চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রক্রিয়া সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি।
কমিটি মনে করছে, আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ড ঘিরে মামলা বাণিজ্য ও হয়রানি চলছে। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে বিচারহীনতার যে নজির সৃষ্টি হয়েছিল, আলিফ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে তারই পুনরাবৃত্তি চলছে।
রবিবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান ঠেকাতে গঠিত এ প্লাটফর্ম।
জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘চট্টগ্রামে আইনজীবী আলিফ হত্যাকাণ্ড পরবর্তী পরিস্থিতি সরেজমিনে পরিদর্শন : পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাব’ শীর্ষক এ সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কমিটির সদস্য সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে আন্দোলনে দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ‘ফ্যাসিস্ট’ তকমা নিয়ে গত ৫ আগস্ট বিদায় নেয়।
২৩ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিরোধী যেকোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ও জানিয়েছে এই প্ল্যাটফর্ম।
হিন্দু ধর্মীয় নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গত ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের আদালতে হাজির করার পর তার অনুসারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে প্রাণ হারান তরুণ আইনজীবী আলিফ। ওই মামলার পরবর্তী শুনানির দিন রয়েছে আগামী ২ জানুয়ারি।
সেদিনের মারামারি, ভাঙচুর, আইনজীবী আলিফ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয়টি মামলা হয়েছে। হত্যামামলায় ১০ জনসহ এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪০ জনকে। আলিফের বাবার করা ওই হত্যা মামলায় চিন্ময়ের নাম না থাকলেও আইনজীবীরা তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর দাবি জানিয়ে আসছে।
চট্টগ্রামের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গত ২৩ ডিসেম্বর গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির একটি প্রতিনিধিদল চট্টগ্রাম সফর করে। সেই পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাব তুলে ধরতে রবিবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করা হয় কমিটির পক্ষ থেকে।
লিখিত বক্তব্যে কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “মামলা দায়ের ও তদন্ত প্রক্রিয়া সঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়ায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। মামলাগুলোতে গণহারে আসামি করা ও তদন্ত পরিচালনা পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করে আমাদের মনে হয়নি যে, এই হত্যার সঠিক বিচারের প্রশ্নে এর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বিভাগ আন্তরিক।
“আমরা চট্টগ্রামে পরিদর্শন শেষে ঢাকায় ফেরার পরে স্থানীয় থানার একজন এসআই সেবকপল্লিতে গিয়ে হরিজনদের হুমকি দিয়ে এসেছেন এবং বলেছেন যে, তারা যদি প্রকৃত অপরাধীদের ধরিয়ে দেয় তবে যে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষজনও গ্রেপ্তার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
“এই হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকে মামলা দায়ের, তদন্ত কোনোটিই সঠিক পথে এগোচ্ছে না এবং এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পূর্বের মতোই সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। এছাড়া এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরও সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।”
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “হরিজনদের মধ্যে কেউ যদি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যদি সেটা তদন্তে প্রমাণিত হয়- তাহলে তাদের বিচার হতে হবে। কিন্তু যেভাবে গোটা সেবক কলোনিকেই হত্যাকারী হিসেবে দেখা হচ্ছে, সেবক কলোনি উচ্ছেদের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, কোর্ট বিল্ডিংয়ে চাকরিরত সেবকদের (হরিজনদের) ছাঁটাই করা হচ্ছে, সিটি কর্পোরেশনের বাইরে যারা বিভিন্ন ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তাদেরও একই অজুহাতে ছাঁটাই করা হচ্ছে- সেটা গোটা সম্প্রদায়কেই হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।”
এসময় গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির পক্ষ থেকে ৫ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আইনজীবী আলিফ হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে স্বার্থান্বেষীদের ফায়দা লুটতে দেওয়া চলবে না। কোর্ট প্রাঙ্গণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও ভাঙচুরের ঘটনার সঠিক তদন্ত করতে হবে। এই ঘটনায় উস্কানিদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে।
তিনি বলেন, হরিজনদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত করতে হবে। ঘটনার সময়ের সিসিটিভি ফুটেজগুলো পরীক্ষা করতে হবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। গণগ্রেপ্তার ও গ্রেপ্তার বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসসহ সব অভিযুক্ত ও আটক ব্যক্তির বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত ও তাদের আইনজীবীরা যাতে আদালতে জামিনের আবেদনসহ সব আইনি পদক্ষেপ নির্বিঘ্নে নিতে পারেন তা নিশ্চিতের প্রস্তাবও দিয়েছে কমিটি।
নতুন বাংলাদেশে সুষ্ঠু বিচার হতে হবে জানিয়ে কমিটির সদস্য আইনজীবী মানজুর আল মতিন বলেন, “শুধুমাত্র হরিজন হওয়ার কারণে বা ধর্মীয় পরিচয় এর কারণে কারও বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত নয়। সুষ্ঠু তদন্তের অনেক উপাদান রয়েছে। শহীদ আলিফের মৃত্যুকে যেন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার না হয়।”
সংবাদ সম্মেলনে আলিফ হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কি না—এমন প্রশ্নে কমিটির সদস্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ বা পরিস্থিতি তৈরির কিছু সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। অজ্ঞাতনামা আড়াই হাজার ব্যক্তির নামে মামলা দেওয়া হয়েছে, ব্যাপক একটা হয়রানি চলছে। পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্য, হয়রানি এখনও চলছে। এতে সাম্প্রদায়িক একটা দিকও আছে। এর পেছনে একটা গোষ্ঠী আছে।
“ভারত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অপপ্রচার চালাচ্ছে। এসব ঘটনা সেই অপপ্রচারকে শক্তিশালী করছে।”
চিন্ময়কে গ্রেপ্তারের পর ভারত সরকারের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া আসে। দেশটির হিন্দু সংগঠনগুলো বিক্ষোভেও নামে। তেমন এক বিক্ষোভ থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলাও হয়েছিল।
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি মনে করে, চট্টগ্রামে আইনজীবী আলিফ হত্যাকাণ্ড তদন্তে ঘটনস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ ব্যবহার না করায় তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আনু মুহাম্মদ বলেন, “সিসিটিভির ফুটেজ ব্যবহার না করে তদন্ত কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। ভারত বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানকে একটা ফ্রেমে বন্দি করতে চায়। আপনি যদি এসব ঘটনা ঘটান তাহলে ভারতকেই শক্তিশালী করা হবে।”
এসময় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসসহ সব অভিযুক্ত ও আটক ব্যক্তিদের বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিতের আহ্বান জানান গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি এই সদস্য।
সংবাদ সম্মেলনে কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রা বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্য বিলোপ করা। কিন্তু ৫ মাস পরে এসে দেখছি, শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অনেকেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
“বৈষম্যকে ব্যবহার করে নতুন করে নাগরিকদের অধিকার হরণ করা হোক তা চাই না। এখনও যারা বিচার পাচ্ছেন না তাদের বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করাই হবে নতুন বাংলাদেশের রাজনীতি।”
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক ডা. হারুন-অর-রশিদ ও বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত।
গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে ‘সনাতন জাগরণ মঞ্চ’ ব্যানারে সমাবেশ আয়োজনের পর ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’ গঠন করে তার মুখপাত্র হিসেবে সক্রিয় ছিলেন চিন্ময়।
সেদিন চট্টগ্রাম নগরীর নিউ মার্কেট মোড়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ওপরে ইসকনের গেরুয়া রঙের আরেকটি পতাকা ওড়ানোর অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে ৩০ অক্টোবর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন এক বিএনপি নেতা।
সেই মামলায় গত ২৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে চিন্ময়কে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন তাকে চট্টগ্রামে আদালতে হাজির করার পর বাধে গণ্ডগোল। এক পর্যায়ে আদালত এলাকা সংলগ্ন সেবক কলোনির কাছে কুপিয়ে হত্যা করা হয় আলিফকে।