দুটি জাহাজে ইরান থেকে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) আমদানির যে অভিযোগ এলপিজি অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আজম জে চৌধুরী করেছেন তার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংগঠনটির ১১ জন সদস্য।
তারা বলছেন, সদস্যদের সঙ্গে আলাপ না করেই এ ধরনের অভিযোগ করা সংগঠনের ‘স্পিরিটের স্পষ্ট লঙ্ঘন’।
সেই অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য আজম জে চৌধুরীর প্রতি দাবি জানিয়েছেন তারা। সংগঠনের ১১ সদস্য ঢাকায় বসে গত ৯ অক্টোবর অভিযোগ প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এরপর তারা চিঠির মাধ্যমে আজম জে চৌধুরীর কাছে বিষয়টি জানিয়েছেন। চিঠিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সব সদস্যকে নিয়ে দ্রুত বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) ডাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
চিঠিতে লেখা হয়েছে, সংগঠনের কিছু সদস্যের একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ নিতেই এ ধরনের অভিযোগ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
সংগঠনটির নেতারা বলছেন, এলপিজি অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সংখ্যা ২৭ জন। এর মধ্যে ১১ জন ঢাকায় বসে একমত হয়ে অভিযোগ প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেক সদস্য তখন ঢাকায় না থাকায় বৈঠকে উপস্থিত হতে পারেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএম এনার্জির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সভাপতি যে অভিযোগ করে চিঠি দিয়েছেন, সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত মত। এখানে সংগঠন কোনোভাবেই জড়িত নয়। কারণ তিনি আমাদের সঙ্গে আলাপ করেননি।”
তিনি বলেন, “ইরান থেকে এলপিজি আমদানির যে অভিযোগ সভাপতি করেছেন তার কোনও ভিত্তি নেই। জাহাজ দুটি এসেছে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। মূলত তিনি একচেটিয়া ব্যবসা ধরতেই এই অভিযোগ করেছেন। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, যে কম্পানির বিরুদ্ধে এলপিজি সরবরাহের অভিযোগ তিনি তুলেছেন, কয়েক বছর আগেই সেই কম্পানি থেকেই তিনি এলপিজি এনেছেন।”
“এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একই প্রতিষ্ঠান থেকে আজম জে চৌধুরী আনলে বৈধ আর আমরা অন্য ব্যবসায়ীরা আনলে স্যাংশন কান্ট্রির অভিযোগ তোলা হচ্ছে কেন”, যোগ করেন চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বিএম এনার্জির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
‘ক্যাপ্টেন নিকোলাস’ ও ‘গ্যাজ জিএমএস’ ট্যাংকার দুটি এলপিজি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর জলসীমার কুতুবদিয়ার গভীর সাগরে নোঙর করে ৬-৭ অক্টোবর। এলপিজি এনেছে সিলিন্ডার গ্যাস বিপণনে জড়িত দেশের বেসরকারি বেশ কয়েকটি শিল্পগ্রুপ।
দুটি জাহাজ থেকেই এলপিজি স্থানান্তর শুরু হয়। তবে গত শনিবার দিবাগত গভীররাতে ‘ক্যাপ্টেন নিকোলাস’ জাহাজ থেকে এলপিজি খালাস করতে গিয়ে আগুন লেগে বিস্ফোরণ ঘটে।
‘ক্যাপ্টেন নিকোলাস’ জাহাজে আগুন লাগার পর ঘটনাটি ‘নাশকতা, নাকি নিরাপত্তাজনিত অবহেলা’ তা নিয়ে আলোচনার মধ্যে সামনে আসে আসলেই ওই এলপিজি ইরান থেকে আনা হয়েছে কি না।
কারণ, এলপিজি অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলোচিত ব্যবসায়ী আজম জে চৌধুরী গত ৬ অক্টোবরই দুটি জাহাজেই ইরান থেকে এলপিজি আমদানির অভিযোগ করেন। এরপর থেকেই হৈ চৈ পড়ে যায়।
সভাপতির এমন অবস্থানের বিরুদ্ধে ৯ অক্টোবর ঢাকায় বৈঠকে বসে সোচ্চার হন ১১ জন সদস্য।
বাংলাদেশের এলপিজি খাতের অন্যতম অপারেটর ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, ওমেরা সিলিন্ডার লিমিটেড ও ওমেরা ফুয়েল লিমিটেডের এই পরিচালক বলছেন, ‘আর্ন্তজাতিক নিষেধাজ্ঞা’ লঙ্ঘন করে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে অবৈধভাবে এসব এলপিজি ইরান থেকে আমদানি করা হয়েছে। এই আমদানি দেশের এলপিজি সেক্টরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
এসব অভিযোগ এনে দুটি জাহাজই আটকের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ, কাস্টমস, বাংলাদেশ ব্যাংক ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে ওই লিখিত অভিযোগ দেন তিনি। তার অভিযোগের পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি ৯ অক্টোবর কুতুবদিয়া গভীর সাগরে গিয়ে জাহাজ পরিদর্শন করে।
তদন্ত এখনও শেষ করতে পারেনি সেই কমিটি। জাহাজ দুটির একটি ‘গ্যাজ জিএমএস’ থেকে এলপিজি লাইটারিং বা স্থানান্তর চলছে। কিন্তু ‘ক্যাপ্টেন নিকোলাস’ থেকে এলপিজি ছোট জাহাজ ‘বিএলপিজি সোফিয়া’তে স্থানান্তার কাজ বন্ধ আছে, গত শনিবার দিবাগত রাতের ওই আগুন লাগার পর থেকে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গিয়েছিলেন একবারই ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। দুই কোটি ৯৯ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে মামলাটি করেছিলেন ব্যবসায়ী আজম জে চৌধুরী। মামলায় প্রায় এগার মাস বন্দি ছিলেন শেখ হাসিনা।
মবিল যমুনা লুব্রিক্যান্ট (এমজেএল) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজম জে চৌধুরী বর্তমানে প্রাইম ব্যাংকের পরিচালক পদে আছেন। তার ছেলে তানজিল চৌধুরী ব্যাংকটির চেয়ারম্যান। কনসলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যানও আজম জে চৌধুরী।
আজম জে চৌধুরীর ইরান থেকে এলপিজি আনার অভিযোগের মধ্যেই ‘ক্যাপ্টেন নিকোলাস’ জাহাজের শিপিং এজেন্ট সী ওয়েভ মেরিন সার্ভিসেস প্রতিষ্ঠানটি বন্দর ও কাস্টমসে ঘোষণা দেয়, সব এলপিজি বোঝাই করা হয়েছে ওমানের সোহার বন্দর থেকে। সেই অনুযায়ী কাস্টমস ছাড়পত্র দিয়েছে ও বন্দর লাইটার করার অনুমতি দিয়েছে।
আজম জে চৌধুরীর অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিন হাবিব এলপিজির পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একজন সভাপতি হিসেবে তিনি সংগঠনের অন্য সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার আগে অবশ্যই সদস্যদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার আগে অবশ্যই আলাপের প্রয়োজন ছিল। ফলে তার অভিযোগ বিধিসম্মত হয়নি।”
জানতে চাইলে ‘ক্যাপ্টেন নিকোলাস’ এর শিপিং এজেন্ট সী ওয়েভ মেরিন সার্ভিসেসের উপদেষ্টা খায়রুল আলম সুজন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি সরেজমিনে ঘুরে এসেছে। তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরই অনুমতি সাপেক্ষে আমরা এলপিজি খালাসের কাজ শুরু করতে পারব। আর ক্যাপ্টেন নিকোলাস জাহাজের তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি, এলপিজি অক্ষত আছে।”