Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

কাজের চাপের চেয়ে মানসিক চাপ নারীর চাকরি ছাড়ার বড় কারণ

Stressed-lady-in-office
[publishpress_authors_box]

সাধারণ মানুষের নানা সংকটের কথা, সমস্যা-সম্ভাবনার কথা, হামলা-মামলা-নির্যাতনের কথা প্রকাশ করে গণমাধ্যম। রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা কিংবা অনলাইন নিউজ পোর্টালের পাতায় উঠে আসে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। জানা যায়, দুর্নীতির কথা কিংবা শ্রমিকের অধিকার বা নারীর অধিকার খর্বের কথা।

সেই গণমাধ্যমেই মানসিক নির্যাতনের কারণে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হওয়ার কথা জানাচ্ছিলেন এক সংবাদকর্মী।

তার সঙ্গে যখন কথা বলছি, তখন গোটা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। যার এবারের প্রতিপাদ্য ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এখনই সময়’।

ওই নারী সংবাদকর্মী বলেন, “অফিসে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সবাই জানে আমি হ্যাপিলি ম্যারিড, স্বামী-সন্তান নিয়ে পারিবারিকভাবে সুখে আছি। তারপরেও অফিসের ঊর্ধ্বতন এক কর্তা ব্যক্তি নিয়মিত নানা অজুহাতে তার রুমে ডাকেন, নয়ত আমার টেবিলে এসে নানা প্রসঙ্গে কথা বলেন। বারবার তার সঙ্গে বাইরে কফি ডেইটে যাওয়ার প্রস্তাব দেন।”

বিষয়টি বুঝতে পেরে কাজ ছাড়া অন্য প্রসঙ্গে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আগে সবাই মিলে আড্ডা দিতাম, এখন উনি থাকলে আমি সেখানে যাই না। ফেইসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে বারবার অযথা নক করেন। তাতেও সাড়া না পাওয়ায় এখন অন্যদের দিয়ে খোঁচানো শুরু করেছেন। উনি যা করছেন খুবই অস্বস্তিকর, ভীষণ মানসিক চাপের মধ্যে আছি।

“যেভাবে চলছে, মনে হয় পাগল হয়ে যাব। এখন ভাবছি চাকরিটা ছেড়ে দেব।”

লাইট, ক্যামেরা, হেডলাইন আর স্ক্রিপ্টের জগৎ থেকে বেরিয়ে এবার নজর দিই মিরপুরের ছোট একটি পোশাক কারখানায়।

সেখানে কাজ করেন শান্তা (ছদ্মনাম)। ওই কারখানায় সুপারভাইজার হিসেবে আছেন মালিকের এক আত্মীয়। শান্তা জানালেন, ক্ষমতার দাপটে তিনি বিভিন্ন সময়ে নানা বাহানায় মানসিক নির্যাতন করতেন। অতিরিক্ত ডিউটি করানো, অন্যদের চেয়ে বেশি কাজ দিয়ে বেশি সময় আটকে রাখার মতো ঘটনা ঘটতো শান্তার সঙ্গে। এমনকী যাতায়াতের পথেও বিরক্ত করতেন তিনি। প্রতিবাদ করতে গেলেই চাকরি যাওয়ার ভয় দেখাতেন।

মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়েছেন শান্তা। এখন গ্রামে বৃদ্ধ মা-বাবা আর ছোট ভাইকে পরের মাস থেকে কীভাবে টাকা পাঠাবেন, সেই চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না তার। হন্যে হয়ে তাই খুঁজছেন নতুন চাকরি।

কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে কথা বলি দেশের বেশ নামকরা ফ্যাশন হাউজের এক কর্মীর সঙ্গে। নারীবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে যার সুনাম রয়েছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে।

ওই নারী গত বছরের জানুয়ারিতে কাজে যোগ দেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক তাকে যৌন হয়রানি করেন। শুধু তাই নয়, সমমানের নারী ও পুরুষ কর্মীর মধ্যে করা হয় বিপুল বৈষম্য। বেতনে তো বটেই কাজ বন্টনেও। প্রতিবাদ করতে গেলেই শুনতে হয়, ‘মেয়েরা এমন’। কিংবা ব্যবস্থাপকের কোনও সেক্সিস্ট ঠাট্টার জবাবও দেওয়া যায় না। জবাব দিলেই আখ্যা দেওয়া হয় ‘বেয়াদব’।

তিনি বলেন, সব বাদ দিয়ে কেবল যৌন হয়রানির অভিযোগই প্রতিষ্ঠানের মালিক ও প্রশাসনকে ইমেইল করে জানিয়েছিলাম। কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি। প্রতিবাদে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হই। এখন উল্টো মামলার ভয় দেখাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ব্যবস্থাপকও রয়েছেন বহাল তবিয়তে।

এ অবস্থায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এত নামকরা অফিস, সেখানে এসব ঘটনা ঘটছে। কাউকে বলতেও পারছিলাম না। কেমন যে অসহায় লাগত! আমি পুরো ট্রমাটাইজড হয়ে গিয়েছিলাম।”

মাত্র তিনটি খাতের তিন জন নারীর সঙ্গে কথা কথা বলে কর্মক্ষেত্রে তাদের মানসিক অবস্থার কিছু চিত্র তুলে আনা হয়েছে এখানে। প্রতিবেদন তৈরির জন্য আরও যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের প্রায় সবাইই বলেছেন, কাজের চাপে চাকরি ছাড়তে হয়নি বা কাজের চাপ তাদের মানসিক যন্ত্রণা দেয় না। তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণা দেয় যৌন হয়রানী বা লিঙ্গ বৈষম্য।

কথায় কথায় সেক্সিস্ট ঠাট্টা, নারীকে ছোট করে দেখার মানসিকতা, নারী কর্মীকে অবলা হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা, অফিস সময়ের পর বাড়তি সময় দিতে না চাইলে বিরক্ত হওয়া, পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধির সময় কেবল নারী হওয়ার কারণে পিছিয়ে রাখার চেষ্টা; এসব নানা কারণ সইতে না পেরেও চাকরি ছাড়েন একটা বড় অংশের নারী।

যেহেতু এসব বিষয় নিয়ে বিচার চাওয়ার কোনও জায়গা নেই, তাই চাকরি ছেড়েই মানসিক স্বস্তি ফেরাতে চান বহু নারী। সেক্ষেত্রে অনেকেই আর্থিক সংকটে পড়েন, কেউ কেউ উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করেন আর কেউ আবার মন শক্ত করে নতুন কোথাও কাজ শুরু করেণ।

কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা

কেবল বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বেই কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ কমবেশি মানসিক নির্যাতনের শিকার। তবে এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৯৫ শতাংশের বেশি।

নারী আর পুরুষের কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের ধরনে কিছু মৌলিক পার্থক্যে রয়েছে। নারী নির্যাতনের শিকার হয়, শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে, মৌখিকভাবে। এর সবকিছুর প্রভাব গিয়ে ঠেকে নারীর মনস্তত্ত্বে, তার মানসিক স্বাস্থ্যে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক স্বাস্থ্য মহামারির নীরব শিকার নারী।

অবর্জারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের কথা উল্লেখ করে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ মেখলা সরকার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নারী তার জীবনে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন, যা তার মানসিক স্বাস্থ্যকে দুর্বল করে দেয়।

“নিরাপদ পরিবহন খোঁজার সংগ্রাম, রাস্তার অপ্রতুল আলো, কর্মক্ষেত্রে হয়রানিসহ নানা কারণে নারী মানসিক চাপে থাকেন। অনুমান করা হয় শহর এলাকায় প্রতি এক হাজার জনে প্রায় ৬৫ জন এ ধরনের চাপের মধ্যে দিন কাটান।”  

মেখলা সরকার বলেন, বিশ্ব অনেক এগিয়ে গেলেও এখনও নারীকে প্রতি পদে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়, যেটা পুরুষের বেলায় কম। এজন্য একজন কর্মজীবী নারীকে আটঘণ্টার বেশিও কাজ করতে হয়। কখনও কখনও কিন্তু অতিরিক্ত চাপ নেওয়ার ক্ষমতাকে তার দক্ষতা বলেও চাপিয়ে দেওয়া হয়।

“অথচ এই অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা কাজ করা এবং সেটা সামাল দেওয়া; দুটোই তার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণভাবে ক্ষতিকর। আর এই অতিরিক্ত চাপ তার কর্মজীবন এবং ব্যক্তিজীবনের উৎপাদনশীলতা, সৃজনশীলতা এবং সহজাত কর্মস্পৃহাকে প্রভাবিত করে “

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কর্মজীবী নারীর তথ্য বলছে, দেশের কর্মক্ষেত্রে ৬২ শতাংশ নারী মানসিক হয়রানির শিকার। যার মধ্যে রয়েছে যৌন হয়রানিও। অথচ কর্মক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের যৌন হয়রানি মানবাধিকারের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা।

২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ (ডব্লিউএফএমএইচ) কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এক প্রতিবেদনে জানায়, কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ মানসিক রোগের অন্যতম কারণ। কর্মক্ষেত্রে এই মানসিক চাপের কারণে একজনের বছরে ৩৬ কর্মদিবস নষ্ট হয়।  

মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেপিয়েন ল্যাবসের মেন্টাল স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড এন-২০২৩ জরিপ জানায় বাংলাদেশের ২৬ শতাংশ মানুষ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে বা মানসিকভাবে সুস্থ থাকার লড়াই করছে।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

বাংলাদেশে কত নারী কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন নির্যাতনের ভেতরে দিয়ে যান-এর কোনও পরিসংখ্যান নেই জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কাছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, কর্মক্ষেত্রে শতকরা ৬০ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন ধরনের ‘হ্যারাসমেন্ট’ এর শিকার হন, যার সিংহভাগই নারী। এসব হয়রানির মধ্যে মানসিক নির্যাতন নাও থাকতে পারে, তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে সব ধরনের হয়রানিই মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে।

কর্মক্ষেত্রগুলোয় দুই ধরনের মানসিক নির্যাতন হয় বলে জানান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ। এগুলো হলো, যৌন হয়রানি আর মৌখিক নির্যাতন।

তিনি বলেন, “যৌন হয়রানির মধ্যে রয়েছে ইন্টিমেট হতে চাওয়া, ফ্লার্ট করা, ইনএপ্রোপিয়েট শব্দ ব্যবহার, নারীদের সামনে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পুরুষ সহকর্মীদের অশ্লীল কৌতুক বলা, মোবাইল-ফেইসবুক ম্যাসেঞ্জারে অ্যাডাল্ট ছবি পাঠানো। আরেক ধরনের নির্যাতনের সঙ্গে সরাসরি কোনও যৌন হয়রানির সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও মৌখিকভাবে হয়রানি করাও কিন্তু অনেক বড় মানসিক নির্যাতন।

“হয়তো নারী সহকর্মীকে বলা হচ্ছে, মেয়েরা কাজ পারে না, তারা যোগ্য নন, এর চেয়ে পুরুষ কর্মী হলে সুবিধা হতো।”

নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, “কর্মক্ষেত্রে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে যারা আসছেন তাদের মধ্যে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ের উঁচু পদের কর্মকর্তারাও রয়েছেন। যারা তাদের কর্মক্ষেত্রে মৌখিকভাবে এবং সরাসরি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যার প্রভাবে পড়েছে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে।”

অনেক প্রতিষ্ঠানই কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য মেডিকেল ক্যাম্প করে উল্লেখ করে এই চিকিৎসক বলেন, দুঃখের বিষয় হলো কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্য কেমন আছে তা জানার চেষ্টা কোনও কর্মক্ষেত্র করে না।

“গত ১৩ বছরের কর্মজীবনে কর্মক্ষেত্রগুলোয় মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব আমি দেখিনি হাতে গোনা একটি-দুটি কর্মক্ষেত্র ছাড়া। বিশেষ করে কোভিড মহামারীর আগে অফিসগুলোতে মেন্টাল হেলথ নিয়ে কেউ কথাও বলেনি।”

মহামারীর পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন সরকারি চাকরিতে প্রবেশের আগে যে লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ হয় সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা হচ্ছে। এটা বেশ আশার কথা।

নারীদের নিয়ে কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা উই ক্যান। সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জিনাত আরা হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “লেখা পড়া শিখলেও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পর নারী ভিন্ন পরিবেশ পান। এমন একটা পরিকেশে গিয়ে তিনি পড়েন যেটার জন্য হয়ত তিনি দক্ষ বা উপযুক্ত হিসেবে গড়ে ওঠেননি।

“কারণ সে জায়গাটা পুরুষের কাঠামোতে তৈরি করা করা। পুরুষ সহকর্মীদের কথোপকথনেও অনেক নারী বোঝেই না যে সেটা ‘অ্যাবিউসিভ’।”

সংসারের কাজ সেরে একজন নারী চাকরি করতে আসেন, এই দায়িত্ব আবার নারীর চেয়ে পুরুষের কম।

জিনাত বলেন, “সন্তান স্কুল থেকে ফিরে মাকে টেলিফোন করে, বাবাকে নয়। এমনকি সন্তানের স্কুলে কোনও সমস্যা হলেও মাকেই ফোন করা হয়। এই ফোন আসাকেও অনেক অফিসে নেগেটিভলি দেখা হয়, অথচ এর দায় মায়ের নয়।”

কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন-অধস্তন অর্থাৎ ক্ষমতা কাঠামো নারীর মানসিক চাপের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন জিনাত।

তিনি বলেন, “এর শিকার নারী পুরুষ উভয়েই। তবে নারীর সংখ্যাটাই বেশি। সেইসঙ্গে কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের বন্ধুত্বের সর্ম্পকের মধ্যে সীমানা নির্ধারণও জরুরি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত