ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। অস্ত্র আইনের এক মামলায় তার রিমান্ড মঞ্জুর হয়।
বুধবার ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে রিমান্ড শুনানি চলাকালে নিজের বক্তব্য দিতে গিয়ে কাঁদেনও তিনি।
বুধবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভাটারা থানার উপপরিদর্শক মো. রুবেল মিয়া আসামি মতিউরকে আদালতে হাজির করে হেফাজতে রেখে ১০ দিন জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, আসামির কাছে উদ্ধার করা অস্ত্রটি মেয়াদবিহীন এবং এ অস্ত্রের বিপরীতে ইস্যু করা ২৫ রাউন্ড শীসা কার্তুজের কথা উল্লেখ থাকলেও ১ রাউন্ড গুলি পাওয়া যায়নি। জিজ্ঞাসাবাদে আসামি জানিয়েছেন, তার অস্ত্রের লাইসেন্সের মেয়াদ ২০২১ সালে উত্তীর্ণ হয়েছে। তবে যে এক রাউন্ড গুলির হিসাব মেলেনি, সে বিষয়ে সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি তিনি।
“আসামি অসৎ উদ্দেশ্যে অবৈধভাবে লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি নিজ হেফাজতে রেখে অস্ত্র আইনে অপরাধের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে মামলার মূল রহস্য উদঘাটন, হারিয়ে যাওয়া এক রাউন্ড গুলি কী উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে তা জানার জন্য, আসামির কাছে আরও কোনও আগ্নেয়াস্ত্র আছে কিনা তা জানার জন্য পুলিশ হেফাজতে নিয়ে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।”
আর সে কারণেই তাকে ১০ দিনের জন্য হেফাজতে চেয়ে আবেদন করে পুলিশ।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী, অন্যদিকে আইনজীবী আবু সুফিয়ান রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন।
ওমর ফারুক শুনানিতে বলেন, “আসামির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থাকায় দুদক মামলা দায়ের করেছে। আজকে তার স্ত্রীকে সেই মামলায় কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন মহানগর দায়রা জজ আদালত। এই মতিউর আওয়ামী ফ্যাসিস্ট রেজিমে সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম। তার হাত ধরে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে।
“দুদকের মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালালে তার বাসা থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এই অস্ত্র বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে ব্যাবহার হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে তাকে রিমান্ডে নিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। আমরা তার সর্বোচ্চ ১০ দিনের রিমান্ড চাই।”
এরপর আসামিপক্ষে আবু সুফিয়ান রিমান্ড বাতিল চেয়ে শুনানি করেন। তিনি বলেন, “আসামি মতিউর তার নিজ যোগ্যতাবলে এনবিআরের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সরকারের দেওয়া উপহারে অনেক টাকা অর্জন করেছেন। তার অবৈধ কোনও সম্পদ নেই। আর আজ যে মামলায় তাকে রিমান্ডে চাওয়া হয়েছে সেখানে রিমান্ডে নেওয়ার কোনও যৌক্তিকতা নেই।
“তিনি টেস্ট করার জন্য এক রাউন্ড গুলি ফায়ার করেছিলেন। তবে এ বিষয়ে কোনও জিডি করেননি। এটাই তার ভুল। আর যে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে সেটা লাইসেন্স করাই ছিল তবে নবায়ন করা ছিল না। রিমান্ডে নিলে তিনি এসব কথাই বলবেন।”
এরপর আদালত মতিউরের বক্তব্য শুনতে চান।
তখন মতিউর বলেন, “আমি কাস্টমসে থাকাকালে কাস্টমের অটোমেশন হয়। আমি আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধা নেইনি বরং আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে ওএসডি করা হয়।আমাকে শিবির ক্যাডার হিসেবে তকমা দিয়ে প্রায় দেড় বছর ওএসডি করে রাখে সরকার। পরবর্তীতে আমি পুনরায় চাকরিতে যোগদান করি।
“আমার দেওয়া সিদ্ধান্তে পোশাক খাতে সরকারের ২৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়। আমার এসব উদ্যোগের জন্য তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়তে হয়। আমাকে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করা হয়। এক পর্যায়ে আমাকে জোর করে রাজস্ব অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে বসায়।”
ট্রাইব্যুনালে থাকাবস্থায় এক টাকারও দুর্নীতি করেননি জানিয়ে তিনি বলেন, “ট্রাইব্যুনালের ১২ হাজার মামলা জট নিষ্পত্তি করেছি। ভাইরালের ব্যাপারটা মূলত তখনকার রাসেলস ভাইপার সাপ আতঙ্ক থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে ছাগলকাণ্ডে আমার পরিবারকে জড়ানো হয়। আমি ছয় বছর ধরে সেই ছেলের কাছ থেকে ডিটাচড (আলাদা) ছিলাম। এই সুযোগে সরকার গোয়ান্দাদের ব্যবহার করে আমার ১৬ বছরের ছেলেকে দিয়ে নাটক মঞ্চায়ন করে।”
কথার এ পর্যায়ে কাঁদতে শুরু করেন মতিউর রহমান। তিনি আদালতকে বলেন, “ কান্নারত অবস্থায় তিনি বলেন, ”সব কথা তো বলতে পারছি না তবে আমার গল্প শুনলে প্রত্যেকটা মানুষের হৃদয় কাঁদবে। কোনও কিছু না জেনে দয়া করে একটা ফ্যামিলিকে ধ্বংস করবেন না। ইনশাআল্লাহ আমাদের ফ্যামিলির বিরুদ্ধে মামলা টিকবে না।”
উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের ব্যাপারে তিনি বলেন, “টেস্ট করতে আমি একটি মিস ফায়ার করেছিলাম। তবে এ বিষয়ে জিডি না করাটা আমার মিস্টেক হয়েছে।”
এসময় প্রসিকিউটর ফারুকী বলেন, “এসব গল্প সাজানো-গোছানো। আসামি ফ্যাসিস্ট সরকারের আস্থাভাজন ছিলেন বলেন এনবিআরের এতো বড় পদ উপহার দেয় সরকার। তাকে রিমান্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সত্য ঘটনা প্রকাশ পাবে।”
শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম নাজমিন আক্তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিন বিকালেই মতিউরের স্ত্রী লায়লা কানিজকে সরকারি কর্মচারী হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার ও জাল-জালিয়াতির করার অভিযোগের মামলায় কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয় আরেকটি আদালত। একই সঙ্গে তার রিমান্ড শুনানির জন্য আগামী রবিবার দিন ঠিক করে দেওয়া হয়।
গত ১৪ জানুয়ারি দিবাগত রাতে ঢাকার বসুন্ধরা এলাকা থেকে মতিউর রহমান ও লায়লা কানিজকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ।
এর আগে গত ৬ জানুয়ারি লায়লা কানিজের বিরুদ্ধে ১৩ কোটি ১ লাখ ৫৮ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। পাশাপাশি ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগও রয়েছে।
এসব সম্পদ অর্জনে মতিউর রহমান সহযোগিতা করেছেন অভিযোগ করে তাকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে।