানের রুচিটাকে পছন্দ করে।”

‘মেয়ে’ অ্যালবামের এই গান খালিদকে দিয়েই গাওয়ানো প্রসঙ্গে তরুণ মুন্সীর ভাবনা, ”তখন প্রত্যেকটি মিউজিক ডিরেক্টর তাদের মেলোডিয়াস গানটা খালিদ কাকার জন্য রাখতো।

“খালিদ এমন একটি কণ্ঠ যে প্রত্যেক গীতিকার, সুরকার, মিউজিক ডিরেক্টর তার বেস্ট মেলোডিয়াস গানটা কিন্তু উনাকে দিয়ে গাওয়ানোর চেষ্টা করতো।”

শুধু যে নিখাদ বিষাদের গানই গেয়েছিলেন খালিদ সাইফুল্লাহ, তা নয়। ক্যাসেট যুগে চাইমের ‘কালো মাইয়া কালো বইলা’ গানটিও তার কণ্ঠে সমাদৃত হয়েছিল। আর এই গানের গীতিকার হলেন কবির বকুল।

খালিদকে হারানোর শোকের ভিড়ে যোগ দিয়েছিলেন তিনিও।

কবির বকুল বলেন, “খালিদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার একটা যোগসূত্র আছে। তার সঙ্গে একটা আত্মীয়তা আমার আছে।  সেটা গানের মাধ্যমেই হোক আর যেভাবেই হোক। সেই সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল একানব্বই সাল থেকে।

“৩৩ বছর ধরে তার সঙ্গে আমার যে আত্মিক সম্পর্ক গানের মাধ্যমে হয়েছিল … সেটা আজকে … কী বলবো…বাস্তবে হয়তো খালিদ ভাই নেই কিন্তু আমাদের হৃদয়ের মধ্যে খালিদ ভাই থেকে যাবেন।”

শিল্পীদের যত্নে থাকতে বললেন শোকগ্রস্ত ফাহমিদা নবী

রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাদি মহম্মদ এবং ব্যান্ডশিল্পী খালিদকে কয়েকদিনের ব্যবধানে হারানোর পর সবার ‘ভালো থাকায়’ জোর দিলেন সঙ্গীতশিল্পী ফাহমিদা নবী।

“খালিদের এই মৃত্যু, সাদি ভাইয়ের এই চলে যাওয়া … পর পর শিল্পীদের … আমরা নিজেরাই শিল্পীদের জন্য শিল্পীরা এখন আতংকে আছি। আমি খালিদের মৃত্যুতে এখানে এসে আমার শিল্পী ভাইবোনদেরকে বলতে চাই, যারা সিনিয়র-জুনিয়র সবাইকে বলতে চাই, নিজের টেক কেয়ার করো। নিজেকে একটু ভালোবাসো।”

“সবকিছুর জন্য দুঃখবোধ করো না।ভালো থাকো। কাজ করে যাও। আনন্দে থাকো যেটুকু পারো। জীবনটা তো অল্প সময়ের; এই অল্প সময়টাকে সুন্দর করে নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো।”

মায়ের সঙ্গে খালিদ। ছবি: প্রয়াত গায়কের ফেইসবুক পেইজ থেকে নেওয়া

শেষের কথা

প্রয়াত শিল্পী খালিদ যুক্তরাষ্ট্রে আসা যাওয়ার মধ্যেই ছিলেন। দুই-আড়াই বছর আগে ফিরে এসে কিছুদিন থেকেছেন নিজ জন্মস্থান গোপালগঞ্জে। বাল্যকালের বন্ধুবান্ধবসহ এলাকার অনুজদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েই সময় কাটতো তার।

প্রয়াত এই শিল্পী এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, গানের সঙ্গে তার সখ্য মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে।

তিনি তখন ছিলেন প্রথম শ্রেণির ছাত্র। সাত ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট খালিদ। বাড়িতে ওস্তাদের কাছে বড় ভাই বোনরা গান শিখলেও তাকে কাছে ভিড়তে দেওয়া হতো না। একদিন সবার অলক্ষ্যে হারমোনিয়াম চাপতে গিয়ে দেখেন দারুণ শব্দ হয়। তারপরই গান শেখার জন্য জেদ ধরেন খালিদ।

১৯৮১ সাল থেকে গান শুরু করলেও এর দুই বছর পর ১৯৮৩ সালে চাইম ব্যান্ডের সঙ্গেই খালিদের দুর্দান্ত অভিযাত্রা শুরু হয়।

ঢাকায় ক্যাসেটের যুগে শিল্পীদের মিক্সড অ্যালবাম বের হতো। খালিদকে তখন মিক্সড মাস্টার বলা হতো।

তারকা শিল্পীদের নিয়ে বার হওয়া ক্যাসেটে খালিদের গান কোনো না কোনো ভাবে হিট করতোই করতো।

সবশেষ বছর দুই-তিনেক আগে সাউন্ডটেকের ব্যানারে ‘তুই বুঝলি না’ শিরোনামের একটি  গান করেন খালিদ।

প্রয়াত শিল্পী খালিদের ছেলে জুহাইফা আরিক ও স্ত্রী শামীমা জামান থাকেন নিউ ইয়র্কে। সেখানে তার ছেলে স্কুলে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেওয়ার ব্যাপারে খালিদের ইচ্ছা ছিল; যদিও তা আর হলো না শেষ পর্যন্ত।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত