হিন্দু ধর্মীয় নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর পক্ষে ঢাকা থেকে গিয়ে চট্টগ্রামের আদালতে দাঁড়ালেন আইনজীবী রবীন্দ্র ঘোষ। তবে তিনি জামিন শুনানির আবেদন করলেও বিচারক তা নাকচ করে দেওয়ায় চিন্ময়ের মুক্তির কোনও সুযোগ আপাতত ঘটছে না।
নিম্ন আদালতে বৃহস্পতিবার থেকে ছুটি শুরু হচ্ছে। অবকাশ শেষে আদালত খুলবে ২ জানুয়ারি। সেদিন জামিন শুনানির দিন আগে থেকেই নির্ধারিত আছে।
বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় ব্রহ্মচারী রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে গত ২৬ নভেম্বর থেকে কারাগারে রয়েছেন।
ওই দিন চট্টগ্রামের আদালতে চিন্ময়ের অনুসারী এবং পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হন। এরপর চট্টগ্রামে আইনজীবীদের বিক্ষোভ থেকে চিন্ময়ের পক্ষে কোনও আইনজীবীকে না দাঁড়ানোর হুমকি দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকেও সমিতির কোনও সদস্য চিন্ময়ের পক্ষে শুনানি করবেন না বলে জানানো হয়।
অন্যদিকে চিন্ময়ের পক্ষে যারা আইনজীবী ছিলেন, তারাও একাধিক মামলার আসামি হয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে আদালতমুখো হচ্ছে না।
ফলে ৩ ডিসেম্বর আদালতে চিন্ময়ের জামিন আবেদনের শুনানির দিন কোনও আইনজীবী না থাকায় ২ জানুয়ারি শুনানির দিন ঠিক করে দেয় চট্টগ্রামের জজ আদালত।
চিন্ময়কে গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়ে পাল্টাপাল্টি ক্ষোভ-বিক্ষোভ এবং ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে গত শনিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, কেউ যাতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এরপর মঙ্গলবার চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, চিন্ময়ের পক্ষে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির বাইরে কেউ আদালতে দাঁড়াতে চাইলে তাতে কোনও বাধা নেই।
চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির ঘোষণার পর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, বাংলাদেশ মাইনরিটি ওয়াচের সভাপতি রবীন্দ্র ঘোষ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যান।
বুধবার তিনটি বিষয় ধরে শুনানির আবেদন করেন তিনি। একটি হচ্ছে, চিন্ময় ব্রহ্মচারীর মামলার শুনানি, আরেকটি আদালতে তার পক্ষে নথি উপস্থাপন এবং অন্যটি জামিন শুনানির নির্ধারিত তারিখ ২ জানুয়ারি থেকে এগিয়ে আনা।
কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ সাইফুল ইসলাম যাচাই করে আবেদনগুলো নাকচ করে দেন।
আদালতে যা হলো
চিন্ময়ের পক্ষে ঢাকা থেকে আইনজীবী আসার খবরে চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে বুধবার সকাল থেকেই ছিল কড়া নিরাপত্তা। আদালতের প্রবেশমুখ থেকে শুরু করে আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ছিল পাহারায়। চিন্ময়ের আইনজীবী আবেদন উপস্থাপনের আগেই এজলাস ছিল পরিপূর্ণ।
সকাল ১১টায় আদালতের কার্যক্রমের শুরুতেই রবীন্দ্র ঘোষ আদালতকে বলেন, “আমি জানি এই বারের একজন আইনজীবী (সাইফুল ইসলাম আলিফ) মারা গেছেন।”
এটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত আইনজীবীরা ‘শহীদ’ না বলায় এজলাসে দাঁড়িয়ে একসাথে প্রতিবাদ করেন। তখন এজলাসে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
এরপর আদালত রবীন্দ্র ঘোষের কাছে জানতে চান, তার পক্ষে চট্টগ্রাম বারের কোনও আইনজীবীর ওকালতনামা আছে কি না কিংবা মামলা পরিচালনার জন্য আসামিপক্ষের আইনজীবীদের অনুমতি আছে কি না?
এসময় তিনি নেই বলে জানালে আদালত আইনি প্রক্রিয়া ‘মেইনটেইন’ করে তাকে আসতে বলেন।
চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের এপিপি মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “আদালতের যুক্তি হচ্ছে, চিন্ময় কৃঞ্চ দাসের পক্ষে ওকালতনামা নেই। ফাইলিং আইনজীবী অর্থাৎ চট্টগ্রাম আদালতে চিন্ময় কৃঞ্চের পক্ষে আগে যে আইনজীবী ছিলেন, তার পক্ষ থেকে রবীন্দ্র ঘোষের পক্ষে লিখিত অনুমতি নেই। এই বিবেচনায় তিনি ‘নট মেনশেনেবল’ বলে সেটি খারিজ করেন।”
তিনি জানান, চিন্ময়ের পক্ষে আইনি লড়াই চালাতে হলে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য এমন কারও ওকালতনামা লাগবে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী রবীন্দ্র ঘোষ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী। চট্টগ্রামে অনুমতির তো প্রয়োজন পড়ে না।
“আর কার কাছ থেকে আমি ওকালতনামা চাইব। তাদের সবার বিরুদ্ধে তো মামলা হয়েছে। চট্টগ্রামে আসার কারণে আমিই যে মামলার আসামি হব না, তার তো নিশ্চয়তা নেই।”
শুনানির বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি আদালতে পুরো বিষয়টি খুলে বলেছি। জজ সাহেব শুনেছেন কিন্তু হট্টগোলের কারণে তিনি বিরক্ত হয়ে উঠে গেলেন। আর আবেদন নাকচ করলেন।”
চট্টগ্রামে এসে নিজেও আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়ে রবীন্দ্র ঘোষ বলেন, “আমি মুক্তিযোদ্ধা, বয়স ৭৫ এর কাছাকাছি। চট্টগ্রামে এতগুলো আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, ভয়ে কেউই আসতে পারছেন না।
“আমি সাহস করে এসেছি, কিন্তু অনেক তরুণ আইনজীবীর কাছ থেকে কিল-ঘুষি খেয়েছি। এটা আমি অন্তত আশা করিনি। আমি এবিষয়ে জিডি করব। আইনি পদক্ষেপ নেব।”
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় ব্রহ্মচারী এক সময় ইসকনের মুখপাত্র ছিলেন। মামলার আসামি হওয়ার পর তাকে বহিষ্কারের কথা জানায় কৃষ্ণভক্ত হিন্দুদের সংগঠনটি।
চিন্ময় আলোচনায় উঠে আসেন গত অগাস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর হিন্দুদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সক্রিয় হয়ে।
গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে ‘সনাতন জাগরণ মঞ্চ’ ব্যানারে সমাবেশ আয়োজনের পর ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’ গঠন করে তার মুখপাত্র হিসাবে সক্রিয় ছিলেন চিন্ময়।
এদিকে ২৫ অক্টোবরের সেই সমাবেশের দিন চট্টগ্রাম নগরীর নিউ মার্কেট মোড়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ওপরে ইসকনের গেরুয়া রঙের আরেকটি পতাকা ওড়ানোর অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন বিএনপির স্থানীয় এক নেতা।
সেই মামলায় গত ২৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে চিন্ময়কে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন তাকে চট্টগ্রামে আদালতে হাজির করার পর বাধে গণ্ডগোল।
সেদিন মারামারি, ভাংচুর, আইনজীবী আলিফ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মোট পাঁচটি মামলা হয়েছে। হত্যার ঘটনায় আলিফের বাবা যে মামলা করেছেন, তার এজাহারে চিন্ময়ের নাম না থাকলেও আইনজীবীরা এই মামলায়ও তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর দাবি জানিয়ে আসছে।
চিন্ময়কে গ্রেপ্তারের পর ভারত সরকারের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া আসে। দেশটির হিন্দু সংগঠনগুলো বিক্ষোভেও নামে। তেমন এক বিক্ষোভ থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলাও হয়েছিল।