জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের জয় দেখেছে বাংলাদেশ। কিন্তু যে রক্ত, মৃত্যু, আর ধ্বংস পেরিয়ে এই জয় এসেছে, তা মনে রেখে গেছে চাপ। সেই চাপ সামলে ওঠার কাজটি যারা করবেন, চাপমুক্ত নন তারাও।
সেই চাপটি কেমন, তা স্পষ্ট হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের কথায়।
তিনি বললেন, এই আন্দোলন চলাকালে দেশের চিকিৎসকদেরও দিন কেটেছে আতঙ্কে, দুশ্চিন্তায়। পত্রিকা, টেলিভিশন, সোশাল মিডিয়ায় যে ছবি ও ভিডিও এসেছে, তা ভয়াবহ। প্রতিদিন শত শত আহত মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসেছে, সেই অভিজ্ঞতা ভীষণ চাপ সৃষ্টি করে চিকিৎসকদের মনের ওপর।
গত ১৮ জুলাই থেকে টানা তিন দিন ডা. নাসির চিকিৎসা সেবায় যুক্ত ছিলেন ঢাকার বেসরকারি এ এম জেড হাসপাতালে। আগেও অনেকবার তাকে টানা হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য দুর্ঘটনার সময়ে। তবে এবার জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের মধ্যে যে পরিস্থিতি, তা তাকে আগে কখনও মোকাবেলা করতে হয়নি।
এবার বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গুরুত্ব দিচ্ছেন এই চাপ মোকাবেলায়; তারা বলছেন, বিষয়টি কোনোভাবে হেলাফেলার নয়।
মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতায় প্রতি বছর ১০ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য’।
শত শত রোগী, চিকিৎসকরাও ট্রমাটাইজড
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে শুরু হওয়া আন্দোলন ১৫ জুলাই দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘাতের মধ্যে দিয়ে সহিংস হয়ে ওঠে; সেদিন আহত হয় কয়েকশ শিক্ষার্থী।
পরদিন ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামে আরও পাঁচজন গুলিতে নিহত হলে আন্দোলন ছড়িয়ে পরে দেশজুড়ে।
দিনভর রাজপথে সংঘাতে মৃত্যুর মিছিল দেখতে হয়েছে সবাইকে। আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছিল হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের বিকট আওয়াজ। রাতে আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার অভিযান আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখেছিল সবাইকে।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আবার দেশবাসীকে দেখতে হয় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। পুলিশশূন্য অবস্থায় অনিরাপদ পরিস্থিতিতে পিটিয়ে মারার কয়েকটি ঘটনাও মানুষের মনে তৈরি করে চাপ।
জুলাই-আগস্টে মোট কতজন নিহত হয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা এখনও জানা যায়নি। ৭৩৫ জন নিহতের একটি খসড়া তালিকা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের হিসাবে সংখ্যাটি দেড় হাজারের বেশি। আহতের সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, হতাহতের ঘটনাটি স্থানিক নয়, গোটা দেশেই। ফলে সারাদেশে নিহতদের পরিবারের হাজারো সদস্য রয়েছে এখন মনোবেদনায়। আহতদের পরিবারের সদস্য সংখ্যাও লাখ ছাড়াবে, যারা রয়েছেন স্বজনের চিকিৎসা নিয়ে চাপে। চাপে থাকা এই মানুষগুলো ছড়িয়ে আছে সারাদেশে।
ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, “কেবল যে হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট তারাই নয়, জুলাই আগস্টের ঘটনার সঙ্গে জড়িত-সেটা সরাসরি হোক আর পরোক্ষভাবে হোক-তারাই ট্রমাটাইজড। এমন আত্মীয়স্বজনও রয়েছে, যারা কেবল পেপারে পড়েছে-টিভিতে দেখেছে, তারাও কিন্তু ঘুমাতে পারত না।
“পুরো বাংলাদেশের মানুষই আসলে ট্রমাটাইজড ছিল এ সময়টায়। হয়ত কেউ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বা পারবে আবার কেউ পারবে না। এটা অনেক বড় এক মানসিক ক্ষতি করে গেল সারাজীবনের জন্য আমাদের।”
কেমন ছিল সেই চাপ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক তখনকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করার দৃশ্য, চোখের সামনে এত রক্ত, এত বাঁচার আকুলতা, এত মৃত্যু, স্বজনদের আহাজারি, এত গ্রেপ্তার– এমনটা তারা আর দেখেননি।
১৮ জুলাই ডা. নাসির এ এম জেড হাসপাতালে কল করে জানতে পারেন অনেক রোগী আসছে, তাদের ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেলের দায়িত্ব সেরে তিনি চলে যান সেখানে।
“সার্জারির চিকিৎসক হিসাবে আমি প্রচুর ট্রমাটাইজড রোগী ডিল করে থাকি। কিন্তু সেসব রোগী ডিল করা একটা বিষয়…আর এসব বাচ্চা, সবার গলায় আইডি কার্ড ঝুলছে এবং বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের।
“কারও চোখে, কারও সারা গায়ে গুলি; কারও হাত গুলিতে ভেঙে গেছে। হাসপাতালের সামনের জায়গাটুকুকে বিছানা পেতে অসংখ্য, গুণে শেষ করা যাবে না… কয়েকজনের চোখে গুলি, চোখ নষ্ট হয়ে যাবে। তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। তবে সেদিন সারারাত ধরে গুলি বের করলাম আমরা।”
ডা. নাসির বলেন, “অনেক দুর্যোগ-দুর্ঘটনা দেখেছি ঢাকা মেডিকেলে থাকার সময়। রমনা বটমূ্লে গ্রেনেড হামলা, পুরান ঢাকার নিমতলীর অগ্নিকাণ্ড, রানা প্লাজাসহ অনেক কিছুর সাক্ষী এই হাসপাতাল এবং এখানকার চিকিৎসকরা।
“অনেক রোগী আসে এখানে, বিভিন্ন ধরনের, কিন্তু একসঙ্গে এতগুলো ছাত্র…তাদের যে কান্না-হাহাকার, মেন্টাল ট্রমা, বিশেষ করে যে নারী শিক্ষার্থীরা এসেছিল …তাদের যে শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা এটা …অনেকদিন পর্যন্ত ঘুমাতাম না, পারতাম না। আর এটাতো একদিন না, আন্দোলনের পুরো সময়টা, সরকার পতনের পরেও চলছিল।”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের আরেক চিকিৎসক বললেন, “হঠাৎ করেই বানের পানির মতো রোগী আসতে শুরু করলো। ইমার্জেন্সি ভরে উঠছে, জায়গা ছিল না। আমরা যে হেঁটে চিকিৎসা দেব, সে অবস্থাও না। অসংখ্য রোগী, অসংখ্য লাশ। প্রথমে প্রায় একসঙ্গে এল পাঁচটি, পরে রাত পর্যন্ত এল ৬৮ মৃতদেহ।
“দেখা যায় না এ দৃশ্য। একজনের ঘাড়ের কাছের রগ ছিড়ে গেছে গুলিতে, রক্ত বের হচ্ছে গলগল করে। আমি বুঝতে পারছি টিকবে না। কাছে গেলাম, কলেমা পড়তে বললাম, হাত ধরে থেকেছি। মৃত্যু দেখলাম হাতের ওপর। আরেকটা ছেলের ডান পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে পেছন দিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। আমি বুঝতে পারছি চোখ উল্টে যাচ্ছে, শ্বাসকষ্টে নীল হয়ে যাচ্ছে। আমি কাছে যেতেই কেবল একবার আমাকে বলল- ‘স্যার আমি বাঁচব তো?’ সেও বাঁচেনি, চলে গেল চোখের সামনে।”
“আমি তো মেডিসিনের চিকিৎসক, সার্জন না। তাই আমি এত বীভৎস চিত্র এবং এভাবে মৃত্যু দেখায় অভ্যস্ত না। আমি অনেকদিন পর্যন্ত ট্রমাটাইজড ছিলাম। এখনও ইমার্জেন্সির সামনে দিয়ে গেলে ট্রমাটাইজড লাগে, নাম না জানা ছেলেটার বাঁচার আকুতি মনে হয়,” বলেন এই চিকিৎসক।
ট্রমার মধ্যে আরেক ট্রমা
কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকরা যেমন চাপে ছিলেন, তাদের পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন চাপে।
ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, “পরিবারের সবাই জানতে চাইত, হাসপাতালের কী অবস্থা? রোগীদের কী অবস্থা?”
সেই সময় আবার তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে হতাহতদের বিষয়ে তথ্য না দিতে চিকিৎসকদের ওপর চাপ দেওয়া হয়েছিল। সাংবাদিকদের তথ্য দেওয়ার কারণের বদলির ঘটনাও ঘটছিল।
আবার আন্দোলনের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়েও চিকিৎসকদের মধ্যে বিভাজন দেখা দেয়। আন্দোলনের বিপক্ষে কর্মসূচিতে না যাওয়া চিকিৎসকদের ওপর প্রশাসনিক চাপ দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। হাসপাতালে হামলার ঘটনাও ঘটে।
ডা. নাসির বলেন, “আমরা ‘মিসক্রিয়েন্ট’দের চিকিৎসা দিচ্ছি-এটাও শুনতে হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসা দেওয়া আমার নৈতিক দায়িত্ব। এভাবে এক পাহাড়সম মানসিক ট্রমা নিয়ে কাজ চালাতে হয়েছে, যথেষ্ট হয়রানি সহ্য করতে হয়েছে।”
উত্তরণের কী উপায়?
ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, তার ২৫ বছরের ক্যারিয়ারে এমন মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি আগে কখনও হননি। আর এটা শুধু চিকিৎসদের নয়, হাসপাতালগুলোতে কাজ করা নার্স, ওয়ার্ড বয়, ট্রলিম্যান থেকে শুরু করে সবাই ছিল ট্রমাটাইজড।
“একসঙ্গে এত ডেডবডি দেখা-একজন মানুষ হিসেবে, সেটা ডাক্তার, পুলিশ, সাংবাদিক যাই হোন না কেন, মনে রাখতে হবে এটা সারাজীবনের একটা ক্ষত তৈরি করে দিল।”
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ট্রমা এক ধরনের মনোদৈহিক চাপজনিত ঘটনা। একে ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার’ বা সংক্ষেপে ‘পিটিএসডি’ বলা হয়। সাধারণত শারীরিক বা যৌন নির্যাতন, মারাত্মক দুর্ঘটনা, যুদ্ধ-সংঘাত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের উল্লেখ করা যেতে পারে। পিটিএসডি মানসিক রোগের পরিভাষায় উদ্বেগজনিত রোগের অন্তর্ভুক্ত।
জুলাই-আগস্টের ঘটনায় পুরো দেশ ট্রমাটাইজড ছিল, বলেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ।
ডিজাস্টার সারভাইবাল লেভেলের পাঁচটি ধাপ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তালিকার প্রথমে রয়েছে নিহতদের স্বজন ও আহতরা। দ্বিতীয় ধাপে প্রত্যক্ষদর্শী, অর্থাৎ যারা চোখের সামনে মৃত্যু দেখে, ঘটনাটা ঘটতে দেখেন (আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যমকর্মীরাই বেশি), তৃতীয় ধাপে সারভাইবার বা এ ঘটনাতে যারা টিকে থাকেন, চতুর্থ ধাপে এসব ঘটনায় যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন অর্থাৎ প্রশাসনিক পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
ডা. হেলাল বলেন, কেউ কেউ এ চাপ কাটিয়ে উঠতে পারলেও অনেকে মোকাবেলা করতে পারেন না। তখন তাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যা দেখা দেবে।
“আমরা আর কখনও এমন ম্যাসিভ ট্রমাটাইজড মানুষ দেখিনি। দেশে এখন অনেক বড় সংখ্যক মানুষ ইফেক্টেড। আমরা হয়ত কারোটা বুঝতে পারছি, কারোটা পারছি না।”
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত। সচেতনতার অভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে।
২০১৮-১৯ সালের জাতীয় শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১৮.৪ শতাংশ ও শিশু-কিশোর ১২.৬ শতাংশ মানসিক রোগী। তবে এই হার বর্তমানে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তার কোনও পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে অন্তত ৩ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক সমস্যায় আছেন। কিন্তু বিশাল এই সংখ্যার বিপরীতে চিকিৎসাসেবা দিতে পারেন, এমন মানুষের সংখ্যা মাত্র ১ হাজার!
ফলে কঠিন হলেও এই সময়ে ট্রমাটাইজড মনগুলোকে সারিয়ে তুলতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ডা. হেলাল।
তিনি বলেন, “এসব মানুষের জন্য ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করার কাজ করতে হবে এবং তাদের জন্য ‘ভেন্টিলেশন’ এর ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। “প্রাত্যহিক কাজের বাইরে নতুন নতুন কাজ করতে হবে, কথা বলতে হবে এবং ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হলো- ঘুমের সময় নির্ধারণ করা।”