Beta
মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪

রাসেলস ভাইপার : প্রাণঘাতী সাপ থেকে ক্ষত নিরাময়ী ওষুধ

সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা চালায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে স্থাপিত ভেনম রিসার্চ সেন্টার।
সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা চালায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে স্থাপিত ভেনম রিসার্চ সেন্টার।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

বিশ্বের সবচেয়ে বিষধর ১৩ সাপের মধ্যে একটি রাসেলস ভাইপার। প্রতি বছর বিশ্বে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ এই সাপের কামড়ের শিকার হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশেও রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপটি নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে; যদিও সাপটি যতটা বিপজ্জনক, শোরগোল তার চেয়ে বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি।

সাপটি প্রাণঘাতী হলেও, বিজ্ঞানীদের কাছে রাসেলস ভাইপারের গুরুত্ব অনেক। কারণ এর দেহে থাকা পেপটাইড (একাধিক অ্যামিনো এসিড দিয়ে গঠিত জৈব অণু) মানবদেহের ক্ষত নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিশ্বব্যাপী ক্ষত নিরাময় বাজার দ্রুত বাড়ছে। প্রতি বছর ত্বকের ক্ষতের চিকিৎসার জন্য অস্বাভাবিকভাবে ব্যয় হয়। আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষের পক্ষে বিপুল অর্থ ব্যয় করে এই চিকিৎসা করা সম্ভবপর হয় না।

ফলে ক্ষত নিরাময়ে কম খরচে উৎপাদন করা যায় এমন প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত ওষুধের চাহিদা রয়েছে।

ভারতের তেজপুর ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা রাসেলস ভাইপার সাপের বিষ থেকে প্রথম ক্ষত নিরাময়ী পেপটাইড আবিষ্কার করেছেন। এই পেপটাইডে জীবাণুনাশক, প্রদাহবিরোধী ও এনজাইম-বিহীন বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা ক্ষত নিরাময়ের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে।

রাসেলস ভাইপার ভারতের বিষাক্ত প্রধান সাপগুলোর একটি। এই সাপের বিষ বহু বছর ধরেই রক্ত জমাট বাঁধার কাজে ব্যবহার হয়ে আসছে।

তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশীষ কে মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণা বলছে, রাসেলস ভাইপারের বিষে যে পেপটাইড রয়েছে তা ত্বকের ক্ষত নিরাময় করতে পারে।

বর্তমান ক্ষত নিরাময়ের ওষুধের বাজার এনজাইমভিত্তিক ওষুধের আধিপত্যে রয়েছে। এই ওষুধগুলো দ্রুত নিরাময়ের জন্য ক্ষত পরিষ্কার রাখে এবং মৃত কোষ সরিয়ে দেয়। অ্যাঞ্জিওজেনেসিসের মাধ্যমে ক্ষত নিরাময়কে সহজ করে এমন ওষুধ বাজারে প্রায় অনুপস্থিত। অ্যাঞ্জিওজেনেসিস হলো একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যেখানে নতুন রক্তনালী তৈরি হয়।

আশীষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “দুঃখজনকভাবে, ত্বকের ক্ষত নিরাময়ে প্রাকৃতিক উৎস থেকে ওষুধের প্রাপ্যতা এখনও সীমাবদ্ধ। যদিও এটি বিশ্বব্যাপী বিরাট বাজার দখল করতে পারে।”

রাসেলস ভাইপারের বিষ মূলত বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত ও অ-বিষাক্ত প্রোটিনের এক জটিল মিশ্রণ। এসব প্রোটিনগুলো বিভিন্ন শারীরিক প্রক্রিয়া প্রভাবিত করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে রক্ত জমাট বাঁধা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও ব্যথা নিরাময়ী ক্ষমতা।

ছোট পেপটাইডগুলো সহজেই ত্বক শোষণ করতে পারে। এর মানে হলো, পেপটাইডগুলো ক্ষতস্থলে সরাসরি প্রয়োগ করা যায়। আর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম। দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার জন্য এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৪ সালে অধ্যাপক আশীষের নেতৃত্বাধীন গবেষক দল রাসেলস ভাইপারের বিষ থেকে ছোট পেপটাইড (রাসেলস ভাইপার ভেনম প্রো-অ্যাঞ্জিওজেনিক পেপটাইড-আরভিভিএপি) আলাদা করতে সফল হয়। এই পেপটাইডের আকার ছোট এবং অ্যাঞ্জিওজেনেসিসকে উদ্দীপিত করার ক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ এটি নতুন রক্তনালীর তৈরি হতে সহায়তা করতে পারে। নতুন রক্তনালী ক্ষতস্থলে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ বাড়ায়।

গবেষকরা আরভিভিএপি ব্যবহার করে ত্রিমভিত্তিক একটি ওষুধ তৈরি করেছেন। এটি প্রথমে ইদুরের শরীরের ক্ষতে প্রয়োগ করে সফলতা পান তারা। আরভিভিপি নিজেই ক্ষত নিরাময়ে ভালো ফল দেয়। কিন্তু এর সঙ্গে অ্যালোভেরা মিশ্রণ করায় নিরাময়ের গতি আরও বাড়ে। কারণ অ্যালোভেরার রয়েছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ।

আরভিভিএপি ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে এবং ক্ষতস্থলে সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়। এছাড়া ক্ষতের প্রদাহ কমিয়ে কোষগুলোকে সক্রিয় করে।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স ও ব্যাঙ্গালুরুর এভুল্যেশনারি ভেনোমিক্স ল্যাবের সহকারী অধ্যাপক কার্তিক সুনাগর।

তিনি মনে করেন, এই পেপটাইডের আবিষ্কারটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এই গবেষণা জোর দিয়ে উল্লেখ করে যে, ভারতের বিষ বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে, বিশেষ করে মানব চিকিৎসায় ওষুধ আবিষ্কারের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষের উপর আরও গবেষণা প্রয়োজন।

আরভিভিএপি হলো রাসেলস ভাইপারের বিষ থেকে পাওয়া প্রথম পেপটাইড যার বৈশিষ্ট্য অনন্য এবং ক্ষত নিরাময়ে এর ভূমিকা রয়েছে। অন্য সাপের বিষেও পেপটাইড পাওয়া যায়। তবে রাসেলস ভাইপারের পেপটাইড অন্যদের থেকে ভিন্ন।

শুধু ওষুধ তৈরিই নয়, পরিবেশের জন্য রাসেলস ভাইপারের গুরুত্বও তুলে ধরছে গবেষকরা। বাংলাদেশেও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাসেলস ভাইপার ইঁদুর খেয়ে যেমন ফসল রক্ষা করে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সাপের বিষ নিয়ে গবেষণার জন্য চট্টগ্রামে স্থাপিত ভেনম রিসার্চ সেন্টারের সহকারী গবেষক আব্দুল আউয়াল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ফুড চেইনে সাপ অনেক প্রাণীকে নিধন করে। যেমন ইঁদুর। যদি অতিরিক্ত সাপ মেরে ফেলা হয়, সেক্ষেত্রে ইঁদুরের সংখ্যা অনেক বাড়বে।

“ইঁদুর যখন বাড়বে, তখন শস্যজাতীয় যত খাবার রয়েছে, তার উৎপাদন কমে যাবে। ইঁদুরবাহিত রোগের প্রকোপের আশঙ্কা তৈরি হবে। এর ফলে যেসব জায়গায় শক্ত মাটি রয়েছে, ইঁদুর যেহেতু শক্ত মাটিতে বাসা করে, সেহেতু সেসব মাটি ধসেরও আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত