মাগুরায় ধর্ষণের শিকার আট বছর বয়সী মেয়েটির অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। তাকে শুক্রবার রাত থেকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। আরও নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপতাল থেকে শনিবার বিকালে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ ও ভুক্তভোগী শিশুর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েটি বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার সকালে বাড়ির পাশে তাকে রক্তাক্ত অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পরিবারের সদস্যরা প্রথমে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।
সেখান থেকে শিশুটিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে শুক্রবার রাতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার বিকালে শিশুটির মা বাদী হয়ে চারজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা করেছেন। মামলায় শিশুটির ভগ্নিপতি, ভগ্নিপতির ভাই, তার বাবা ও মা- চারজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
মেয়েটির অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক আইসিইউ বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কনসালটেন্ট সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যতটুকু সঙ্কাটাপন্ন শেষ পর্যন্ত হওয়া যায়, ওর (শিশুটি) অবস্থা আসলে তাই। তবে আইসিইউতে তো ২৪ ঘণ্টা, ৪৮ ঘণ্টা বা ৭২ ঘণ্টার আগে কিছু বলা যায় না। ওর তো এখনও ২৪ ঘণ্টাও হয়নি আইসিইউতে আসার।”
তিনি বলেন, “বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তাকে সিএমএইচে পাঠানো হয়েছে। এখানে তো (ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) কিছুটা ক্রাউডেড, ওখানে (সিএমএইচ) আরেকটু নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা যাবে।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের উপ-পরিচালক আশরাফুল আলম বলেন, ‘মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশক্রমে ও সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদের নির্দেশনা অনুয়ায়ী দ্রুততম সময়ে শিশুটিকে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তরের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে মেডিক্যাল টিম রয়েছে।”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কনসালটেন্ট সকাল সন্ধ্যাকে আরও বলেন, “আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। বাকিটা উপরওয়ালার উপরেই আসলে ভরসা রাখতে হবে।”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মেয়েটি সঙ্কটাপন্ন এবং সে এখনও অচেতন; ভেন্টিলেশনে রয়েছে।”
এসময় শিশুটির জন্য সবার কাছে দোয়াও চান তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক জানান, শিশুটির চিকিৎসায় ইতোমধ্যেই হাসপাতালে একাধিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে।
শুক্রবার রাত ৯টার দিকে মেয়েটিকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “পাশবিক নির্যাতনের কারণে শিশুটির যৌনাঙ্গে ক্ষত রয়েছে। মেশিনের মাধ্যমে তার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। অবস্থা ক্রিটিক্যাল, ভেন্টিলেশনে আছে, অবস্থাটা আসলে ভালো না। মেয়েটির গলা চেপে ধরার কারণে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, “ধর্ষণের পাশাপাশি তার গলা চেপে ধরা হয়েছিল। আমরা দেখেছি তার গলায় একটা দাগ আছে। এ কারণে চিকিৎসকরা বলছেন, গলা চেপে ধরার কারণে তার শ্বাসকষ্ট হয়েছে। এ কারণে তার সমস্যাগুলো আরও বেশি হচ্ছে।”
শিশুটির চিকিৎসায় শিশু শনিবার মেডিকেল বোর্ড করা গঠনের কথা জানিয়ে হাসপাতালের পরিচালক আসাদুজ্জামান বলেন, বোর্ডে চারটি বিভাগের চিকিৎসকরা আছেন। আহ্বায়ক করা হয়েছে শিশু বিভাগের প্রধানকে। বোর্ডে তার সঙ্গে রয়েছেন পেডিয়াট্রিক সার্জারি, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং অবেদন (অ্যানেস্থেশিয়া) বিদ্যা বিভাগের চিকিৎসকরা।
এই দেশটি কাপুরুষের দেশ হয়ে গেল, প্রশ্ন সমাজকল্যাণ উপদেষ্টার
শিশুটিকে দেখতে শনিবার দুপুর ১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান সমজাকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ। এ সময় তিনি অভিযুক্তরা যেন কোনোভাবেই ছাড় না পায় সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সাংবাদিকদের জানান।
শারমীন এস মুরশিদ বলেন, “যে মেয়েটি মেয়ে হয়ে ওঠেনি, যে মেয়েটি নারী হয়ে ওঠেনি, তার গায়ে হাত দেয় কী করে? এই দেশটি কাপুরুষের দেশ হয়ে গেল?
এ সময় তিনি ‘এই কাপুরুষগুলো পুরুষ হয়ে চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে’ বলেও মন্তব্য করেন।
সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের আরও বলেন, “এদেরকে দমন করার দায়িত্ব আপনাদেরও। সমাজ কি সুস্থ আছে বলে আপনার মনে হয়? আর আপনার কি মনে হয়? আমি ছয় মাস এসেছি, আর আপনার কি মনে হয়- এই পচে যাওয়া সমাজকে বদলে দেবো।
“বাচ্চাটা জীবন নিয়ে নড়ছে, ডাক্তাররা জানেনা তাকে বাঁচাতে পারবে, কি পারবে না। ডাক্তাররা কাজ করছে, তরুণ ছেলে-মেয়েরা প্রতিবাদ করছে। আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। এই বাচ্চাটা যেন সর্বোচ্চ বিচার পায়।”
তিনি বলেন, “প্রথম কথা সবাই দোয়া করবেন বাচ্চাটা যেন বাঁচে। ডাক্তাররা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। এসব ঘটনায় আপনাদের সাংবাদিকদেরও দায় আছে। দয়া করে আপনারা দোষীদের কোনোভাবেই জায়েজ করবেন না। বারবার এই ঘটনাগুলো ঘটছে। এগুলো হতে দেওয়া যাবে না। এখানে প্রমাণ আছে, আসামি আছে কিছুতেই আমরা হাতছাড়া হতে দেব না। এটা অবশ্য নজরে রাখতে হবে।”
এসময় নারী শিশুদের কল্যাণে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান সমজাকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ।
মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিরাজুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, শিশুটিকে নিপীড়নের ঘটনায় যারা জড়িত বলে পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছে তাদের চারজনকেই পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
শনিবার বিকালে শিশুটির মা বাদী হয়ে চারজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা করেছেন। মামলায় শিশুটির ভগ্নিপতি, ভগ্নিপতির ভাই, তার বাবা ও মা- চারজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
ঘটনা সম্পর্কে যা জানা গেছে
বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঘটনার পর শিশুটির পরিবারের সদস্যদের অভিযোগের ভিত্তিতে যে চারজনকে আটক করা হয়েছে তার মধ্যে শিশুটির বোনের স্বামী ও শ্বশুরও রয়েছে।
পুলিশ ও পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কয়েকদিন আগে শিশুটি মাগুরা শহরে তার বোনের শ্বশুর বাড়িতে বোনের কাছে গিয়েছিল বেড়ানোর জন্য।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার কিছুক্ষণ পর শিশুকে অচেতন অবস্থায় মাগুরা আড়াইশ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে আসেন এক নারী। পরে জানা যায় ওই নারী তার বোনের শাশুড়ি। এরপর খবর পেয়ে শিশুটির মাও হাসপাতালে যান।
হাসপাতালে চিকিৎসরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শিশুটির গলায় দাগ ও শরীরে বেশ কিছু জায়গায় আঁচড় দেখতে পান। চিকিৎসকের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ জানায়, শিশুটির যৌনাঙ্গে রক্তক্ষরণ হয়েছে।
অবস্থা ভালো নয় দেখে তখনই মাগুরা হাসপাতালের ডাক্তারদের পরামর্শে শিশুটিকে নেওয়া হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাকে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
এর মধ্যেই ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং শিশুটির নিপীড়নের অভিযোগ করে এর সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন বহু মানুষ।
ঘটনার প্রতিবাদে ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে শুক্রবার মাগুরা সদরে মহাসড়ক অবরোধ ও থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন স্থানীয়রা। থানার মূল ফটক ঘেরাও করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি তোলেন।
এর আগে জুমার নামাজ শেষে শহরের চৌরঙ্গীর মোড়ে জমায়েত হয়ে শিশু নির্যাতনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে মিছিল বের হয়। এক পর্যায়ে তারা শহরের ভায়না চত্বর বা মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। পরে বিকেল ৩টার দিকে থানার গেইটে গিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। পরে সেনাসদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।