Beta
সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪
Beta
সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

গ্রামে লোড শেডিং চরমে  

গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে লোড শেডিংয়ের পরিমাণ অনেক বেশি।
গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে লোড শেডিংয়ের পরিমাণ অনেক বেশি।
Picture of আসিফ সিদ্দিকী

আসিফ সিদ্দিকী

দেশে গরম বাড়ার সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদন সেই হারে বাড়ছে না, সেই ঘাটতি লোড শেডিং দিয়ে সামাল দেওয়া হচ্ছে। তবে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের মানুষ এতে ভুগছে বেশি। গত মঙ্গলবার (২৫ জুন) প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোড শেডিংয়ের কবলে পড়েন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ৩ কোটি ৬০ লাখ গ্রাহক। এই লোড শেডিং জুন মাসে সর্বোচ্চ। এটি চলতি বছরেও সর্বোচ্চ।

দেশের এই বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছে, গ্যাস সংকটে গ্যাসভিত্তিক কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ রয়েছে। আর বড় কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতেও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। 

পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের হিসাবে, ২৫ জুন সারাদেশে ৯ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ১৯৬ মেগাওয়াট। সে হিসাবে ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৪৭০ মেগাওয়াট। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের পরিমাণ ছিল ৭৪.৫ শতাংশ।  

তবে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে বাস্তবে লোড শেডিংয়ের পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে গ্রাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকছে। আর এতে গ্রামে থাকা মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। আর গ্রামভিত্তিক ক্ষুদ্র শিল্প, খামার ও নির্মাণ শিল্পে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

দেশে গত এপ্রিলে যখন তাপপ্রবাহ চলে তখন সব এলাকায় লোড শেডিংয়ের সমবণ্টন হচ্ছে না বলে অভিযোগ তোলে বিভিন্ন এলাকার গরমে অতিষ্ঠ মানুষ। এ নিয়ে সংসদেও সমালোচনা হয়।

এরপর গত ৬ মে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দেন, শহরে লোড শেডিং দিয়ে গ্রামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর সেদিনই পল্লী বিদ্যুতের অধীন এলাকায় কোনও লোড শেডিং ছিল না। এরপর থেকে গ্রামাঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে লোড শেডিং কমেছিল। এক সপ্তাহ চলার পর গ্রামে লোড শেডিংয়ের পরিমাণ আবারও বাড়তে থাকে। জুন মাসে এসে আগের অবস্থা ছাড়িয়ে যায়।

সারাদেশে বিদ্যুতের মোট গ্রাহকের ৮০ শতাংশই পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অধীন। তাদের গ্রাহক সংখ্যা এপ্রিল পর্যন্ত ছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ। সারাদেশের ৪৬২টি উপজেলায় গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, তবে প্রতিষ্ঠানটি নিজে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে না। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা কিনে শুধুমাত্র বিতরণ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। ফলে বিপিডিবি কত বরাদ্দ দেয় তার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে।

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গরম যতই বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা সমানভাবে বাড়ছে। এই চাহিদা মেটাতে আমাদের বাড়তি বিদ্যুতের প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু সরকারি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি যেভাবে বরাদ্দ দেয়, সেটি দিয়েই আমরা অঞ্চলভিত্তিক চাহিদা সামাল দিই। ফলে বিপিডিবি যত বেশি সরবরাহ দেবে ততই লোড শেডিং কমবে। চাহিদা বাড়লেও তার বিপরীতে সরবরাহ কত পাব, সেটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনার পর পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড চাহিদা-সরবরাহের তথ্য নিয়মমাফিক তালিকা প্রকাশ করছে। তাদের সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকায়, ২৫ জুনের তথ্য আছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ২৫ জুন সর্বোচ্চ লোড শেডিং ছিল। চাহিদার বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি সরবরাহ দিয়েছে ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এই লোড শেডিং ২০২৪ সালের ছয়মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এপ্রিল মাসে লোড শেডিং ছিল বেশি

গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা দেন ৬ মে। তার আগে এপ্রিল মাসে গ্রামাঞ্চলে ছিল ব্যাপক লোড শেডিং। এপ্রিল মাসে লোড শেডিং বাড়তে বাড়তে একদিনে ২ হাজার ৪৩২ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। অবস্থা এমন ছিল প্রতিদিন লোড শেডিং হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যায়।

পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের হিসাবেই এপ্রিল মাসের ২৯ দিনে মোট ২৮ হাজার ৫৪১ মেগাওয়াট লোড শেডিং ছিল। দিনে গড়ে ৯৮৪  মেগাওয়াট লোড শেডিংয়ে কবলে পড়েন ৩ কোটি ৬০ লাখ গ্রাহক। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ হয়। তা নিয়ে সোশাল মিডিয়া ও সংসদে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৬ মে মন্ত্রিসভার বৈঠকে শহরে লোড শেডিং বাড়িয়ে গ্রামে বিদ্যুত বাড়ানোর নির্দেশনা দেন।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আগ পর্যন্ত ১ থেকে ৫ মে পর্যন্ত লোড শেডিং ছিল ২ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াট। দিনে গড়ে ৫৬১ মেগাওয়াট লোড শেডিং ছিল। নির্দেশনার পর ৬ মে কোনও লোড শেডিং ছিল না। ৭ মে থেকে ২৯ মে পর্যন্ত ৬ হাজার ৫৩ মেগাওয়াট লোড শেডিং ছিল। দিনে গড়ে ২৬৩ মেগাওয়াট লোড শেডিং ছিল। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর গ্রামাঞ্চলে লোড শেডিং কমে সহনীয় পর্যায়ে নেমেছিল।

পল্লী বিদ্যুৎ হাটহাজারীর গ্রাহক ইঞ্জিনিয়ার মোহা্ম্মদ ইদ্রিস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ঈদের সময় এক সপ্তাহ স্বস্তিতে ছিলাম। এর আগে-পরে লোড শেডিংয়ের মাত্রা অনেক বেশি ছিল। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার সুফল মিলেছিল কেবল মে মাসেই। আমরা এর ধারাবাহিকতা চাই।”

জুনে লোড শেডিং আগের অবস্থায় ফেরে

জুন মাস থেকে গ্রামে লোড শেডিং আগের অবস্থায় ফিরতে শুরু করে। জুন মাসের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ১ থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত লোড শেডিং হয়েছে ১৩ হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াট। দিনে গড়ে ৫৫৩ মেগাওয়াট লোড শেডিং হয়েছে। আর জুন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোড শেডিং হয়েছে ২৫ জুন, ২ হাজার ৪৭০ মেগাওয়াট।

ঈদের ছুটিতে গত ১৫-২২ জুন পর্যন্ত বলতে গেলে লোড শেডিং ছিলই না। সেসময় পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা কমে নেমেছিল ৬ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটে। স্বাভাবিক সময়ে চাহিদা থাকে ৭ থেকে ৮ হাজার মেগাওয়াটের মতো। সেসময় অফিস, আদালত, শিল্প কারখানা বন্ধ থাকায় দিনে লোড শেডিং ছিল মাত্র ৩ থেকে ৯০ মেগাওয়াট। ফলে এই ৭ দিন আগের ধারাবাহিকতায় থাকলে জুন মাসে গড়ে লোড শেডিং আগের রেকর্ড ছাড়াতো।

ছুটি শেষে ধারাবাহিকভাবেই বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়তে থাকে। গত ২৩ জুন চাহিদা বেড়ে সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। সেদিন সরবরাহ ভালো ছিল, ৮ হাজার ২৮৯ মেগাওয়াট। ফলে ২৩ জুন লোড শেডিং ছিল ২০৮ মেগাওয়াট। আর ২৪ জুন হঠাৎ করেই চাহিদা বেড়ে যায়; বিপরীতে লোড শেডিং বেড়ে ১ হাজার ৯৮৯ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। অবশ্য সেদিন চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ছিল সাড়ে ৭৮ শতাংশ। ২৫ জুন (মঙ্গলবার) লোড শেডিং আরও বেড়ে ২ হাজার ৪৭০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়, যা বছরের রেকর্ড।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিদ্যুৎ সরবরাহের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ২৪ জুন সারাদেশে শহর এলাকার গ্রাহকরা মোট ১ হাজার ৫১০ মেগাওয়াট লোড শেডিংয়ের কবলে পড়েছেন। সেই তুলনায় গ্রামে অনেক বেশি লোড শেডিং ছিল। গরম বাড়ার কারণে সারাদেশে মোট বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে, ২৬ জুন বিদ্যুতের চাহিদা (পিক আওয়ার অফপিক আওয়ার মিলিয়ে) ছিল ১৪ হাজার ৭০৬ মেগাওয়াট। বিপরীতে ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৪৫৭ মেগাওয়াট। ঘাটতি সামাল দেওয়া হয় লোড শেডিং দিয়ে। 

পিক আওয়ারে অর্থাৎ রাত ৯টায় দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে ১৫ হাজার ৪০০ মেগায়াট। আর সরবরাহ থাকে ১৩ হাজার ৮৭৪ মেগায়াট। দিনের বেলা অবশ্য চাহিদা কম থাকে; প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত

গরম বাড়ার সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদন সে হারে বাড়ছে না, ফলে লোড শেডিং দিয়েই সেটি সামাল দিতে হচ্ছে।

বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে গ্যাস সংকট। কক্সবাজারের মহেশখালীর ভাসমান যে দুটি টার্মিনাল থেকে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ করা হয়, তার মধ্যে সামিটের টার্মিনলটি বন্ধ হওয়ায় দেশের গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকটাই কমেছে।

সামিটের টার্মিনালটি এখন মেরামতের জন্য রয়েছে সিঙ্গাপুরে। ফলে সেখান থেকে সরবরাহ দেওয়ার কথা ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট, তবে মিলছে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। আর দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকেও গ্যাস উৎপাদন কমেছে।

জ্বালানি সরবরাহকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার ২৭ জুন প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সরবরাহ সক্ষমতা ৩ হাজার ৮২৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের বিপরীতে ২৬ জুন ২ হাজার ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়েছে। সক্ষমতার বিপরীতে সরবরাহের পরিমাণ ছিল ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ।

এদিকে কয়লাভিত্তিক বড় চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি করে ইউনিট বা আংশিক বন্ধ রয়েছে। দেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ আসে ভারতের গড্ডার আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। ওই কেন্দ্রটির সক্ষমতা এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট। তবে সম্প্রতি কেন্দ্রটি থেকে গড়ে ৩৭০ থেকে ৩৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৭৪৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি ইউনিট পুরোপুরি বন্ধ। অন্য ইউনিট থেকেও আংশিক বিদ্যুৎ মিলছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত