Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪
Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪

ভরা মৌসুমেও চড়া আম-লিচুর বাজার

ss-lichu mango-31-5-24
Picture of অনিক রায়

অনিক রায়

সাধারণত বছরের এই সময়ে নানা জাতের আম-লিচুতে ভরে যায় বাজার। আম্রপলি, হাড়িভাঙ্গা, ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, হিমসাগর আমের ঘ্রাণ পাওয়া যায় বাজারে গেলেই। পাওয়া যায় নানা জাতের লিচুও।

তবে এবার এই দুই মৌসুমি ফলের বাজারের চেহারা একটু ভিন্ন। বৈশাখ শেষ হয়ে জ্যৈষ্ঠেরও অর্ধেক পেরিয়ে গেছে, কিন্তু বাজারে চাহিদার তুলনায় আম-লিচুর সরবরাহ বেশ কম। তাছাড়া বাজারে যেসব আম-লিচু পাওয়া যাচ্ছে, তার একটি বড় অংশই অপরিপক্ক; দামও চড়া।

ঢাকার খিলগাঁও, পুরানা পল্টন ও মহাখালী ফল বাজার ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। আম যেসব এলাকায় বেশি হয় সেখানেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার ফলন কম হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে বাজারে।

শুক্রবার খিলগাঁও, পুরানা পল্টন ও মহাখালী ফল বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশি পাওয়া যাচ্ছে হিমসাগর জাতের আম। খুব অল্প পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে ল্যাংড়া, গোবিন্দভোগ, কাঠিমন, বারিফল। থাইল্যান্ডের জাম্বু আম ও বিদেশি কয়েক প্রজাতির লিচুও পাওয়া যাচ্ছে কিছু কিছু জায়গায়।

এসব আম-লিচুর দাম অনেক বেশি অভিযোগ করে ক্রেতারা বলছেন, গত দুই বছরে সব কিছুর দামই বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আম-লিচুর যে দাম এখন তাতে তারা পড়েছেন বিপাকে।

বিক্রেতারা অবশ্য দায় চাপাচ্ছেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর। তাদের মতে, অতিরিক্ত খরার কারণে আম ও লিচুর ফলন কমেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই যেমন বাজারে আম-লিচুর সংকট তৈরি হতে পারে তেমন বিক্রিও হবে চড়া দামে। তবে সরবরাহ বাড়লে দাম কিছুটা কমবে, বলছেন বিক্রেতারা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, গত বছর ২৭ দশমিক ৫ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়েছিল।গতবারের তুলনায় এবার আমের ফলন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম হতে পারে।

আম-লিচুর দাম

ঢাকার বিভিন্ন বাজারে জাত ভেদে প্রতি কেজি আম বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ৩৫০ টাকায়। ১০০ লিচু বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৬৫০ টাকায়।

প্রতি কেজি হিমসাগর আম পড়ছে ১৪০-২০০ টাকা, গোবিন্দভোগ ১৮০ টাকা, বারিফল ৩০০ টাকা, কাঠিমন ২০০ টাকা, সাতক্ষীরার গোপালভোগ ৩৫০ টাকা, থাইল্যান্ডের জাম্বু আম (সবুজ প্রজাতি) ১ হাজার টাকা এবং থাইল্যান্ডের জাম্বু আম (লাল প্রজাতি) ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাজারে ১০০ বোম্বাই লিচু ৪৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা, কদমি লিচু ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা, চায়না লিচু ১৪শ টাকা, বেলোয়ারি লিচু ৮০০ টাকা এবং হাওয়াই মিঠাই প্রজাতির লিচু ১৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

বিপাকে ভোক্তারা

শুক্রবার সকালে খিলগাঁও রেলগেট বাজারে আমের দামদর করছিলেন ফখরুল তোহা। দাম শুনে আম না নিয়েই চলে যাচ্ছিলেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের এই কর্মী।

এ সময় তার সঙ্গে কথা হয় সকাল সন্ধ্যার। ফখরুল তোহা বলেন, “বাচ্চারা আম খুব পছন্দ করে। কিন্তু দামের যে অবস্থা আম কিনব কীভাবে? আমের সময় এখন। বাচ্চারা বার বার বলছে আমের কথা। কিন্তু দামে মিলছে না বলে আম নিতে পারছি না।”

বাজারে সব কিছুর দামই বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মধ্যবিত্তদের জন্য এই শহরে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। বেতন বাড়েনি গত দুবছর। কিন্তু সব কিছুর দাম বেড়েছে কয়েক দফায়। কিছু কিনতে ইচ্ছে করলেও দামের জন্য কিনতে পারি না ।”

একই আক্ষেপ ছিল যাত্রাবাড়ির শাকিল মাহমুদের কণ্ঠেও। তিনিও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী। শুক্রবার বায়তুল মোকাররম মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে এসেছিলেন তিনি। ইচ্ছা ছিল মসজিদ সংলগ্ন পুরানা পল্টনের ফল বাজার থেকে আম-লিচু কেনার।

দামদর করে কিনলেন দুই কেজি হিমসাগর আম এবং একশ লিচু। শাকিল মাহমুদ আফসোস করে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আগে এসময় আম কিনতাম ৫-১০ কেজি করে। এখন যে দাম, দুই কেজির বেশি কিনতে পারলাম না। মন ভরে খেতে না পারলেও মৌসুমের ফল খাওয়া উচিত।“

এই পুরানা পল্টনে ফলের ব্যবসা করেন খোরশেদ মিয়া। আম লিচুর দামের এই অবস্থার কারণ জানতে চাইলে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “বছরের এই সময় বাজার ভরা থাকে আম-লিচুতে। কিন্তু এবার দেখেন আমার দোকান খালি। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ফলের দামও বেশি।”

এ বিক্রেতার ধারণা, এ বছর এ মৌসুমি ফলের দাম চড়াই থাকবে।

তিনি বলেন, “গরমে এ বছর ফলের ফলন কম হইছে। গতবার যেসব ফল ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে সে ফল পেতেই এ বছর গুনতে হবে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।”

তাপদাহে আম-লিচুর সর্বনাশ

সাধারণত ফেব্রুয়ারির শুরুতেই আমগাছে মুকুল দেখতে পান আম চাষীরা। এবার চিত্র ছিল ভিন্ন। গাছে মুকুল আসতে ফেব্রুয়ারির শেষ এমনকি কোথাও কোথাও মার্চের প্রথম সপ্তাহ লেগে যায়।

এরপরের ক্ষতিটা হয় মার্চের মাঝামাঝিতে। টানা দুই দিনের বৃষ্টিতে বিলম্বিত মুকুলের অনেকটা পচে যায়। যেটুকু মুকুল রক্ষা পায় তা থেকে গুটি ধরার ধাপ বাধাগ্রস্ত হয় এপ্রিলজুড়ে চলা তাপপ্রবাহে।

শীত দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে মুকুল আসতে দেরি, তাপপ্রবাহের কারণে অনাবৃষ্টিতে গুটি ঝরে যাওয়া এবং আমের ‘অফ ইয়ার’ হওয়া এবার আমের ফলনে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের’ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর অন্তত ১৫ শতাংশ আম উৎপাদন কম হতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছর আম উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। এবারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ লাখ মেট্রিক টন।

গরমে এবার গাছেই অনেক আম নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজশাহীর আমের সবচেয়ে বড় মোকাম বানেশ্বর হাটের আড়তদার আব্দুল মতিন।

তিনি আরও জানান, এখন বাজারে গোপালভোগ আম উঠেছে। প্রতি মণ আম বিক্রি হচ্ছে আড়াই হাজার থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা। গতবার এই দাম সর্বোচ্চ এক হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত ছিল।

ফল গবেষণা কেন্দ্রের (বিএআরআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম মনে করছেন, এবার কোনোভাবেই আম-লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।

তিনি বলেন, “গত বছরের উৎপাদনের হিসাব অনুসারে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। গত বছর আম-লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। এবার মুকুলই ঠিকমতো আসেনি। গত বছরের তুলনায় এবার ৬০ শতাংশ মুকুল এসেছে।”

নওগাঁর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, এবার আমের উৎপাদন কিছুটা কম হতে পারে। তাই উৎপাদনের পরিস্থিতি এখনই বলা সম্ভব নয়। জেলায় এবার ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। এতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন।

চলতি মৌসুমে আম-লিচুর ফলন কিছুটা কম হবে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন খান।

তিনি বলেন, “তাপদাহের পর ঘূর্ণিঝড়েও বেশ ক্ষতি হয়েছে। সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের আবহাওয়াও কিছুটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এর ফলে, যে সময় ফলন হওয়ার সে সময় হয়নি। প্রক্রিয়াটা বিলম্বিত হয়ে গেছে। এত দিনে অনেক জায়গায় ফল ওঠা শুরু করে। এসব কারণেই এবার তা হচ্ছে না।”

আম ক্যালেন্ডার

দেশের একেক অঞ্চলের আম একেক সময়ে বাজারে আসে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সাতক্ষীরার হিসাবে, জেলায় আম সংগ্রহ শুরু হয়েছে ৯ মে গোপালভোগ দিয়ে।

রাজশাহীর ‘ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার’ অনুযায়ী, এ বছর সব জাতের গুটি আম ১৫ মে, গোপালভোগ বা রানিপসন্দ ২৫ মে, লক্ষ্মণভোগ বা লখনা ৩০ মে এবং একই তারিখে হিমসাগর বা ক্ষীরশাপাতি আম গাছ থেকে নামানোর কথা।

এ ছাড়া ১০ জুন থেকে ল্যাংড়া ও ব্যানানা আম; ১৫ জুন আম্রপালি এবং একই তারিখে ফজলি, ৫ জুলাই বারি-৪ আম, ১০ জুলাই আশ্বিনা, ১৫ জুলাই গৌড়মতি ও ২০ আগস্ট থেকে ইলামতি আম নামানো যাবে।

এ ছাড়া কাটিমন ও বারি-১১ আম সারা বছর সংগ্রহ করা যাবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত