দুইশ বছরের ইতিহাসে বিচার বিভাগ স্বাধীন করতে ৫৭ বার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সবসময়ই ক্ষমতাসীন শাসকদের সদিচ্ছার অভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি বলে মনে করেন সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মাসদার হোসেন।
যিনি আলোচিত ‘মাসদার হোসেন মামলা’র বাদী। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করতে ১৯৯৪ সালে মামলাটি করেছিলেন তিনি। জেলা জজ ও জুডিশিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মাসদার হোসেন এখন রয়েছেন অবসরে।
শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘বিচার বিভাগ সংস্কার প্রস্তাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনি। নিজের বক্তব্যে ‘মাসদার হোসেন মামলা’র রায়ের আলোকে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার উদ্যোগী হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য মাসদার হোসেন বলেন, “এখন যে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সংবিধানের যে বিধান, তারই আলোকে তিনি বিচার বিভাগ আলাদা করে একটা প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারেন।
“কিন্তু তিনি ধরনা ধরেছেন আসিফ নজরুলের কাছে। ওখান থেকে কি ক্লিয়ারেন্স আসবে? অতীত ইতিহাস তো তুলে ধরলাম আপনাদের কাছে। এই ২০০ বছরে কেন এল না, কাদের কারণে?”
তবে বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার বিষয়ে এখনও আশাবাদী মাসদার হোসেন।
তিনি বলেন, “যখন মামলা করতে গিয়েছিলাম, তখন আমার সহকর্মী সকল বিচারকরা বলেছিলেন, এটা জীবনেও কাযর্কর হবে না। কিন্তু পথচলা তো শুরু হয়েছে। আমি এখনও আশাবাদী।”
মাসদার হোসেন মামলার চূড়ান্ত শুনানি করে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে ঐতিহাসিক এক রায় দেয়। ওই রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বিসিএস (বিচার) ক্যাডারকে সংবিধান পরিপন্থি ও বাতিল ঘোষণা করে।
একই সঙ্গে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস ঘোষণাসহ বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা দেয় আপিল বিভাগ।
এ রায়ের আলোকে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা করার বিষয়ে ঘোষণা আসে। কিন্তু নানা কারণে বাস্তবায়ন হয়নি সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ।
মাসদার হোসেন বলেন, ২০০ বছরের ইতিহাসে কোনও দিনই বিচার বিভাগ স্বাধীন ছিল না। এই ২০০ বছরে ৫৭ বার বিচার বিভাগকে পৃথক করার উদ্যোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনও বারই সফল হয়নি।
“মাসদার হোসেন মামলার রায়ে শুধু কাগজে-কলমে বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে, সেটা আপনারাই (অন্যান্য বক্তা) বললেন, কিন্তু আসলে পৃথক হয়নি।”
মাসদার হোসেন মামলার ১২ দফার ৮ দফার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “রায়ে বলা হয়েছে যে, সংসদ এবং প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে হবে বিচার বিভাগকে। তা কী হয়েছে? হয়নি। এটা হবে? একটা বিগ কোয়েশ্চেন? এখন যে সুযোগ এসেছে, যে সুযোগ এই বৈষম্যবিরোধী কোমলমতি ছাত্ররা আমাদেরকে এনে দিয়েছে।”
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবির মধ্যেও বিচার বিভাগ স্বাধীন করার বিষয়টি উল্লেখ ছিল বলে জানান মাসদার হোসেন।
১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বাকশাল চালু করা হয়। সম্প্রতি চতুর্থ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেছেন এক মুক্তিযোদ্ধা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করতে পারেছে কিনা, এমন প্রশ্ন রেখে মাসদার হোসেন বলেন, “এখন যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেছে, আমি সম্মানের সঙ্গে বলছি, তারা কী ভাল কাজ করতে পারছে? তারা কী জনগণের আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করতে পারছে?
“২৩ জনের নিয়োগ নিয়ে আপনারা কথা বলেছেন (২৩ বিচারপতি)। অতীতে বিচার বিভাগে এ রকম নিয়োগ কখনও হয়নি। তো কী করল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার?”
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনসহ বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গত ৩ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনে ৫ সদস্যের বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।
প্রজ্ঞাপন জারির দিন থেকেই এ কমিশন কাজ শুরু করেছে। ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনের প্রতিবেদন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া কথা রয়েছে।
এ সময়ের মধ্যে বিচার বিভাগের সংস্কার নিয়ে প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হবে না উল্লেখ করে মাসদার হোসেন বলেন, “সংস্কার কমিশনের আর এক মাস সময় আছে, এ সময়ের মধ্যে কী কিছু করা সম্ভব? সবপক্ষের সঙ্গে আমাদের কথা বলা উচিত। সব পেশাজীবীদের আমরা ডাকতে চাই।”
বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সংগঠনের আয়োজনে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন সাবেক যুগ্ম জেলা জজ মো. সাজ্জাদ হোসাইন বাবু, আপিল বিভাগের আইনজীবী ও সাবেক অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুর রহমান জীবলসহ অন্যরা।