অর্থনীতির উদ্বেগজনক সূচক রিজার্ভ নিয়ে সংকটে থাকা বাংলাদেশে রেমিটেন্সই উত্তরণের বড় হাতিয়ার। বাংলাদেশিরা যত বেশি কাজ নিয়ে বিদেশে যাবে, তত বেশি ডলার তারা পাঠাবে, তা মজবুত করবে দেশের অর্থনীতি।
বছর শেষে ২০২৪ সালে জনশক্তি রপ্তানিতে বড় ধরনের ধস দেখল বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে জনশক্তি রপ্তানিতে যেখানে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখেছিল, ২০২৪ সালে এসে তার উল্টো ঘটনা ঘটলো। প্রবৃদ্ধির বদলে সাড়ে ২২ শতাংশ কম জনশক্তি রপ্তানি করতে পেরেছে বাংলাদেশ।
মোট জনশক্তি রপ্তানিতে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মালয়েশিয়া-এই তিনদেশের ওপর নির্ভরতা আগে থেকেই ছিল।
বাংলাদেশি কর্মীদের গন্তব্য রাষ্ট্র হিসাবে সৌদি আরব বরাবরই বেশি এগিয়ে থাকত। কিন্তু এবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির ওপর নির্ভরতা অনেক বেশি বেড়েছে। মোট কর্মীর ৬২ শতাংশই গেছে সেখানে। এরপরও বাংলাদেশ থেকে মোট কর্মী রপ্তানিতে ধস ঠেকানো যায়নি।
২০২৪ সালে কত কর্মী রপ্তানি হয়েছে, সেই তথ্য এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। যেই মন্ত্রণালয় সামলান উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে জনশক্তি রপ্তানির তথ্য সংগ্রহ করেছে সকাল সন্ধ্যা। সেই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির ১০ লাখ ১০ হাজার জনের মধ্যে ৬ লাখ ২৭ হাজার জনই গেছে সৌদি আরবে।
২০২৩ সালের কর্মী রপ্তানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই বছর ৪ লাখ ৮ হাজার কর্মী যান সৌদি আরবে। বছরটিতে কর্মী রপ্তানিতে সৌদির অবদান ছিল ৩৮ শতাংশ।
২০২২ সালে মোট কর্মী রপ্তানিতে সৌদি আরবের অবদান ছিল ৫৩ শতাংশ; সংখ্যায় ছিল ৬ লাখ ১২ হাজার জন।
কোভিড মহামারির আগে ২০১৯ সালে কর্মী রপ্তানিতে সৌদির অবদান ছিল ৫৬ শতাংশ। কিন্তু এবারই প্রথম ৬২ শতাংশ ছাড়ালে।
শুধু তাই-ই নয়; ২০২৪ সালে জনশক্তি রপ্তানিতে অনন্য রেকর্ড গড়েছে সৌদি আরব। দেশটি এক বছরে এর আগে সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মী নিয়েছিল ২০২২ সালে; সংখ্যাটি ছিল ৬ লাখ ১২ হাজার জন। কিন্তু এবার সেই রেকর্ড ভেঙে ৬ লাখ ২৭ হাজার জন গেছে সৌদি আরবে।
বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ১৬৮ দেশে ১৯৭৩ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রতিবছর যে কর্মী রপ্তানি হয়, তার মধ্যে ২০২২ সালের সৌদি আরবের রেকর্ডই ছিল এর আগ পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
জনশক্তি রপ্তানির সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৪ সালে সৌদি আরবের অবদান যদি এত বেশি না থাকত, তাহলে বাংলাদেশ থেকে কর্মী রপ্তানি তলানিতে ঠেকত। বিশেষ করে বছরের শেষ তিন মাসে লাখের পর কর্মী রপ্তানির কারণেই বিশাল ধস ঠেকানো গেছে।
কর্মী কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জনশক্তি কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কেন্দ্রীয় অফিসের উপ পরিচালক (বহির্গমন শাখা) মোহাম্মদ জহিরুল আলম মজুমদার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রধানত ৩/৪টি দেশের ওপর নির্ভরতা বেশি। ফলে দেখা গেছে কোনও দেশে কর্মসংস্থান কম হলে অন্য দেশ সেটি কাভার করে ফেলে। এবারও তাই হয়েছে।
“আমাদের বড় শ্রমবাজারের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও ওমান বন্ধ আছে। ফলে সৌদি আরব ৬২ শতাংশ কর্মী নিয়ে সেটি কাভার করেছে। সেই তিন দেশ চালু থাকলে এবার গত বছরের চেয়ে বেশি কর্মী রপ্তানি হত।”
তবে জহিরুল এটাও মনে করেন, এককভাবে একটি দেশের ওপর শ্রমবাজার নির্ভরশীল হলে ঝুঁকি থাকে।
“ফলে আমরা বিকল্প খুঁজছি। আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, আফ্রিকার বেশকিছু ছোট দেশে আমরা কর্মী রপ্তানি করেছি গত বছর। এগুলো পরিমাণে কম হলে বেতন-ভাতা ভালো। ফলে আরও ভালো বিকল্প খুঁজতে আমাদের বিদেশের দূতাবাস সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।”
ওমান শ্রমিক নেওয়া বন্ধ রেখেছে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি শেষ। আমিরাতে প্রবাসীরা জুলাই আন্দোলনের সময় মিছিল করায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিচ্ছে না দেশটি।
জহিরুল বলেন, “আমরা আশা করছি, দুটি দেশ শিগগিরই খুলবে। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু ভিসা অনুমতি না থাকায় আমরা কর্মী পাঠাতে পারছি না।”
জনশক্তি কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে বিদেশে কর্মী গেছে ১০ লাখ ১০ হাজার জন। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে চাকরি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মী গিয়েছিল ১৩ লাখ ৫ হাজার জন। অর্থাৎ ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে কর্মী রপ্তানি কমেছে সাড়ে ২২ শতাংশ, সংখ্যরার দিক থেকে কমেছে ২ লাখ ৯৪ হাজার জন।
অবশ্য কর্মী রপ্তানি কমলেও এর নেতিবাচক প্রভাব এখনও রেমিটেন্সে পড়েনি। তবে সামনের দিনগুলোতে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত এক এজেন্সির শীর্ষ কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখন রেমিটেন্সের যে গতি, তা আগের বছরগুলাতে কর্মী রপ্তানির সুফল। এখন যে কর্মী রপ্তানি কমেছে, তার প্রভাব পড়বে ২০২৬ সালে। কারণ একজন কর্মী যখন বিদেশে যান, প্রথম বছরে মিনিমাম টাকা পাঠান। বিদেশ যাওয়ার জন্য যে ঋণ নিয়েছেন, সেটি পরিশোধ করতে তার অন্তত দুই বছর লেগে যায়। তৃতীয় বছর থেকেই সে মুলত নিয়মের বাইরে বাড়তি টাকা পাঠাতে পারেন।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২৪ সালে ২ হাজার ৬৮৮ কোটি ৮৬ লাখ (২৬.৮৯ বিলিয়ন) রেমিটেন্স দেশে এসেছে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি।
বৈদেশিক কর্মসংস্থানে শীর্ষে কারা
২০২৪ সালে বাংলাদেশি কর্মীদের গন্তব্যে সৌদি আরবের পরে রয়েছে মালয়েশিয়া। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে গেছে ৯৩ হাজার জন, যা মোটের ৯ শতাংশ। ফলে দেখা যাচ্ছে প্রথম স্থানের (সৌদ আরব) সঙ্গে দ্বিতীয় স্থানের ব্যবধান কতটা বড়।
তৃতীয় স্থানে থাকা কাতারে কর্মী গেছে সাড়ে ৭৪ হাজার জন; মোট কর্মীর হিসাবে এর পরিমাণ ৭ শতাংশ। চতুর্থ স্থানে থাকা সিঙ্গাপুরে কর্মী গেছে সাড়ে ৫ শতাংশ, পঞ্চম স্থানে থাকা আমিরাতে গেছে পৌন ৫ শতাংশ, ষষ্ট স্থানে থাকা কুয়েতে গেছে ৩ শতাংশ।
অর্থ্যাৎ হিসাব কষলে দেখা যায়, দ্বিতীয় স্থান থেকে ষষ্ঠ স্থান পর্যন্ত পাঁচটি দেশে কর্মী গেছে মোট কর্মীর ৩০ শতাংশ। আর সৌদি আরবে একাই গেছে ৬২ শতাংশ।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সৌদি আরবের পরের স্থানে ছিল মালয়েশিয়া। সেখানে মোট কর্মী গিয়েছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার জন, যা বিদেশে মোট কর্মসংস্থানের ২৭ শতাংশ।
প্রায় ১০ শতাংশ যায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে, শীর্ষ গন্তব্যের তালিকায় দেশটি ছিল তিন নম্বরে। আর সেই দেশে কর্মী গেছে ১ লাখ ২৮ হাজারের কিছু বেশি।
চতুর্থ স্থানে থাকা আমিরাতে কর্মী যায় প্রায় ১ লাখ জন। মোট কর্মসংস্থানের হিসাবে তা সাড়ে ৭ শতাংশ। সেই দেশে ২০২৩ সালে বৈধভাবে কর্মী যাওয়া কিছুটা কমেছে। কিন্তু অবৈধভাবে অর্থ্যাৎ ভ্রমণ ভিসায় ব্যাপক সংখ্যক লোক গত দুই বছর আরব আমিরাতে গেছে।
পঞ্চম স্থানে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ কাতার। সেখানে ২০২৩ সালে কর্মী গেছে ৫৬ হাজারের কিছু বেশি; শতাংশের বিচারে এর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ।
জনশক্তি রপ্তানিকারকরা আশায় ছিল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখবেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার অবস্থান কাজে লাগিয়ে সেখানে ইতিবাচক সাড়া মিলবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় দুবাইয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি। সরকার পতনের পর ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে আমিরাত সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন তাদের ছেড়ে দিতে। তাতে সাড়াও পেয়েছিলেন। কিন্তু আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তাতে সাড়া মেলেনি। ফলে ২০২৪ সালে সেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
জনশক্তি রপ্তানির একাধিক এজেন্সির কর্মকর্তা বলেন, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাতের শ্রমবাজার কূটনৈতিক চ্যানেলে তদবির করে খুলে দেওয়ার যে আশা তারা করেছিলেন, তাতে হতাশই হতে হয়েছি।
তাদের একজন বলেন, “গত পাঁচ মাসে বড় কোনও উদ্যোগই আমরা দেখিনি। উপরন্তু দুর্নীতি মামলা মোকদ্দমার ফেলে প্যানিক তৈরি করা হয়েছে। আমাদের কথা হচ্ছে, যারা অনিয়মের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করে তাদের শাস্তি দিন।
“সবাইকে একই কাতারে ফেলে আতঙ্ক ছড়িয়ে আখেরে শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ফলে আমাদের মনে হয় একটি নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত কর্মসংস্থান আগের গতিতে ফেরা হবে না।”
তাদের মতে, ২০২৩ সালে ১২ মাসে ১৩ লাখ কর্মী গেছেন। অর্থ্যাৎ প্রতিমাসে গড়ে এক লাখ ৮ হাজার কর্মী চাকরি নিয়ে বিদেশ গেছেন। এবার সেটি প্রতিমাসে গড়ে ৮৪ হাজারে নেমেছে। এখন বড় কূটনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া সেই ধারায় ফেরা কঠিন, একইসাথে চ্যালেঞ্জিংও বটে।