ভারতের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি-অজিত পাওয়ার) নেতা বাবা সিদ্দিকি গুলি করে হত্যার ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোইয়ের লোক বলে সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে। তবে ওই গ্যাংও এ ঘটনার দায় স্বীকার করা করেনি।
ভারতের গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, শনিবার সন্ধ্যায় মুম্বাইয়ের বান্দ্রায় দশেরার বাজি ফোটানোর সময় ৬৬ বছর বয়সী বাবা সিদ্দিকিকে তার ছেলের অফিসের বাইরে একাধিকবার বুকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
বাবা সিদ্দিকিকে মোট ছয়টি গুলি ছোড়া হয়, যার মধ্যে চারটিই তার বুকে লাগে। এরপর তাকে নিয়ে ভর্তি করা হয় মুম্বইয়ের লীলাবতী হাসপাতালে।
লীলাবতী হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. জলিল পারকার সাংবাদিকদের বলেন, “রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাবা সিদ্দিকিকে এখানে নিয়ে আসা হয়। যখন তাকে ইমার্জেন্সি রুমে নেওয়া হয়, তখন তার নাড়ি বা রক্তচাপের কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। ইসিজিতেও তাই। আমরা তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করি।
“তার বুকে গুলি ঢুকেছিল। রাত ১১টা ২৭ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।”
ঘটনা তদন্তে মুম্বাই পুলিশ চারটি বিশেষ দল গঠন করেছে। প্রাথমিক তদন্তের পর তারা বলছে, ভাড়াটে খুনি দিয়ে বাবা সিদ্দিকিকে হত্যা করা হয়েছে।
মুম্বাই পুলিশ জানায়, হত্যাকাণ্ডে তিন বন্দুকধারী জড়িত ছিল। তিনজনের মধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে- গুরমাইল বালজিৎ সিং (২৩), তার বাড়ি হরিয়ানায় এবং ধর্মরাজ কাশ্যপ (১৯) তার বাড়ি উত্তরপ্রদেশে। তৃতীয় জন শিব কুমার গৌতম বলে চিহ্নিত হয়েছে, সে পলাতক; তার বাড়িও উত্তরপ্রদেশে।
তবে চতুর্থ কোনও ব্যক্তি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে, তাকেও খোঁজা হচ্ছে বলে জানায় পুলিশ।
কী কারণে খুন হতে হলো মহারাষ্ট্রের সাবেক এই মন্ত্রীকে, তদন্তে নেমে তার সম্ভাব্য সব দিক খতিয়ে দেখছে মুম্বাই পুলিশ।
মুম্বাই পুলিশের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ভাড়াটে খুনির তত্ত্ব, ব্যবসায়িক শত্রুতা, না কি বস্তি পুনর্বাসন প্রকল্প—খুনের নেপথ্যের প্রতিটি প্রশ্নকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখছে পুলিশ।
নিজেকে বিষ্ণোইয়ের দলের সদস্য বলে দাবি করে এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন এক সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারী, যা এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এর সত্যতা যাচাই করতে পারেনি মুম্বাই পুলিশ। আর এই গ্যাংও দায় স্বীকার করেনি।
মহারাষ্ট্রের ভোটের আগে বান্দ্রা পশ্চিমের তিনবারের এই বিধায়ককে হত্যাকাণ্ডের পর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
বাবা সিদ্দিকির ছেলে জিশান সিদ্দিকি বান্দ্রা পূর্বের বিধায়ক। বাবা সিদ্দিকি যে তার ছেলের অফিসের ওখানে অবস্থান করছে, এই তথ্য দুর্বৃত্তরা আগে কীভাবে জানতে পারল—তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
হত্যাকাণ্ডের আগে খুনিরা ঘটনাস্থলটি এক মাস ধরে রেকি করেছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে মুম্বাই পুলিশের অপরাধ শাখাকে জানিয়েছে গ্রেপ্তার হওয়া দুজন।
পুলিশের এই শাখা বলছে, হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিনজন বৃহস্পতিবার রাতে অটোরিকশায় করে সেখানে পৌঁছায় এবং গুলি চালানোর আগে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে।
সন্দেহভাজনরা কয়েক মাস ধরে সিদ্দিকের ওপর নজরদারি করছিল, তার বাসভবন ও অফিসে অনুসন্ধান চালাচ্ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। তারা বলছে, খুনিদের প্রত্যেককে জন্য আগাম ৫০ হাজার রুপি করে দেওয়া হয়েছিল। আর হত্যার মাত্র কয়েক দিন আগে তাদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিষ্ণোই গ্যাং জড়িত, নাকি বস্তি পুনর্বাসন কিংবা রাজনীতি সম্পর্কিত কিছু—তা তদন্ত করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
মুম্বাইয়ে বস্তি পুনর্বাসন প্রকল্পে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল; সেই মামলার তদন্ত চালাচ্ছে ভারতের অর্থনৈতিক গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। মামলায় নাম জড়িয়েছিল সিদ্দিকিরও।
২০০০-২০০৪ সাল পর্যন্ত মহারাষ্ট্রের আবাসন ও নগরোন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন বাবা সিদ্দিকি। সেই সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে একটি সংস্থাকে বস্তি পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে।
মামলার তদন্তে ২০১৮ সালে সিদ্দিকির ৪৬২ কোটি টাকার সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করেছিল ইডি।
চলতি বছরেই কংগ্রেস ছেড়ে অজিত পওয়ারের এনসিপিতে যোগ দিয়েছিলেন সিদ্দিকি। ওয়াই ক্যাটেগরির কেন্দ্রীয় নিরাপত্তাও পেতেন। তারপরও কীভাবে এই ঘটনা ঘটে গেল, তা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
বিশেষ করে সামনেই মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। তার ঠিক আগেই সিদ্দিকির খুনের ঘটনায় রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ঘটনায় এখনও পর্যন্ত যে দু’জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, তারা কেউই মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা নন। এক জনের বাড়ি হরিয়ানায়। অন্য জন উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা।
ফলে আঞ্চলিক রাজনৈতিক সমীকরণের কোনও কিছু এই হত্যাকাণ্ডের যুক্ত কি না—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বলিউডের একাধিক তারকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন সিদ্দিক। জাঁকজমকপূর্ণ পার্টি আয়োজনের জন্য তার সুনাম ছিল। অতীতে তার আয়োজিত ইফতার পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন শাহরুখ খান, সালমান খান ও সঞ্জয় দত্তের মতো বড় তারকারা।
২০১৩ সালে সিদ্দিকির পার্টিতেই ‘মানভঞ্জন’ হয় শাহরুখ খান ও সালমন খানের। দুই খানকে দু’পাশে নিয়ে তোলা তার সেই ছবি স্মরণীয় হয়ে আছে বলে মনে করেন অনেকেই।
বলিউড তারকা সালমান খানের সঙ্গে বাবা সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠতার কারণে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সম্পৃক্ততা নিয়ে সন্দেহ করা হচ্ছে। এর আগে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের কাছ থেকে হুমকি পেয়েছিলেন সালমানও।
নিহতের ঘনিষ্ঠ সূত্রে বরাত দিয়ে গণমাধ্যম বলছে, ১৫ দিন আগে তাকে (বাবা সিদ্দিকি) হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তাকে ‘ওয়াই’ ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল। তবে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের কোনও হুমকির কথা তিনি পুলিশকে বলেননি।
বাবা সিদ্দিকি হত্যা মামলায় দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলো মুম্বাই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। গুজরাট ও দিল্লির পুলিশ এই মামলা তদন্ত করছে।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, সিদ্দিকি খুনের মামলার তদন্তে নামছে দিল্লি পুলিশও। মুম্বাইয়ে পুলিশের তদন্তকারী দলকে সাহায্যের জন্য দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলের একটি দলকে পাঠানো হচ্ছে মহারাষ্ট্রে। ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে ফরেন্সিক দল। পার্শ্ববর্তী এলাকার সিসিটিভি ফুটেজও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পুলিশের সন্দেহ, হামলার ঘটনায় একটি ৯.৯ এমএম পিস্তল ব্যবহার করা হয়েছিল। সেটি ইতিমধ্যে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আততায়ীরা চার-পাঁচ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল বলে দাবি পুলিশের।
এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, হামলার ঘটনার সময় দুর্গাপূজোর বিসর্জনের শোভাযাত্রা চলছিল। বাজি ফাটছিল চারদিকে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই সিদ্দিকিকে গুলি করেন আততায়ীরা। বাজি ফাটার শব্দের মাঝে গুলির শব্দ কেউ টের পাননি।
গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোই কয়েক ডজন মামলা মাথায় নিয়ে বর্তমানে গুজরাটের একটি কারাগারে বন্দি আছেন। তবে তার চক্র মুক্তিপণের জন্য ব্যবসায়ীদের ফোন কল দিয়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে।
১৯৯৮ সালের ২ কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা মামলা থেকে সালমান রেহাই পেলেও লরেন্স বিষ্ণোইয়ের ‘নিশানার তালিকায়’ তিনি রয়েছেন। কারণ, বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষ কৃষ্ণসার বা চিংকার হরিণকে পবিত্র বলে মনে করে, বলতে গেলে তারা পূজা করে।
পুলিশ বলছে, বিষ্ণোই চক্রে ৭০০ জনেরও বেশি ‘শুটার’ রয়েছে, যারা ভারতজুড়ে ছোট-বড় অপরাধী হিসেবে কাজ করে।
সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনায় বিষ্ণোই চক্রের যোগ পেয়েছে পুলিশ, যার মধ্যে র্যাপার সিধু মুসেওয়ালা এবং দিল্লির একটি জিম মালিকের হত্যাকাণ্ড আছে, যিনি আফগান বংশোদ্ভূত ছিলেন।
বান্দ্রার নেতা সিদ্দিকি ১৯৯৯ সালে প্রথম বিধানসভা ভোটে জয়ী হন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিন বার ভোটে জিতলেও ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের বিধানসভা ভোটে বান্দ্রা পশ্চিম কেন্দ্র থেকে তিনি হেরে যান।
সত্তরের দশকে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন থেকে মূল স্রোতের রাজনীতিতে আসা বাবা সিদ্দিকি গত ফেব্রুয়ারিতে কংগ্রেসের সঙ্গে পাঁচ দশকের সম্পর্ক ত্যাগ করে অজিত পাওয়ারের এনসিপিতে যোগ দেন।
সিদ্দিকি খুনের পর মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী অজিত পাওয়ার পুলিশকে কড়া পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছেন। মুম্বাই শহরে যাতে কোনও দুষ্কৃতিকারীরা ফের মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে, তা নিশ্চিত করার কথা বলেছেন তিনি।
নব্বইয়ের দশকের পর থেকে মুম্বইয়ে এমন বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা খুন হননি। ওই দশকের শুরুর দিকে বিজেপির তৎকালীন দুই বিধায়ক রামদাস নায়েক এবং প্রেমকুমার শর্মাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। শিবসেনার দুই নেতা বিঠ্ঠল চহ্বান এবং রমেশ মোরে ওই সময়ই খুন হন।
সিদ্দিকির হত্যার ঘটনায় কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে ‘শোক ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন।
এক্সে তিনি লিখেছেন, “মহারাষ্ট্রের সাবেক মন্ত্রী বাবা সিদ্দিকের মর্মান্তিক মৃত্যুতে শোক ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। শোকের এই সময়ে, আমি তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং ঘনিষ্ঠদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান মহারাষ্ট্র সরকারকে অবশ্যই দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে।”
লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধীও একই রকম অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। এক্সে তিনি লিখেছেন, “বাবা সিদ্দিকি জির মর্মান্তিক মৃত্যু মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক। আমি এই কঠিন সময়ে তার পরিবারের সাথে সমব্যাথী। এই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি তুলে ধরেছে মহারাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলার পুরো পতনদশাকে। সরকারকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে এবং ন্যায়বিচার করতে হবে।”
তথ্যসূত্র : এনডিটিভি, আনন্দবাজার, হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়া ডটকম