ভারতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদক প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ারের বকেয়া পরিশোধে এলসি বা ঋণপত্র নিষ্পত্তির অনুমোদন পেয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। চলতি সপ্তাহেই এই পাওনা পরিশোধ করা হবে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিপরীতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পক্ষে এলসি নিষ্পত্তি করবে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট থাকায় এই পাওনা পরিশোধ করতে কৃষি ব্যাংককে বেছে নেওয়া হয়।
গত বৃহষ্পতিবার (৩১ অক্টোবর) আদানির পাওনা পরিশোধে এলসি নিষ্পত্তির জন্য কৃষি ব্যাংককে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন কৃষি ব্যাংকের এমডি সঞ্চিয়া বিনতে আলী। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কৃষি ব্যাংকের কাছে গচ্ছিত ডলার দিয়ে এই এলসি নিষ্পত্তি হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত অনুমোদন দিয়েছে। আশা করছি, দ্রুত এলসি নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।
কৃষি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক খান ইকবাল হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আদানির পাওনা পরিশোধের প্রক্রিয়া চলছে। বিপিডিবি থেকে পাওনা টাকা আমাদের সরবরাহ করা হলে আমরা এর বিপরীতে সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আদানি পাওয়ারের ব্যাংক হিসাবে রেমিট করব। এর জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন ইতোমধ্যে আমরা পেয়েছি।”
এদিকে সোমবার বিবিসি প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, সরকারের দুজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাদের জানিয়েছেন, আদানির বকেয়া আংশিক পরিশোধের ব্যাপারে তারা এরমধ্যেই প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। যদিও ওই দুই কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করেনি বিবিসি।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, “আমরা এরমধ্যেই আদানি গ্রুপ বরাবর ১৭ কোটি ডলারের এলসি ইস্যু করেছি।”
বকেয়া ৮৫ কোটি ডলার পরিশোধ না করা হলে আগামী ৭ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে আদানি পাওয়ার হুমকি দিয়েছিল বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে এসেছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ বাবদ বকেয়া পরিশোধের জন্য বাংলাদেশকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে আদানি গ্রুপ।
তবে এরপরই আদানি পাওয়ার থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, তারা এমন কোনও আলটিমেটাম দেয়নি।
আলটিমেটাম প্রসঙ্গে আদানি গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনও সাড়া দেননি বলে জানানো হয় ওই বিবিসির প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে এই পাওনা নিয়মিতভাবে পরিশোধ করবে। পাশাপাশি এই সংকট খুব দ্রুত সমাধান হওয়ারও প্রত্যাশা করেন তারা।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের তরফে শক্ত প্রতিক্রিয়া জানানো হলে সুর নরম করে আদানি গ্রুপ। পাশাপাশি বিদ্যুৎ বাবদ পাওনা পরিশোধের জন্য বাংলাদেশকে সময় বেঁধে দেওয়ার আলটিমেটামের বিষয়টি অস্বীকার করে আদানি গ্রুপ। তারা জানায়, ৮৫ কোটি ডলার বকেয়ার পুরোটা তারা ৭ নভেম্বরের মধ্যে চাননি।
গত রবিবার (৩ নভেম্বর) এ-সংক্রান্ত বিবৃতিতে আদানি গ্রুপ জানায়, আদানি সাত দিনের মধ্যে ৮৫ কোটি ডলারের পুরো পেমেন্ট দাবি করেনি। বিষয়টির সমাধানে আদানি বাংলাদেশের বিপিডিবির সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৩১ অক্টোবর বকেয়া পরিশোধের নির্ধারিত সময়সীমা পার হওয়ার পর বিপিডিবি কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ১৭ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিপিডিবি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে উল্লিখিত এ শর্ত পূরণ করেনি বলে অভিযোগ করেছে আদানি পাওয়ার।
এর প্রতিক্রিয়ায় আদানি পাওয়ারের ঝাড়খন্ডের বিদ্যুৎকেন্দ্র ৩১ অক্টোবর থেকে তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এতে বাংলাদেশে বিদ্যুতের ঘাটতি বেড়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঝাড়খন্ডে আদানির গোড্ডা প্ল্যান্টে গত শুক্রবার উৎপাদিত ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুতের মধ্যে বাংলাদেশে মাত্র ৭২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। ওই প্ল্যান্টটি বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ সরবরাহক। এছাড়া পায়রা, রামপাল ও এসএস পাওয়ার ওয়ানসহ অন্যান্য বড় কারখানাগুলোতেও জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে।
তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্তের কারণে বাণিজ্যিক সফলতা নিয়েও শঙ্কায় পড়েছে আদানি পাওয়ারের ঝাড়খণ্ডের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। কারণ, ওই কেন্দ্রের একমাত্র ক্রেতা বাংলাদেশ। কেন্দ্রটির ৮০০ মেগাওয়াটের দুই ইউনিটের মধ্যে একটিকে অলস ফেলে রাখতে হচ্ছে। মাসে ৯-১০ কোটি ডলারের বিল হলে বছরে ১১০ কোটি আয় করার সুযোগ রয়েছে ওই কেন্দ্রটির।
ভারতের বেসরকারি সংস্থা ‘আদানি পাওয়ার’ ও আরও কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ সংস্থার বাংলাদেশের কাছে ইতিমধ্যে মোট বকেয়ার পরিমাণ ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই অর্থের কিছুটা অন্তত এখনই পরিশোধ না করা গেলে দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ আরও বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ চরম আর্থিক সংকটে ভুগছে। টান পড়েছে দেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভেও। এই বকেয়া পরিশোধ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে খুব দ্রুতই অর্থের সংস্থান করতে হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ খাতের সংকট মেটানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে বিশ্ব ব্যাংক তাদের ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে বলে সরকার আশ্বাস পেয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এই অর্থ হাতে পেলে পাওনাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি হয়তো অনেকটাই মেটানো সম্ভব হবে। তবে এই ঋণের টাকা কখন সরকারের হাতে আসতে পারে বা এটা দিয়ে পাওনাদারদের কাকে কতটা কী মেটানো হবে, তা নিয়ে কিছুই জানানো হয়নি।
দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানি সংক্রান্ত চুক্তি করা হয়। কয়লাভিত্তিক আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার। এতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ২৫ বছর ধরে কিনবে বাংলাদেশ।
বিদ্যুৎ বিভাগের নির্দেশনায় আদানির সঙ্গে তাড়াহুড়া করে ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি হয়। ওই সময় দেশে আমদানি করা কয়লানির্ভর কোনও বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়নি। তাই কয়লার দামের বিষয়টি নিয়ে তখন পিডিবি ভালো করে যাচাই-বাছাই করতে পারেনি। আদানির নিজস্ব কয়লাখনি ও ভারতে বড় একাধিক কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অভিজ্ঞতার ওপর ভরসা করতে হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রভাব কাজে লাগিয়ে বিপিডিবির অনভিজ্ঞতার সুযোগটা নিয়েছে আদানি। পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসার পর কয়লার দামের বিষয়টি পিডিবির নজরে আসে।
আদানির ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিলে। দ্বিতীয় ইউনিটে শুরু হয় একই বছরের জুনে। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে বিপিডিবির সঙ্গে বৈঠক করে কয়লার দামের বিষয়টি সুরাহা করেছিল আদানির প্রতিনিধিদল। এর পরিপ্রেক্ষিতে এক বছরের জন্য কয়লার প্রকৃত দামে বিল করেছে তারা। গত জুলাই থেকে চুক্তি অনুসারে কয়লার বিল করছে আদানি।
তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটলে ভারতের আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। আদানির সঙ্গে চুক্তিটি যতই বিতর্কিত হোক—এই মুহূর্তে আশু সংকট মেটাতে তাদের সঙ্গে সমঝোতায় আসার বিষয়েও গুরুত্ব দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।