Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

জ্যেষ্ঠতম আমলা মতিউল ইসলামের স্মৃতিকথন-১

১৯৫৭ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবুর রহমান, মুনীর চৌধুরী ও মতিউল ইসলাম (বাম থেকে ডানে)।

জীবিত বিশিষ্ট আমলাদের মধ্যে সর্বাধিক বয়োজ্যেষ্ঠ নিঃসন্দেহে মোহাম্মদ মতিউল ইসলাম, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব। তার জন্ম ১৯৩০ সালে, ১৯৪৬-এ কোলকাতা থেকে ম্যাট্রিকুলেশন; তিনি চেয়েছিলেন দাঁতের ডাক্তার হতে কিন্তু তার সার্কেল অফিসার বাবার চাওয়া ভিন্ন— তাকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হতে হবে। ভর্তি হলেন কমার্স কলেজে, কিন্তু ১৯৪৭-এর ভারত ভাগ, কলেজটাকেও ভাগ করল, একাংশ এসে সৃষ্টি হলো চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হতে পড়াশোনা ও আর্টিকেলশিপ শুরু করলেন। এর মধ্যে বড় ভাই নুরুল ইসলাম ১৯৫০ সালে সিএসপি হলেন (বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে অবসর নেন); সেই প্রেরণাতে মতিউল ইসলাম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসলেন এবং ১৯৫২ সালে সিএসপিতে উত্তীর্ণ হয়ে কর্মজীবন শুরু করলেন। ইংরেজিতে লিখিত তার স্মৃতিকথা ‘রিকালেকশনস অব অ্যা সিভিল সার্ভেন্ট টার্নড ব্যাংকার’-এর তিনটি অধ্যায় অনূদিত হলো।

আমার শৈশব (১৯৩০-১৯৪৬)
আমার জন্ম ২৪ জানুয়ারি ১৯৩০, কিন্তু কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেটে জন্ম তারিখ ৬ মার্চ ১৯৩০ রেকর্ড করায় এটাই আমার দাপ্তরিক জন্ম দিবসে পরিণত হয়েছে।

আমার শৈশবের প্রথম স্মৃতি তখনকার ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমার বারহাট্টার, আমার বাবা সেখানে সার্কেল অফিসার ছিলেন। গারো পাহাড়ের পাদদেশে এই বারহাট্টা। পাহাড়ি এলাকায় সফরের সুবিধে করে দিতে সরকার আমার বাবাকে মাহুতসহ একটি হাতির যোগান দিয়েছে। যখন হাতির কাজ থাকতো না আর মাহুত তাকে গোসল করাতে নিকটবর্তী কংস নদীতে নিয়ে যেতো সে সময় আমি হাতির পিঠে চড়তাম। সবচেয়ে মজার দৃশ্য ছিল শুঁড় দিয়ে হাতির ঝর্ণার মতো পানি ছিটানো। আমার বয়স বড়জোর ২-৩ বছর, আমি একটা ময়লা ফুটবল ধুতে গিয়ে পানিতে ডুবে যাচ্ছিলাম আমার বড় বোন সেই ঘটনার কথা মনে রেখেছেন, তিনি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে উদ্ধার করেন।

১৯৩৩ সালের দিকে আমার বাবা বদলি হলেন বিভাগীয় সদর দপ্তর ঢাকায়। কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটের পাশের একটি গলিতে আম্বিকা চরণ প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হলাম। আমার দুই বড় ভাই নুরুল ইসলাম এবং সেরাজুল ইসলাম তখন যেতেন আরমানিটোলা হাই স্কুলে। সে সময় ঢাকা অনেকটা ঘুমন্ত শহর, মাত্র পাঁচ ছ’টা মোটর গাড়ি আর গণপরিবহনের একমাত্র বাহন বহুসংখ্যাক ঘোড়ার গাড়ি। আমরা কখনো কখনো বালিয়াদি জমিদার বাড়ির মোটর গাড়ি নিয়ে নারায়ণগঞ্জে আনন্দ ভ্রমণে বেরোতাম।

দ্বিতীয় পর্ব: জ্যেষ্ঠতম আমলা মতিউল ইসলামের স্মৃতিকথন-২

১৯৩৫ সালের এক সন্ধ্যায় আমরা দেখলাম ঢাকার আকাশ আতশবাজিতে ভরে গেছে। মা আমাদের বললেন, লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে ভাওয়াল সন্যাসী মামলার বিজয় উদযাপন করা হচ্ছে। মার কাছে কাহিনীটা শুনেছি তারা যখন দার্জিলিং বেড়াচ্ছিলেন তার স্ত্রী ও তার প্রেমিক, পারিবারিক চিকিৎসক তাকে বিষ খাওয়ান। তাকে মৃত মনে করে তারা শশ্মান ঘাটে নিয়ে যান, সে সময় ভয়ঙ্কর ঝড় উঠলে শববাহকরা তাকে ফেলে পালিয়ে যায়। একজন তাপস পুজারী তার দেহটি খুঁজে পেয়ে তার কুটিরে নিয়ে যান এবং তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনেন। কয়েক বছর পর ভাওয়াল সন্যাসী ঢাকা আসেন এবং নিজেকে ভাওয়ালের রাজা দাবি করলে তার স্ত্রী সে দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। এ নিয়ে মামলা জেলা আদালত থেকে শুরু করে হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট এবং শেষ পর্যন্ত প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত গড়ায়। দীর্ঘ মেয়াদী এই মামলায় প্রিভি কাউন্সিল রাজার পক্ষে রায় দেয়। আমরা প্রায়ই আরমানিটোলা ময়দানের কাছে ব্যারাকগুলোর পাশ ঘেঁষে যেতাম সেখানে ভাওয়াল রাজার প্রহরীরা থাকতো। ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের আয়োজনে আমি যখন যুক্তরাজ্যে একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যোগ দিই সে সময় প্রিভি কাউন্সিলের একটি অধিবেশনে উপস্থিত থাকার দুর্লভ সুযোগ আমার হয়েছিল।

এক ফালি রানওয়ের উপর অবতরণ করা এক ইঞ্জিনের একটি উড়োজাহাজ দেখাতে আমার বাবা একবার আমাদের ঘোড়ায় টানা ছেকড়া গাড়িতে ধানমন্ডি নিয়ে এসেছিলেন, সে সময় এটা ছিল বিস্তীর্ণ ধান উৎপাদন অঞ্চল। আমাদের জন্য ব্যাপারটা ছিল বেশ উত্তেজনার। উড়োজাহাজের পাইলট ব্যাখ্যা করছিলেন ডাকের চিঠিপত্র বহন করা তার কাজ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল এবং সলিমুল্লাহ হলের গা ঘেষা ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন থেকে তেজগাও পর্যন্ত রেল লাইন নতুন ও পুরোনো ঢাকার মধ্যে বিভাজন রেখা হিসেবে অবস্থান করছিল। বড়রা সাথে না থাকলে আমি কখনো এই বিভাজন রেখা অতিক্রম করার সাহস দেখাইনি। তখন আমি পল্টনে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ সৈনিকদের গ্যারিসন পর্যন্ত হেঁটে যেতাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল এবং সলিমুল্লাহ হলের গা ঘেষা ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন থেকে তেজগাও পর্যন্ত রেল লাইন নতুন ও পুরোনো ঢাকার মধ্যে বিভাজন রেখা হিসেবে অবস্থান করছিল। বড়রা সাথে না থাকলে আমি কখনো এই বিভাজন রেখা অতিক্রম করার সাহস দেখাইনি। তখন আমি পল্টনে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ সৈনিকদের গ্যারিসন পর্যন্ত হেঁটে যেতাম।

ঢাকা থেকে আমার বাবা ময়মনসিংহের জামালপুর বদলি হলেন, সেখানে আমি আবার প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করি। শীত মওসুমে প্রথম ব্রক্ষ্মপুত্র শুকিয়ে যেতো এবং যে কেউ পায়ে হেঁটে ব্রক্ষপুত্র পাড়ি দিতে পারত। নদীর ধারে বেলে মাটির পৃষ্ঠদেশে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তরমুজ চাষের উর্বর জমিনে পরিণত হতো। ১৯৩৮ সালের দিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হবার পর সুভাষচন্দ্র বসু জামালপুর এসেছিলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে ব্রক্ষপুত্র নদে বড় নৌকায় পাতা চেয়ারে তিনি বসেছিলেন এবং নদীর অপর পাড়ে শেরপুর যাচ্ছিলেন।

১৯৩৯ সালের দিকে আমরা জামালপুর থেকে মুন্সিগঞ্জ এলাম। আমার বাবা সেখানকার বিচারিক ম্যাজিষ্ট্রেট হলেন আর সেখানে এসডিও-সাব ডিভিশনাল অফিসার ছিলেন ওয়াজির আলী সাহেব। তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কন্যার জামাতা; শেরে বাংলা প্রায়ই মুন্সিগঞ্জ আসতেন। আমার বড় ভাই নুরুল ইসলাম নবম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করলেন আর আমি প্রথম হলাম ষষ্ঠ শ্রেণিতে। নুরুল ইসলাম ক্লাস নাইনে সম্ভবত প্রথম বারের মতো প্রথম স্থান অধিকার করা মুসলমান ছেলে হওয়ায় ওয়াজির আলী সাহেব একটি পার্টি দিলেন। আমি এবং আমার ছোট বোন একজন পরহেজগার মওলানার অধীনে কোরআন পাঠ সমাপ্ত করলাম।

মুন্সিগঞ্জে হরগঙ্গা কলেজ প্রতিষ্ঠায় প্রখ্যাত দাতা হিন্দু মহাসভার ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এক লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন, কলেজ ময়দানে একটি বড় সভায় তিনি একবার ভাষণ দিয়েছিলেন। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলার মুসলমানদের সম্পর্কে কি বলেছিলেন আমার এখনো মনে আছে। তার মতে মুসলমানরা সৌদি আরব থেকে এসেছে এবং খেজুর খাওয়ার জন্য তাদের আবার সেখানে ফিরে যাওয়া উচিত। আমার মনে হয় মুসলমানদের ব্যাপারে এ ধরণের ঘৃণাই মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর হাতকে শক্তিশালী করেছে।

১৯৪১ সালে শীতলক্ষ্য নদীর পাড়ে নারায়ণগঞ্জে আমার বাবার পদায়ন হলো। এই পোস্টিং এর আগে একজন চিকিৎসকের পরামর্শে হারানো স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে তিনি নারায়ণগঞ্জে দুমাস ছিলেন। আমরা ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া অফিসের উল্টোদিকের দোতলা বাড়ির উপর তলায় আমরা থাকতাম নিচের তলাটি ছিল একটি ছাপাখানার দখলে।

এটা ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। তখন জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করে দূরপ্রাচ্যের ফিলিপাইনস, মালয়, সিঙ্গাপুর, বার্মা দখল করে ভারতের দরজায় কড়া নাড়ছিল। তখনকার সংবাদপত্রগুলো যুদ্ধের সংবাদে পরিপূর্ণ থাকত— জাপানি আত্মঘাতী বোমা ব্রিটিশ রণতরী প্রিন্স অব ওয়েলস ডুবিয়ে দিয়েছে, সিঙ্গাপুর শত্রুদের হাতে চলে গেছে এ ধরণের আরো দুংসংবাদ। মিত্রবাহিনীর ফ্লাইট পরিচালনার পথেই নারায়ণগঞ্জ, আসাম, বার্মা প্রভৃতি স্থানে আক্রমণ চালাচ্ছে। বহুবার আমার চোখ পড়েছে বোমারু আর ফাইটার প্লেনের বহর বোমা ফেলার উদ্দেশ্যে নারায়ণগঞ্জের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জ ছিল একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র, সেখানে মূলত ব্রিটিশদের মালিকানাধীন অনেকগুলো জুট বেইলিং কারখানা ছিল, নারায়ণগঞ্জে কোনো পাটকল ছিল না। প্রথম পাটকল আদমজী স্থাপিত হয়, ১৯৫৩ সালে ভারত ভাগের অনেক পরে। দুটো ক্ষুদ্র শিল্প নারায়ণগঞ্জে বিকশিত হতে শুরু করে (১) নারায়ণগঞ্জ লেমোনেড এবং (২) নারায়ণগঞ্জ হোসিয়ারি। শহরভরা ছোট ছোট লেমোনেড আর হোসিয়ারি দোকান। প্রায়ই রাস্তায় লেমোনেড প্লান্টের সামনে দাঁড়িয়ে দেখতাম কেমন করে একজন বা দু’জন কর্মচারি লেমনেড বোতলে ভরছে। নারায়ণগঞ্জের লেমোনেড বিখ্যাত ছিল এবং ভারতের সর্বত্র সরবরাহ করা হতো। হোসিয়ারি শিল্পের ব্যাপারেও একই কথা। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক পরবর্তী বছরগুলোতে বড় মাপের উৎপাদনকারী এসে যাওয়াতে ক্ষুদ্র শিল্পগুলো মার খেতে থাকলো এবং শেষ পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

১৯৪২-এ আমরা বরিশাল এলাম, আমার বাবা বদলি হলেন মেদিনীপুর। সে সময় বরিশালকে বলা হতো বাংলার শস্যভান্ডার। তারপরও ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষে চালের আকাশ ছোঁয়া দাম—১০ টাকা মণ থেকে ৪০ টাকা মণে উঠে যাওয়া আমাদের পরিবারসহ সকল মধ্যবিত্ত পরিবারকে ভীষণ আঘাত করল। আমরা ১১ ভাইবোন এবং মেদিনীপুর থেকে পাঠানো বাবার নির্দিষ্ট আয় দিয়ে সংসার চালাতে আমার মা হিমশিম খেতেন। সপ্তম শ্রেণি থেকে সাফল্যের সাথে ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া পর্যন্ত আমি বরিশাল জেলা স্কুলে অধ্যায়ন করেছি, তারপর আরো পড়াশোনার জন্য কোলকাতা চলে যাই।

বাংলাদেশের জীবীত বিশিষ্ট আমলাদের মধ্যে সর্বাধিক বয়োজ্যেষ্ঠ মোহাম্মদ মতিউল ইসলাম, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব।

কর্মজীবনের পথ নির্মাণ (১৯৪৬-১৯৫২)
ম্যাট্রিক পাশ করার পর ডাক্তার আর আহমেদ প্রতিষ্ঠিত কোলকাতা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হবার পরিকল্পনা করেছিলাম। তিনি জাহাজের ভেতর লুকিয়ে কোলকাতা থেকে লন্ডন যাচ্ছিলেন। যখন ধরা পড়লেন জাহাজের ক্যাপ্টেন ঠিক করলেন এই চোরাই যাত্রীকে নাবিক ও খালাসিদের প্রতিবেলার খাবারের জন্য বস্তাবস্তা আলু ছিলে তার জাহাজ ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। প্রত্যেকদিন আলু ছিলা খুব যন্ত্রণার কাজ কিন্তু তিনি তা করে গেছেন। লন্ডনে ক’বছর তাকে বেশ কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে তবে শেষ পর্যন্ত ডেন্টিষ্ট্রির ডিগ্রি নিয়ে কোলকাতা ফিরেছেন এবং কোলকাতা ডেন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার এই কাহিনী আমাকে এতোটাই অভিভূত করেছে যে আমিও ডেন্টাল সার্জন হবার সিদ্ধান্ত নিলাম।

কিন্তু আমার বাবা এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি ঠিক করে রেখেছেন আমাকে একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেট হতে হবে আর সে লক্ষে প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে ক্লাইভ স্ট্রিটে অবস্থিত সরকারি মালিকানার ইন্টারমিডিয়েট কর্মাস কলেজে ভর্তি হতে হবে। ক্লাইভ স্ট্রিট এখন সুভাষচন্দ্র অ্যাভেনিউ। এটা ১৯৪৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন পাঞ্জাব থেকে আগত অর্থনীতিবিদ মি. এ. সামাদ। শওকত ওসমান পড়াতেন বাংলা সাহিত্য। ইংরেজি, গণিত, হিসাববিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয় পড়াবার জন্য পণ্ডিত শিক্ষকবর্গ ছিলেন।

কিন্তু কোলকাতায় আমার পড়াশোনা ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হলো যখন কায়েদে আজম জিন্নাহ সিদ্ধান্ত নিলেন যে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টির সমর্থনে ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে পালন করতে হবে। আর এটা থেকে কোলকাতায় পুরোদস্তর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লেগে গেল। মুসলমান হিসেবে আমার পরিচিতি লুকিয়ে রাখতে গিয়ে জীবন অত্যন্ত অনিশ্চিত হয়ে পড়ল, আমার পোশাক কুর্তা পাজামার বদলে শার্ট-প্যান্ট পরতে শুরু করলাম। কলেজে আমার প্রথম বর্ষ শেষ হবার আগেই ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালের জুনে ভারত ভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টির ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা ঘোষণা করলেন। যেহেতু আমাদের পক্ষে আর কোলকাতায় থাকা সম্ভব হলো না আমার শিক্ষা জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। অধ্যক্ষ সামাদের নেতৃত্বে আমাদের কলেজও দুভাগ হয়ে গেল, একভাগ চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হলো।

আমি বরিশালে মা বাবার কাছে ফিরে গেলাম; উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তায় কিছু দিন কাটানোর পর শেষ পর্যন্ত আমাদের জানানো হলো চট্টগ্রামে কর্মাস কলেজ খোলা হয়েছে।

আমি কোলকাতা থেকে আসা তিনজন মুসলমান ছাত্রের একজন, ইন্টারমিডিয়েট কমার্স কোর্স শেষ করতে যাকে চট্টগ্রাম আসতে হয়েছে। আমার বাকী দুই বন্ধু চট্টগ্রাম ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে চাকরি নিল। আমি বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক ডিগ্রির জন্যও চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। এ সময় আমি এটাও সিদ্ধান্ত নিলাম  পেশাগতভাবে চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হবার জন্য কোনো চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস ফার্ম-এ আমাকে পাঁচ বছরের আর্টিকেলশিপ চালিয়ে যাবার উদ্যোগ নিতে হবে। আর্টিকেলশিপ চালাতে আমার ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা লাগবে যা বহন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অধ্যক্ষ সামাদ একটি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস ফার্মের কাছে আমার বিষয়টি তুললেন এবং একেবারে বিনে পয়সায় আমার আর্টিকেলশিপের ব্যবস্থা করে দিলেন। অধ্যক্ষ সামাদ ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অর্থনীতি পড়িয়েছেন।

কিন্তু কোলকাতায় আমার পড়াশোনা ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হলো যখন কায়েদে আজম জিন্নাহ সিদ্ধান্ত নিলেন যে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টির সমর্থনে ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে পালন করতে হবে। আর এটা থেকে কোলকাতায় পুরোদস্তর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লেগে গেল। মুসলমান হিসেবে আমার পরিচিতি লুকিয়ে রাখতে গিয়ে জীবন অত্যন্ত অনিশ্চিত হয়ে পড়ল, আমার পোশাক কুর্তা পাজামার বদলে শার্ট-প্যান্ট পরতে শুরু করলাম।

সারাদিন অডিট ফার্মে কাজ করা এবং স্নাতক ডিগ্রির জন্য সান্ধ্য ক্লাসে হাজির হওয়ায় জীবন কঠিন হয়ে পড়ে। আমি অবিরাম আমার পড়াশোনা চালিয়ে গেছি এবং ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে ডিগ্রি লাভ করি।

সে সময় আমার বড় ভাই নুরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ছিলেন, তিনি নিখিল পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসলেন এবং ১৯৫০ সাল সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেন।

আমার ভাই নুরুল ইসলামের সাফল্য আমাকেও ন্যুনতম ২১ বছর বয়সের নিম্নসীমা অতিক্রম করার পর ১৯৫২ সালের নিখিল পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসতে অনুপ্রাণিত করল।

একই সঙ্গে আমি আর্টিকেলশিপ চালিয়ে যাচ্ছি এবং চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হবার চূড়ান্ত পরীক্ষা দেবার প্রস্ততি নিচ্ছি, সে সময় বলা হতো রেজিস্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। পাকিস্তানে কোনো ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস ছিল না, পাকিস্তান সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরীক্ষা পরিচালনা করত। আমি উভয় পরীক্ষাই সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হই। আমি তখন ভীষণ অপুষ্টিতে ভুগছিলাম। সিভিল সার্ভিসে যোগ দিতে আমি যখন নির্ধারিত মেডিক্যাল ক্লিয়ারেন্স এর জন্য যখন হাজির হলাম আমার ওজন তখন ১০৯ পাউন্ড বা ৫০ কিলোগ্রাম।

সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান এর জন্য যে ১৫ জন প্রার্থীকে নিয়োগ করা হলো আমি তাদের একজন। ৫ অক্টোবর ১৯৫২ আমি লাহোরে সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে যোগ দিলাম। প্রায় একই সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস পরীক্ষার ফলও যোষণা করল, আমি দেখলাম অল্প কজন সফল প্রার্থীর মধ্যে আমিও রয়েছি। ৫ বছরের আর্টিকেলশিপ পূর্ণ হবার আগেই আমাকে লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে যোগ দিতে হয়েছে। আমার ৫ বছর পূর্তির ৩ মাস ঘাটতি ক্ষমা করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলাম, তারা দ্রুত তা অনুমোদন করল। আমি একই সময়ে সিভিল সার্ভেন্ট এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হলাম, সম্ভবত এরকম নজির আর একটিও নেই।

(১৯৫২-১৯৫৮)
আমি লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে ৫ অক্টোবর ১৯৫২-তে যোগ দিই, নির্ধারিত বয়সে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ কর্মজীবন পার করব এই প্রত্যাশায়। দুর্ভাগ্যবশত আমাকে ৩৯ বছর বয়সে বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে হয়, ততদিনে চাকরি হয়েছে ১৭ বছর, যার মধ্যে ১১ বছরই কেটেছে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থ বিভাগে। ২৫ বছর বয়সে আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দিই, আমার কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল উন্নয়ন বাজেট ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও স্যাঙ্কশন আর তার উপরে পূর্ব পাকিস্তানে উন্নয়ন কর্মসূচি চালাতে ঋণ ও অনুদান আনতে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে যোগাযোগ—এটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ আর হতাশাব্যাঞ্জক দায়িত্ব। তথাপি কর্মজীবনের শুরুতেই অর্থ ব্যবস্থায় বিশেষজ্ঞ জ্ঞান অর্জন পরবর্তী জীবনে আমাকে উল্লেখযোগ্য সুফল প্রদান করেছে।

১৯৫৬ সালে আমাকে ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইজার (ডেভেলাপমেন্ট) পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়, তার মানে অনেক উচ্চতর দায়িত্ব পালন করতে হবে। অর্থনৈতিক উপদেষ্টা (উন্নয়ন) এর ক্ষমতা হচ্ছে বিভিন্ন লাইন মন্ত্রণালয় থেকে তহবিলের যে অনুরোধ আসে আমি তা যেমন যথার্থ মনে করি সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নিস্পত্তি করা। বিভিন্ন প্রয়োজনে এমনকি নতুন পদ সৃষ্টিতে বাড়তি আর্থিক সংশ্লেষের প্রতি ধনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি ও সর্বাত্মক বিবেচনা আমাকে লাইন মন্ত্রণায়গুলোতে খুব জনপ্রিয় করে তোলে। তারা নথি এমনভাবে তৈরি করতেন যেন তা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য আমার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছে। বিভিন্ন বিভাগ থেকে আমার কাছে যে সব বিষয় প্রেরণ করা হতো সেগুলোর ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেবার একটি প্রবণতা আমার ভেতর গড়ে উঠেছিল।

১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হন শেখ মুজিবুর রহমান। সংক্ষিপ্ত মন্ত্রীত্বকালে তিনি ফিল্ম ডেভলাপমেন্ট কর্পোরেশন ও ইস্ট পাকিস্তান স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন সৃষ্টি করেছেন, বৃটিশ কোম্পানি ওক্টাভিয়াস স্টিল-এর পরিবর্তে স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় ঢাকা ইলেট্রিসিটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন।

তাকে অনুসরণ করে পশ্চিম পাকিস্তানও সৃষ্টি করেছে ওয়েস্ট পাকিস্তান স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরশন। পিআইএর মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানে কলা ও পান রফতানিতে যারা বিশেষ সুবিধা ভোগ করতেন তিনি তাদের একচেটিয়া কারবার ভেঙ্গে দেন। নিশ্চিত আয়ে এটা ছিল অত্যন্ত লাভজনক একটি ব্যবসা। শেখ মুজিব অনেক পূর্ব পাকিস্তানিকে এ ব্যবসায় টেনে আনেন এবং বহু সংখ্যক বাঙ্গালি পরিবারের জীবন ধারণের ব্যবস্থা করে দেন। লোক প্রশাসনে মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বৃত্তিতে ১৯৫৭ সালে আমাকে হার্ভার্ড পাঠানো হয়। এখানেই শেখ মুজিবের সাথে আমার আজীবন বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়, তিনি তখন বস্টনের হাসপাতালে একটি ছোট অপারেশনের জন্য অবস্থান করছিলেন। ১৯৫৮-র জুলাইতে আমি ঢাকায় ফিরে আসি এবং অর্থ বিভাগে আমার দায়িত্বে পুনরায় যোগ দিই।

(১৯৫৮-১৯৬০)
১৪ অক্টোবর ১৯৫৮ আমার বিয়ের তারিখ নির্ধারিত। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ৭ অক্টোবর সামরিক আইন জারি করা হলো। একজন জ্যেষ্ঠ সিএসপি অফিসার মি. সোবহান ছিলেন ডেভলাপমেন্ট কমিশনার; যদি আর্থিক সংশ্লেষে অনাপত্তির প্রয়োজন হতো তাহলে নথি আমার কাছে পাঠাতেন। আমার বিয়ের দিনই সেটা ঘটল। মি. সোবহান একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি আর্থিক অনাপত্তির জন্য আমার কাছে পাঠালেন, ‘আপনি দয়া করে আমাকে শান্তিতে বিয়ে করতে দিন’ এই মন্তব্য লিখে আমি নথি ফেরৎ পাঠালাম। সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ওমরাও খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি হামিদ আলী আমার বিয়েতে যোগ দিয়েছিলেন।

সামরিক আইন জারির পর দু’একটি শীর্ষ পদ ছাড়া তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না। ১৯৪৮ ব্যাচের সিএসপি অফিসার ভি এ জ্যাফ্রিকে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থসচিব পদে বদলি করা হয়। হামিদ আলীর জায়গায় এম আজফারকে চিফ সেক্রেটারি হিসেবে বদলি করা হয়। পুলিশের সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল জাকির হোসেনকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করলেন। তিনি আইয়ুব খানের সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলেন। বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম, চট্টগ্রামের এ কে খান, বগুড়ার হাবিবুর রহমান এবং সাবেক  বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস অফিসার হাজিফুর রহমান আইয়ুব কেবিনেটে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মন্ত্রী হিসেবে যুক্ত হলেন।

ঠিক সে সময় চিফ সেক্রেটারি মি. আজফার ফ্লোর নিলেন এবং বললেন, ‘‘হ্যাঁ মতিউল ইসলাম এই পেপারটি লিখেছেন কিন্তু আমরা সবাই— ফিনান্স সেক্রেটারি, এডিশনাল চিফ সেক্রেটারি আমি এবং আমি এটা দেখেছি এবং অনুমোদন দিয়েছি। মতিউল ইসলামকে দোষ দেওয়ার বদলে আমাদের সবার উচিত পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে ও বর্তমান অচলবস্থা কাটাতে তার দেওয়া পরামর্শগুলো পরীক্ষা করে দেখা।’’ প্রেসিডেন্ট তখনই পেপারটি অর্থমন্ত্রী শোয়ের সাহেবকে দিলেন এবং পেপারটি পরীক্ষা করে ব্যবস্থা নিতে তাকে নির্দেশ দিলেন।

১৯৬০ সালে আইয়ুব খান রাওয়ালপিন্ডিতে কেবিনেট ইকনমিক কমিটির একটি বৈঠক ডাকলেন। গভর্নর জাকির হোসেনের সঙ্গে বৈঠকে যোগদানকারী চিফ সেক্রেটারি, এডিশনাল চিফ সেক্রেটারি, ফিনান্স সেক্রেটারি এবং আমি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রেরিত প্রকল্প ও প্রস্তাবে কেন্দ্র থেকে আর্থিক অনুমোদন পেতে আমি কী ধরণের সমস্যার সম্মুখীন এবং সেগুলো সমাধানের উপায় নিয়ে একটি পেপার তৈরি করার আমাকে নির্দেশ দেওয়া হলো। আমি পেপার তৈরি করলাম এবং তা ভি এ জ্যাফ্রিকে দিলাম, তিনি অ্যডিশনাল চিফ সেক্রেটারির মাধ্যমে চিফ সেক্রেটারির কাছে পাঠিয়ে দিলেন। শেষ পর্যন্ত তা গভর্নরের কাছে পৌঁছলো, তিনি তখন সেনা প্রধান জেনারেল মুসার গেস্ট হাউসে অবস্থান করছিলেন।

ইকনমিক কমিটির সাথে বৈঠকের আগে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সাথে পৃথক বৈঠক করতে চাইলেন যাতে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যের কারণসমূহ সনাক্ত করতে পারেন। অর্থমন্ত্রী মি. শোয়েব এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিযুক্ত মন্ত্রী এ কে খান ও হাফিজর রহমানকেও যোগ দিতে বলা হয়। বৈঠক শুরু হবার পর আতঙ্কিত হয়ে দেখলাম পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা ও বিষয়সমূহ নিয়ে আমার দাখিল করা পেপারটি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব হাতে দুলিয়ে ক্ষুদ্ধ স্বরে চিৎকার করে গভর্নরকে বলছেন, ‘‘জাকির এই পেপার কে তৈরি করেছে? তুমি জানো এটা দেশের দুই অংশের মধ্যে ভীষণ অসন্তোষ ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করতে পারে? এ ধরণের ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করার জন্যই কি আমি তোমাকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে পাঠিয়েছি?’’ এই কাগজ তৈরি করার দায় তিনি তাৎক্ষণিকভাবে অস্বীকার করে দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারিতে বসা আমার দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, এই কাগজ তৈরি করার জন্য মতিউল ইসলামই দায়ী।

আমি ধরেই নিলাম সিভিল সার্ভিসে আমার দিন শেষ, প্রেসিডেন্ট হতবুদ্ধি হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না। তিনি এরপর কী করেন তা দেখার অপেক্ষায় আছি। ঠিক সে সময় চিফ সেক্রেটারি মি. আজফার ফ্লোর নিলেন এবং বললেন, ‘‘হ্যাঁ মতিউল ইসলাম এই পেপারটি লিখেছেন কিন্তু আমরা সবাই— ফিনান্স সেক্রেটারি, এডিশনাল চিফ সেক্রেটারি আমি এবং আমি এটা দেখেছি এবং অনুমোদন দিয়েছি। মতিউল ইসলামকে দোষ দেওয়ার বদলে আমাদের সবার উচিত পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে ও বর্তমান অচলবস্থা কাটাতে তার দেওয়া পরামর্শগুলো পরীক্ষা করে দেখা।’’ প্রেসিডেন্ট তখনই পেপারটি অর্থমন্ত্রী শোয়ের সাহেবকে দিলেন এবং পেপারটি পরীক্ষা করে ব্যবস্থা নিতে তাকে নির্দেশ দিলেন। যিনি আমাকে সেদিনের মতো রক্ষা করলেন তিনি অবশ্যই আজফার সাহেব, দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়ে তরুণ কর্মকর্তাকে রক্ষা করার এক দুর্লভ নজির স্থাপন করলেন। (পেপারটির একটি সংক্ষিপ্ত রূপ জাস্টিস ইব্রাহিমের ডায়েরির ৩য় পৃষ্ঠায় রয়েছে)

সত্যিজিৎ রায় পরিচালিত অপুর সংসার চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য।

আমাকে ফিল্ম ডেভালপমেন্ট কর্পোরেশন এবং আইডব্লিউটিএ (ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি)-র ফিনান্স ডিরেক্টর পদে নিয়োগ দেওয়া হলো, দুটোই আমি দারুণভাবে উপভোগ করেছি। ১৯৫৮ সালে মাসুদ হোসেন করাচি থেকে ঢাকায় এলেন এবং অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন এবং অভ্যন্তরীণ নৌপথ উন্নয়ন রক্ষাণবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি গঠনের প্রস্তাব দিলেন। এটা একটা নতুন কর্মদিগন্ত, এটা যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হবে এবং এর আওতায় অভ্যন্তরীণ জলপথ সমূহের জটিল নেটওয়ার্ক— এ কথা সরকার ও অর্থবিভাগকে সম্মত করাতে তাকে খুব কষ্ট করতে হলো।

২৪,০০০ কিলোমিটার নদীর মাত্র ৫,৯৯৮ কিলোমিটার বর্ষা মওসুমে যান্ত্রিক নৌ পরিবহণ চলাচল করার উপযুক্ত, শুষ্ক মওসুমে তা হ্রাস পেয়ে ৩,৮৬৫ কিলোমিটারে নেমে আসে। তিন সদস্যের একটি কর্তৃপক্ষ স্থাপন করা হলো, মাসুদ হাসন হলেন চেয়ারম্যান আর আমি সদস্য (অর্থ)।

এ সময় কেন্দ্রীয় সরকার ভারত থেকে বাংলা চলচ্চিত্র আমদানি করার জন্য ২ লক্ষ রুপির সমমানের বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দ করল। আমি তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে কোলকাতা গেলাম এবং সত্যজিত রায়, বিকাশ রায়ের মতো ব্যক্তিত্বের সাথে দর কষাকষি করলাম। বরাদ্দের টাকায় আমাদের এক ডজন ছবি আনা সম্ভব হলো— এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সত্যজিত রায় পরিচালিত ‘অপুর সংসার’ আর শুধু এর জন্যই সর্বাধিক ২৫ হাজার টাকা দিই। ভবিষ্যতের সমালোচনা এড়াতে আমাদের ডেপুটি হাইকশিনারের সাথে কথা বলে দরকষাকাষি ও সমোঝতা দূতাবাস অফিসে করার ব্যবস্তা করি। একাজে দর কষাকষির জন্য আমরা দূতাবাসের একজন কর্মকতাকে সংযুক্ত করলাম। আমাদের সিদ্ধান্তের প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে মিশনে জমা করা হলো।

(দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য)

অনুবাদক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক।
ইমেইল: [email protected]

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত