Beta
সোমবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
সোমবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৫

নিট পোশাকে বাজিমাত, মোট রপ্তানিতে হিস্যা ৪৪%

নিত্যপ্রয়োজনীয় পোশাকই আসলে নিট পোশাক।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পোশাকই আসলে নিট পোশাক।
[publishpress_authors_box]

রিয়াজ গার্মেন্টস দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির অন্যতম পথিকৃৎ। ১৯৭৮ সালের ২৮ জুলাই মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন ফ্রান্সে মাত্র ১০ হাজার শার্ট রপ্তানি করেন। কেনেন ফরাসি ক্রেতা হলান্ডার ফ্রঁস। ওই শার্টের চালানের দাম ছিল তখনকার ফরাসি মুদ্রায় মাত্র ১৩ মিলিয়ন ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় মাত্র ৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা। সেটিই ছিল বাংলাদেশ থেকে প্রথম তৈরি পোশাক রপ্তানি।

আর পেছনে তাকাতে হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর পাঁচ দশকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল শিল্প খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক। বর্তমানে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশের মতো এই খাত থেকেই আসে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয়।

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি করে ৩ হাজার ৬১৫ কোটি ১৩ লাখ (৩৬.১৫ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে এ খাতের রপ্তানিকারকরা। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। দুই হাজারের বেশি কারখানা এখন সরাসরি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। আর এই খাতে কাজ করেন প্রায় ৪০ লাখ কর্মী।

এই তৈরি পোশাক শিল্পের দুটি উপখাত হচ্ছে ওভেন ও নিট। পোশাক রপ্তানি শুরু হওয়ার পর থেকেই ওভেন পোশাক রপ্তানি থেকে বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসত। বেশ কয়েক বছর রপ্তানি বাণিজ্যে এই দুই খাতের অবদান ছিল কাছাকাছি। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে ওভেনকে পেছনে ফেলে ওপরে উঠে আসে নিট খাত। এখনও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে।

দিন যত যাচ্ছে, রপ্তানি আয়ে ওভেনের চেয়ে কম দামি নিট পোশাকের অবদান ততই বাড়ছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি থেকে মোট ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ওভেন পোশাক থেকে এসেছিল ১৪ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার। আর নিট পোশাক থেকে এসেছিল ১৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার।

২০২০-২১ অর্থবছরে পাল্টে যায় চিত্র; নিট থেকে আসে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার। আর ওভেন থেকে আসে ১৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার।

২০২১-২২ অর্থবছরে ওভেন থেকে আসে ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার; নিট থেকে আসে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বেশি ২৩ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার।

২০২২-২৩ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি থেকে আসে মোট ৪৭ বিলিয়ন ডলার। তার মধ্যে নিট থেকে আসে ২৫ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার; ওভেন থেকে আসে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার কম, ২১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি থেকে আসে মোট ৩৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। তার মধ্যে নিট থেকে আসে ১৯ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার; ওভেন থেকে আসে ১৬ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও সেই একই ধারা অব্যাহত রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ইপিবি রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি থেকে মোট ২ হাজার ৪৫৩ কোটি ৩৫ লাখ (২৪.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি।

এর মধ্যে তৈরি পোশাক থেকে এসেছে ১৯ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ২৮ শতাংশ।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই ছয় মাসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।

এর মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১০ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক শূন্য এক শতাংশ।

হিসাব বলছে, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ মোট যে আয় করেছে, তার ৪৪ দশমিক ১৭ শতাংশই এসেছে নিট পোশাক থেকে।

অন্যদিকে ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ৯ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ।

হিসাব বলছে, এই ছয় মাসে তৈরি পোশাক থেকে যে আয় হয়েছে, তার ৫৪ দশমিক ৫০ শতাংশই এসেছে নিট পোশাক থেকে; ওভেনের চেয়ে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার বেশি আয় দেশে এসেছে।

সবশেষ ডিসেম্বর মাসে পোশাক রপ্তানি থেকে ৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে, যা গত বছরের ডিসেম্বরের চেয়ে ১৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি।

এই মাসে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে ১ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের ডিসেম্বরের চেয়ে এই ডিসেম্বরে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি আয় দেশে এসেছে।

অন্যদিকে ওভেন পোশাক থেকে ডিসেম্বর মাসে আয় হয়েছে ১ দমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার; বেড়েছে ১৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। 

এই তথ্যই বলছে, নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) রপ্তানি আয়ে যে উল্লম্ফন হয়েছে, তাতে নিট পোশাক তথা কম দামি পোশাকের বড় অবদান ছিল।

নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গত তিন-চার বছর ধরেই ওভেনের চেয়ে নিট থেকে বেশি রপ্তানি আয় দেশে আসছে। নানা সমস্যার মধ্যেও প্রবৃদ্ধির ধারা ধরে রেখেছি। দুই বছরের করোনা মহামারির মধ্যেও দেশের রপ্তানি আয়ের যে উল্লম্ফন হয়েছিল, তা কিন্তু নিট পোশাকের ওপর ভর করেই হয়েছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা পণ্য রপ্তানি পড়েছিল। কিন্তু নিট পোশাকের রপ্তানি কমেনি; উল্টো বেড়েছে।

“মানুষ যত সমস্যাই থাকুক, যত অর্থ সংকটেই থাকুক না কেন, অতি প্রয়োজনীয় কাপড় কিনতেই হয়। সে কারণে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় বাড়ছে।”

“যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সে কারণে ওই সব দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়েছিল। তারা তখন খাদ্য ও অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছিল” বলেন হাতেম।

তিনি বলেন, “নিট পোশাক যেহেতু অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য, তাই তারা বাধ্য হয়ে এগুলো কিনেছে। সে কারণে এই খাত থেকে আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল।

“সুসংবাদ হচ্ছে, আমাদের পোশাকের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ অন্য দেশে মূল্যস্ফীতি কমে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মানুষ আগের মতোই পোশাকসহ অন্য পণ্য কিনছে। তার প্রভাব পড়েছে নিট পণ্য রপ্তানিতে।”

ওভেন পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি ও এভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একটার পর একটা ধাক্কার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের আগে ও পরে সহিংসতা, শ্রমিক অসন্তোষও আমাদের পোশাক খাতের অনেক ক্ষতি হয়েছে।

“এতো বাধা-বিপত্তির মধ্যেও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বেশ ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এটা খুবই ভালো দিক। করোনা মহামারি ও যুদ্ধের ধাক্কা সব দেশের অর্থনীতিতেই পড়েছিল। ওই কঠিন সময়ে কম দামি পোশাক বেশি রপ্তানি করেছি আমরা। বায়াররা অতি প্রয়োজনীয় পোশাক কিনেছেন। সে কারণে নিট পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে।”

“এখন অবশ্য ওভেনও ভালো রপ্তানি হচ্ছে। তবে অনিশ্চতা ও অস্থিরতা আছে। দেশে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক আছে। এ অবস্থায় আগামী দিনগুলো কী হবে—তা খুব চিন্তার মধ্যে আছি আমরা।”

নিত্যপ্রয়োজনীয় পোশাকই আসলে নিট পোশাক। সাধারণ কথায় গেঞ্জির কাপড়ের তৈরি পোশাকই নিট। যেমন টি-শার্ট, পলো শার্ট, সোয়েটার, ট্রাউজার, জগার, শর্টস প্রভৃতি।

ঘরোয়া পরিবেশে সাধারণত টি-শার্ট, পলো শার্ট, শ্যান্ডো গেঞ্জি, ট্রাউজার জাতীয় পোশাক বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। আরামদায়ক হওয়ায় সারাবিশ্বেই রয়েছে এ ধরনের পোশাকের জনপ্রিয়তা।

অন্যদিকে শার্ট, প্যান্ট, স্যুট-ব্লেজার জাতীয় ফরমাল পোশাক হচ্ছে ওভেন ক্যাটারির পণ্য।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত