ভাগ্য গুণে কখনও কখনও অযোগ্যরাও যোগ্য ও গুণী ব্যক্তিদের সারিতে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়ে যান। এই অধমও তেমনি এক শতবর্ষী ছাত্রাবাসের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়ে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে আতিথ্য গ্রহণ করে কৃতার্থ হই। ছাত্রাবাস ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুজিত রায় চৌধুরীর আমন্ত্রণে এই অনুষ্ঠানে যোগদান করে আরও ধন্য ও আনন্দিত হই অনুষ্ঠানের উদ্বোধক সাবেক আইএএস অফিসার (সচিব) সাংসদ, লেখক ও গবেষক এবং প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী ড. সুখবিলাস বর্মা মহাশয়ের মতো গুণী ব্যক্তির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে।
অনুষ্ঠান শেষে রায়গঞ্জ থেকে সোজা কোলকাতা। কোলকাতায় ব্যক্তিগত চিকিৎসা বিরতির অবকাশে হৃদয়ে পুষে রাখা দীর্ঘদিনের একটি অপূর্ণ সাধ, বাংলার ইতিহাসের করুণতম অধ্যায়ের বিষণ্ন নগরী মুর্শিদাবাদ পরিভ্রমণ এবং ওই পরিত্যক্ত নগরীর মুখস্ত জায়গাগুলো নিজের চোখে দেখা ও অনুভূতি দিয়ে সেই পুরনো অতীতকে স্পর্শ করা। সেই সাধকে খুব সহজেই সাধ্যের মধ্যে এনে দিলেন নিখাঁদ বন্ধুত্বে নিবেদিতপ্রাণ ও সুহৃদ কলকাতা ক্ষত্রিয় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ধীরেন্দ্রনাথ বর্মা। আমি প্রস্তাব উত্থাপন করা মাত্রই তিনি এই ভ্রমণে সঙ্গী হতে রাজি হয়ে গেলেন। অতঃপর সিদ্ধান্তমতে দুই সদস্যবিশিষ্ট ভ্রমণ দল নিয়ে আমাদের কোলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ যাত্রা।
১৪ নভেম্বর ২০২৩ তারিখ সন্ধ্যার পর পরই আমরা মুর্শিদাবাদের লালবাগ রেল স্টেশনে নামি। অপর্যাপ্ত আলোয় ম্লান, বুড়োটে, প্রায় পরিত্যক্ত জনবিরল একটি স্টেশন। কোলকাতা থেকে পেরিয়ে আসা অন্যান্য স্টেশনের তুলনায় অতিসাধারণ, ঝিম মেরে পড়ে থাকা একটি নিষ্প্রাণ স্থাপনা যেন। অন্ধকারে অমসৃণ, অসমতল প্লাটফর্ম ধরে একজন যাত্রীর পিছু পিছু আমরা হাঁটতে থাকি। একটু সামনে এগিয়ে যেতে যেতেই কেন জানি মনে হলো যাকে আমরা অনুসরণ করছি তিনি এই ট্রেনের যাত্রী নন, হয়ত রেলের কর্মচারী বা স্থানীয় অন্য কেউ। আশে পাশে আরও দু’এক জন লোককে উদ্দেশ্যহীন চলাফেরা করতে দেখা যায়। এলাকার নির্জনতা ও গা ছমছম করা অন্ধকারে তাদের সন্দেহজনক গতিবিধি যেন পরিবেশটাকে আরও বেশি রহস্যময় করে তুলেছে।
স্টেশনের বাইরের পরিবেশটাও অনেকটা সে রকমই। লোকজন খুব কম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা দোকানপাট। আশে পাশে অপেক্ষমান ইতস্তত কয়েকটি টোটো, রিকশা অপেক্ষমান যাত্রীর আশায়। সান্ধ্যকালীন চা পানের ইচ্ছাটা সময় ও পরিবেশের কারণে মাঠে মারা গেল। স্টেশনের পাশে আমরা কোন হোটেলে উঠব ভ্রমণসঙ্গী ধীরেনদা আগেই তার লোক দিয়ে নাম ঠিকানা জোগাড় করে রেখেছিলেন। আমরা একটা টোটো নিয়ে স্টেশনের কাছাকাছি ‘হোটেল ইন্দ্রজিৎ’-এ উঠলাম। হোটেলে হাত মুখ ধুয়ে মনে হলো এখানে বসে বসে সারা সন্ধ্যাটা শুধু শুধু নষ্ট করার কোনও মানেই হয় না। নিচে নেমে একটা টোটো নিয়ে ছুটলাম পার্শ্ববর্তী ইতিহাসখ্যাত মোতিঝিলের দিকে।
নবাবী আমলের শেষভাগে এবং ইংরেজ রাজত্বের শুরুর দিকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদের উত্থান-পতনের অনেক জানা-অজানা কাহিনির রঙ্গভূমি এই মোতিঝিল। এই নামটির প্রতি আগে থেকেই অনেকের মতো আমারও একটি আলাদা আবেগাশ্রিত কৌতুহল ছিল। তাই যদি সময়াভাবে পরে দেখার সুযোগ না পাই সেজন্যে দর্শনের নির্দিষ্ট সময়ের শেষ পর্যায়ে আমরা রাতের মোতিঝিল দেখার জন্য টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। কিছু বই পুস্তক নাড়াচাড়ার সুবাদে মোতিঝিল সম্পর্কে আগে থেকেই কিছু ধারণা ছিল। কোনও কোনও গবেষকের ধারণা যে, বর্তমান মোতিঝিল ভাগীরথী নদীর শুকিয়ে যাওয়া পরিত্যাক্ত ধারারই একটি অংশ। এখানে প্রচুর শুক্তি বা ঝিনুক পাওয়া যেত, যার থেকে সংগ্রহ করা হতো মোতি বা মুক্তা। তাই এই ঝিলের নাম হয় মোতিঝিল। এক ধরনের কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে, ঐ শুক্তি থেকে আহরিত মোতিচুর্ণে নবাবদের তাম্বুল সেবন হতো।
একটি সুন্দর সাজানো পার্কের মতো মনে হচ্ছিল রাতের মোতিঝিল। সাজানো ফুলের বাগান, লতাগুল্ম আর বৃক্ষরাজির সারিবদ্ধ সমাবেশ। মাঝখান দিয়ে মসৃণ পথের বিস্তার। ঝোপঝাড়ের আবছায়ায় যুগলবন্দী নর-নারী। দূরে কোথাও খেলার আনন্দে মেতে থাকা শিশুদের কোলাহল। কিছুদূর এগিয়ে গেলেই ঝিলের নিস্তব্ধ, নিথর জলরাশি। ঝিলপাড়ের লাইট পোস্টের আলো জলের উপর পড়ে এমন এক অদ্ভুত আলো-ছায়ার বিষণ্নতা সৃষ্টি করেছে— যেন তা মোতিঝিলের হারানো অতীতের গৌরব ও তার বিয়োগান্তক পরিণতিকেই মায়াজালে আচ্ছন্ন করেছে। ইতিহাসের অন্তিম দৃশ্যপটে ষড়যন্ত্র, যুদ্ধ, হত্যা আর হাহাকারে হারিয়ে যাওয়া কুশীলব সিরাজ, ঘসেটি বেগম, এক্রামুদ্দৌলা, নওয়াজেস মুহম্মদ খাঁর কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা অতঃপর হোটেলে ফিরে আসি বিষণ্ন অতীতের বুকে চাপা দীর্ঘশ্বাস, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে।
পরদিন সকালে হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি টোটো সারাদিনের জন্য রিজার্ভ করে আমরা মুর্শিদাবাদের লালবাগ সংলগ্ন ঐতিহাসিক স্থান দর্শনে বেরিয়ে পড়ি। শুরু হয় ফুটি বা ফৌতি মসজিদ দর্শনের মধ্য দিয়ে। জলা ও জঙ্গলে আকীর্ণ ভগ্নপ্রায় একটি অসম্পূর্ণ স্থাপনা এই ফৌতি মসজিদ। যতদূর জানা যায় মুর্শিদকুলী খাঁর দৌহিত্র সরফরাজ খাঁ এটি নির্মাণ করেছিলেন। এরপর কাটরা মসজিদের সুদৃশ্য স্থাপত্য ও বিশালতা দেখে আমরা মুগ্ধ হই। কাঠগোলা বাগান, নশিপুর আখড়া ইত্যাদি দ্রুত পরিভ্রমণ করে হাজার দুয়ারি প্যালেস ও মিউজিয়ামে। এখানে ছোট বড় গাড়ির বহর এবং জনসমাগম দেখে মনে হলো এতক্ষণে আমরা একটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থানে সমাগত হয়েছি। এখানে টিকেট কেটে ভিতরে ঢোকার নিয়ম। গেটের কাছে আসতে না আসতেই একাধিক ট্যুরিস্ট গাইড এসে ছেঁকে ধরল। স্থানীয় পর্যটন আকর্ষণের উপর ঝরঝরে বর্ণনা শুনে মনে হলো এরা সবাই বেশ প্রফেশনাল। আমরা একজন গাইডকে বেছে নিলাম।
গাইড গড় গড় করে বলে যেতে লাগলেন, হাজারদুয়ারি ছিল ইংরেজদের প্রশাসনিক কার্যালয়। এটি নির্মিত হয় ১৮৩৮ সালে। হাজার দুয়ারি বলা হয়, কারণ এর হাজারটি দরজা আছে— যার নয়শটি দরজা খোলা যায়, আর একশটি দরজা খোলা যায় না… ইত্যাদি। হাজার দুয়ারি প্রাসাদের উল্টোদিকে অবস্থিত ইমামবাড়াটি নির্মিত হয় ১৮৪৭ সালে। নির্মাণ করেন নবাব নাজিম ফিরাদুনজা ওরফে মনসুর আলী খাঁ। আমরা হাজারদুয়ারির বিভিন্ন কক্ষ ও প্রকোষ্ঠে সাজানো মূর্তি, তৈলচিত্র, অন্যান্য দুর্লভ দ্রব্যাদিসহ মিউজিয়াম দর্শন করে মুগ্ধ চিত্তে ফিরে আসি।
এরপর আমাদের বাহন টোটো জাফরাগঞ্জ প্রাসাদ বা ‘নিমকহারাম দেউড়ি’র সামনে এসে উপনীত হয়। প্রাসাদটি হতশ্রী ও জরাজীর্ণ। সিংহ দরজায় লোহার গেটটি বন্ধ। ছোট্ট একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে প্রবেশ নিষেধ। ভিতরের মূল দরজার আরেকটি গেট তালাবদ্ধ। এই প্রাসাদই ছিল ইতিহাসের সবচাইতে বড় খলনায়ক মীর জাফরের বাসস্থান। এই জাফরাগঞ্জই সিরাজের বধ্যভূমি বলে নিখিলনাথ রায় তার ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’তে উল্লেখ করেছেন। এখানেই মীরজাফর পুত্র মীরণের আদেশে মুহম্মদী বেগের তরবারির আঘাতে সিরাজ নিহত হন। বাংলার ইতিহাসের এক নিষ্ঠুরতম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে এই বাড়িতে। বিষাদিত হৃদয় আর উগড়ে উঠা ঘৃণার ঘিন ঘিন ভাব নিয়ে আমরা সে স্থান ত্যাগ করি।
টোটো চালক এবার আমাদের নামিয়ে দেন ইতিহাসের আরেক খলনায়ক জগৎ শেঠের বাড়ির সামনে। পুরাতন বাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় আমরা বাড়ির রেপ্লিকায় ঘুরে ঘুরে টাকশালের ব্যর্থ অনুসন্ধানে অন্ধ ইতিহাসের চক্করে থেমে থেমে শেষে অনতিদূরে উপস্থিত হই— নসিপুর রাজবাড়ীতে। নসিপুর রাজবাড়ি মানে ইতিহাসে বিরল চরিত্রের মানবরূপী অপদেবতা দেবী সিংহের রাজপ্রাসাদ। নবাবী আমলের শেষ পর্যায়ে এবং ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভে ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করার পর রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারাদার নিয়োগ করে রেজা খাঁকে। অধিক রাজস্ব আদায়ের লোভ ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেবী সিংহ রেজা খাঁর কাছ থেকে প্রথমে পূর্ণিয়ার ইজারা এবং পরবর্তীতে নানান ছলা-কলা ও উৎকোচে বশীভূত করে কোম্পানির গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস্ সাহেবের নিকট থেকে রংপুর ও দিনাজপুরের ইজারা গ্রহণ করেন। এরপরে প্রজা ও জমিদারদের উপর শুরু হয় অত্যাচার, শোষণ ও নির্যাতন। এই নির্যাতন যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার কিছু বর্ণনা পাই নিখিলনাথ রায়ের ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’তে।
নিখিলনাথ রায় লিখেছেন, ‘‘নৃশংস দেবী সিংহের অত্যাচারে সমগ্র উত্তরবঙ্গ হাহাকারধ্বনিতে পূর্ণ হইয়া উঠে। রঙ্গপুর দিনাজপুর প্রভৃতি প্রদেশ মহাশ্মশানে পরিণত হয়। কোম্পানীর রাজত্বারাম্ভে বাঙলাদেশে যে মূর্তিমতী অরাজকতা দেখা যায় দেবী সিংহের অত্যাচার তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে।’’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘অনাহারে রঙ্গপুরবাসী প্রজাগণের মধ্যে ঘোর কষ্ট দেখা দিল; পিতা পুত্রকে বিক্রয় করিতে বাধ্য হইল, স্বামী স্ত্রীকে বিসর্জন দিল। এইরূপে প্রত্যেক গৃহ সংসার হাহাকার ধ্বনিতে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।’’
এই পরিস্থিতিতে কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করার জন্য অতিরিক্ত কর বৃদ্ধি এবং তা আদায় না হওয়ায় দিনের পর দিন সাধারণ কৃষক প্রজা, জমিদার, জোতদার, নারী-পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে দেবী সিংহের অত্যাচার নির্যাতনে অতিষ্ঠ মানুষ অবশেষে বিদ্রোহের জন্য ঐক্যবদ্ধ হন। এই বিদ্রোহ দৃশ্যত কোম্পানির ইজাদার দেবী সিংহের বিরুদ্ধে হলেও বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য বৃটিশ কোম্পানির শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি থেকে রংপুরের হিন্দু মুসলমান প্রান্তিক চাষী, ক্ষুদ্র জমিদার, জোতদার আপন অস্তিত্বের প্রশ্নে এই ঘৃণ্য শোষণ ও নির্যাতন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হন— যার মূল নেতৃত্বে ছিলেন ধীরাজনারায়ণ, কেনা সরকার ও নূরুলদীন।
রংপুরের এই বিদ্রোহ ও বিদ্রোহীকে স্থানীয় ভাষায় বলা হতো ‘ঢিং’। বিদ্রোহের খরচ নির্বাহের জন্য এই বিদ্রোহের সমর্থকরা যে আর্থিক সাহায্য প্রদান করতেন তাকে বলা হতো ‘ঢিং খরচ’। এ প্রসঙ্গে এই বিদ্রোহ অঞ্চলে বসবাসরত বিদ্রোহের সমসাময়িক কবি রতিরাম দাসের কবিতায়ও এর প্রমাণ মেলে। রংপুরের পীরগাছা থানার ইটাকুমারীতে জন্মগ্রহণকারী অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি রতিরাম দাস ‘ইটাকুমারীর প্রজা বিদ্রোহ’ নামক কবিতায় লিখেছেন—
‘‘কোম্পানির আমলেতে রাজা দেবী সিং
সে সময়ে মুল্লুকেতে হইল বার ঢিং।।
পূর্ণ কলি অবতার দেবী সিংহ রাজা
দেবী সিংহের উপদ্রবে প্রজা ভাজা ভাজা।।
ইংরাজ বিচার করে এজলাস করি
একে একে ফাটকেতে রাখে ঢিং ধরি।।’’
বিচিত্র রক্তচোষা নীতি, বর্বরতা ও অপকর্মের মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অর্থ সম্পদ দিয়ে তার জীবদ্দশায় গড়া প্রসাদের মূল অংশ যা এখন পিছনে পরিত্যাক্ত ও প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। পরবর্তীকালে নির্মিত সামনের প্রাসাদের দোতলায় যাদুঘরের মতো ব্যবহৃত পুরাতন জিনিসপত্র আর বড় আলমারিতে থরে থরে সাজানো পুরাতন ধুলিমলিন দলিল দস্তাবেজ, চিঠিপত্র, পুরনো বাতিল কাগজপত্র— যেখানে হয়ত ইতিহাসের আরও অনেক অজানা অধ্যায় গুমরে কেঁদে মরছে। না জানি কত কৃষকের বুক ভাঙা কান্না ঐসব দলিলপত্রে বন্দি হয়ে আছে। মাঝখানের একটি বৃহৎ কক্ষের দেয়াল শীর্ষে ওয়ারেন হেস্টিংস, দেবী সিং ও অন্যান্যের কিছু তৈলচিত্র বিষণ্ন ছায়ায় ঝুলে আছে। ক্ষণিকের বিষণ্নতা আমাকেও গ্রাস করে। আমি ইংল্যান্ডের হিমশীতল পার্লামেন্টে এডমান্ট বার্কের আবেগমিশ্রিত চিৎকার শুনতে পাই। তিনি উচ্চস্বরে রংপুর দিনাজপুরের সর্বশান্ত কৃষকদের দুর্দশার বিবরণ দিতে দিতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছেন; নিস্তব্ধ পার্লামেন্ট হাউস, নির্বিকার। পরে অবশ্য এই ঘটনা অনুসন্ধানে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল।
কিন্তু বিচারে শেষ পর্যন্ত দেবী সিংহের কিছুই হয়নি। তিনি বৃটিশদের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধি লাভ করলেন। রংপুর-দিনাজপুরের মাটি কৃষকের রক্তে লাল হলো, বাড়িঘর আগুনে পুড়ল, ক্ষেতের সোনার ধান পুড়ে হলো অঙ্গার। ফলাফল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। আর বাংলার কৃষকের জীবনে বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কেঁদে গেল।
লেখক: গবেষক ও লেখক।
ইমেইল: [email protected]