‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ কী করে এলো জানতে গেলে একের বেশি লোককথা মেলে। এসব ইতিহাস শুধু যুগলের ভালোবাসার কথাই বলে না। ভালোবাসার বন্ধনকে সারাজীবনের করে নিতে দুজনকে বিয়েতে বাঁধা পড়ার কথাও বলে।
রোমান রাজা দ্বিতীয় ক্লডিয়াস তার আমলে তরুণদের জন্য বিয়ে নিষিদ্ধ করে দিলেন। হঠকারি ক্লডিয়াসের বিশ্বাস ছিল, পিছুটান না থাকায় অবিবাহিতরা যুদ্ধের ময়দানে অকুতোভয় লড়ে যায়। রাজা ক্লডিয়াস বলতেন, বিবাহিত পুরুষ কখনই ভালো যোদ্ধা নয়। রাজার এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এগিয়ে এলো তরুণ ভ্যালেন্টাইন। গোপনে অনেক যুগলের বিয়ে সম্পন্ন হলো তার কারণেই। অচিরেই রাজার কানে গেল এসব। তারপর ভ্যালেন্টাইনকে নিক্ষেপ করা হলো কারাগারে।
এমন অনেক গাথা সঙ্গী করে বহু যুগ ধরে ১৪ ফেব্রুয়ারি হয়ে উঠেছে ‘ভ্যালেনটাইন ডে’। এই ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে পাখিরা চঞ্চল হয়ে ওঠে তাদের সঙ্গী বেছে নিতে। অনেক পাখিই এই সময় বাসা বাঁধে এবং প্রজনন করে। ফেব্রুয়ারির এই সময়টা তাই পাখিদের বিয়ের মওসুমও।
১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা রাজ্যের ব্যাটন রুজ শহরের মেয়র, গভর্নর এবং বিশপের কাছে আর্জি জমা পড়লো; ‘ভ্যালেনটাইনস ডে’ থেকে হোক ‘উই বিলিভ ইন ম্যারেজ ডে’। অর্থাৎ বিয়ে প্রথাতে বিশ্বাস রাখার কথা ছড়িয়ে দিতে চাইলো সবাই।
এই প্রস্তাব আগলে নিলো ওয়ার্ল্ডওয়াইড ম্যারেজ এনকাউন্টারস ন্যাশনাল লিডারশিপ এবং ক্যাথলিক ম্যারেজ এনকাউন্টার। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় রবিবার উদযাপন শুরু হলো ‘বিশ্ব বিবাহ দিবস’।
ইংরেজি ‘ম্যারেজ’ শব্দের বাংলা হলো বিয়ে। বাংলাতে বৈবাহিক অবস্থা প্রকাশে অনেক নাটকীয়তা রয়েছে।
বিয়ে করা না বিয়ে বসা?
এক সময় মেয়েদের বেলায় প্রশ্ন আসতো, বিয়ে হয়নি? অর্থাৎ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন পুরুষ বিয়ে করে একজন নারীকে। বিয়ে করায় নারীকে কর্তাবাচকে দেখতে চাইতো না সমাজ। এখন অবশ্য এসব সামাজিক কথায় বিব্রত না হয়ে বিয়ে না করা অনেক নারী পাল্টা উত্তরে বলছে, “বিয়ে হয়নি নয়, বিয়ে করিনি।”
কাইল আমরার কুসুম রানির বিবাহ হইবো
হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় বাটনা বাটা, মশলা কুটার বিশাল যজ্ঞে নারীরা গলা মেলায় গানে; “কাইল আমরার কুসুম রানির বিবাহ হইবো।”
অনেকের মনে হতে পারে গানে যেভাবে ‘বিবাহো’ উচ্চারণ করা হয়েছে তা বুঝি আঞ্চলিকতা। আসলে শুদ্ধ বানান বিবাহ হলেও, এই শব্দের উচ্চারণ হবে ‘বিবাহো’।
এখন থেকে বিয়ের বর্ষপূর্তিতে উপহার হাতে আপনার জীবনসঙ্গীকে বাংলায় শুদ্ধ উচ্চারণে বলুন ‘শুভ বিবাহ বার্ষিকী’।
বিয়ে থা করে থিতু হওয়া
বিবাহ শব্দের কথ্য রূপ হলো বিয়ে। আবার আঞ্চলিক টানে ‘বিয়া’ হয়। উত্তরবঙ্গের ভাষায় বলে ‘বেহা’। যে অঞ্চলে যে টানেই বলা হোক, অবিবাহিতদের জন্য পরিবার-বন্ধুবান্ধব থেকে পাড়াপড়শির একটাই কথা থাকে, “বিয়ে থা করে থিতু হবে কবে?” এর অর্থ সময় না গড়িয়ে শিগগিরই আপনাকে বিয়ের আয়োজনে নেমে যেতে হবে।
কেউ মালা বদল সেরেছে অথবা কেউ কবুল বলেছে, এর মানে হলো সে এবার বিয়ে থা করে থিতু হয়েছে।
বিয়ের ফুল ফোটা
অভিধান বলছে বিয়ের যাবতীয় লক্ষণ দেখা দিলে বুঝে নিতে হবে আপনার বিয়ের ফুল ফুটেছে। যদি কেউ বলে বিয়ের ফুল ফুটেছে, তবে এর মানে বিয়ে তারিখ আসন্ন। অর্থাৎ দিন-তারিখ পাকাপাকি হয়ে গেছে; এখন শুধু চূড়ান্ত ক্ষণ গোনার পালা।
যাদের এই কদিনের তর সয় না, তাদের আবার ‘বিয়েপাগলা’ নয়তো ‘বিয়েপাগলী’ বলে মুখ টিপে হাসে বাকিরা।
দিল্লি কা লাড্ডু
ঘি আর নানা রকম বাদাম মিশিয়ে চোখ কাড়া রঙের দিল্লি কা লাড্ডুর খ্যাতি জগত জোড়া। জিভে এই লাড্ডুর স্বাদ পেতেই একটা খেয়ে থামবে না কেউ। আর যদি টপাটপ অনেকগুলো খেয়েছেন তো পরে পেট গুড়গুড়ের আওয়াজে ঠিক পস্তাতে হবে। এ কারণেই লোকে বলে দিল্লি কা লাড্ডু না খেলে তো পস্তাবেনই, আবার খেলেও পস্তাবেন।
ভারতে বিয়ের সময় লাড্ডুর বন্দোবস্ত করা ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। বিয়ে করাকেও মজা করে এই লাড্ডুর সঙ্গে তুলনা করা হয়। বিয়ে না করলে বৈবাহিক জীবনের আনন্দ-বৈচিত্র্য থেকে বঞ্চিত রযে গেলেন। আবার বিয়ে করেছেন তো সংসারের হরেক দায়িত্বের চাপে নাভিশ্বাস উঠে যায় নারী-পুরুষ দুজনেরই। তখন কখনও না কখনও কপাল চাপড়ে মনে হয়, এই দিল্লি কা লাড্ডু খেয়ে মানে বিয়ে করে বুঝি সত্যি সত্যিই পস্তালেন।
শাদি আর নিকাহ
বিয়ের অনেক নিমন্ত্রণ পত্রে কারুকাজ করে বড় অক্ষরে ‘নিকাহ’ লেখা থাকে। আরবি ‘নিকাহ’ শব্দে অর্থ হলো বিয়ে।
হিন্দি ও উর্দুভাষীরা সাধারণত ‘শাদি’ শব্দটি বলে থাকেন। বাংলাদেশেও অবিবাহিতদের অহরহ শুনতে হয়, বিয়ে-শাদি কবে হচ্ছে? যদিও বিয়ে আর শাদি একই অর্থই বহন করে।
ছাদনা তলায় বিয়ের পিঁড়িতে
‘ছাদন’ শব্দের অর্থ আবরণ। সাধারণত হিন্দু বিয়েতে চাঁদোয়া তলে মণ্ডপ সাজানো হয়। একটু খরচ করা হিন্দু ও মুসলিমদের বিয়ের আসরে বন্ধু-স্বজনরা কারুকাজ করা কাপড় মেলে ধরেন; যার তল দিয়ে হেঁটে আসে বর ও কনে। কেউ ছাদনা তলায় বসেছে মানে এবার তার বিয়ের পর্ব সারা হলো।
পিঁড়িতে বসে কাজ করার চল কমে গেলেও বিয়ে প্রথা যতদিন টিকে আছে ততদিন বিয়ের পিঁড়িও থাকবে। আর এই বিয়ের পিঁড়ি তো সাদামাটা বসার পিঁড়ি নয়। কাঠের চওড়া পাটাতনে উজ্জ্বল রঙ করে তার উপর হাতে আঁকা হরেক নকশায় সেজে ওঠে বিয়ের পিঁড়ি। বর আর কনের নামও লেখা হয় পিঁড়ির বুকে।
সাত পাকে গাঁটছড়া বাঁধা
হিন্দু বিয়ের এক পর্যায়ে বর ও কনের জামার কোনা গিঁট দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয়। যেন দুজনের সাহচার্য অটুট থাকে আজীবন। সেই থেকে বিয়ের আরেক পরিভাষা হয়ে উঠেছে গাঁটছড়া বাঁধা।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা সেনের ‘সাত পাকে বাঁধা’ সিনেমাটি অনেকেরই দেখা হয়ে থাকবে। হিন্দু প্রথার বিয়েতে সাত পাকের বন্ধন অর্থ জন্ম-জন্মান্তরের সঙ্গী হওয়া; এ যেন বিয়ের অর্থকে আরেকটু বেশি গাঢ় করে তোলে।
কেউ যদি হয় পাণিপ্রার্থী
কেউ যদি বলে সে পাণিপ্রার্থী, তাহলে তাকে গ্লাস ভরে পানি ঢেলে দিলে নিজের এই বোকামির জন্য নিজে নিজে কপাল চাপড়াবেন হয়তো। পাণি অর্থ হাত। কেউ আপনার পাণিপ্রার্থী মানে সে আপনার হাত চাইছে। অর্থ্যাৎ এবার বিয়ের সানাই বাজার আভাস দেখা যাচ্ছে। বিয়ের গল্পে বলতে শোনা যায়, চার হাত এক হলো। কনের এক জোড়া হাত আর বরের এক জোড়া হাত মিলে গেলে তারা আজীবনের জন্য সঙ্গী হয়ে ওঠে। বিয়ে হলো সেই চার হাত এক করার যুগ যুগের সামাজিক প্রথা।