ঢাকার মেট্রোরেলের একক যাত্রার টিকেট পুনরায় পেয়ে যাত্রীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরলেও এর নকশা বদল সৃষ্টি করেছে নতুন বিতর্ক।
নতুন নকশায় শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন ও জাতীয় ফুল শাপলার ছবি বাদ পড়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘রিসেট বাটন’ চাপার বক্তব্যটি সামনে আনছেন কেউ কেউ।
তবে মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কোম্পানি ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) বলছে, বহু যাত্রার স্থায়ী টিকেট বা এমআরটি পাস থেকে আলাদা করতেই একক যাত্রার টিকেট নতুন নকশায় করা হয়েছে। এর পেছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই।
ঢাকার বহু প্রতীক্ষিত মেট্রোরেল ২০২২ সালের ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা এই বৈদ্যুতিক ট্রেনকে তার সরকারের বড় অর্জন হিসাবে দেখাতেন।
মেট্রোরেল চালুর শুরু থেকেই দুই ধরনের টিকেট রয়েছে। এমআরটি পাস কিনে রিচার্জ করে ট্রেনে চড়া যায়। এই কার্ড পাঞ্চ করে স্টেশন থেকে বের হতে হয়। আর একক যাত্রার টিকেট কেনার পর যাত্রা শেষে মেশিনে ঢুকিয়ে রেখে আসতে হয়।
দুটি টিকেটের নকশাই ছিল এক রকম। শুধু ওপরে ডান কোনে একক যাত্রার টিকেটে লেখা থাকে- ‘সিঙ্গেল জার্নি টিকেট’। আর স্থায়ী টিকেটে লেখা থাকে- ‘র্যাপিড পাস কমপেটিবল’।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সম্প্রতি জানানো হয়, একক যাত্রার টিকেট ছিল ৩ লাখ ১৩ হাজার। এর মধ্যে ১৩ হাজার টিকেট নষ্টও হয়ে গেছে। আর দুই লাখ টিকেট যারা কিনেছিলেন, তারা স্টেশন থেকে বের হওয়ার সময় জমা না দিয়ে নিয়ে গেছে।
এই কারণে টিকেট সংকটে নতুন টিকেট মিলিছিল না অনেক স্টেশনে। গত ১ নভেম্বর নতুন করে ইস্যু করা এবং পুরোনো কার্ড রি-ইস্যু সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে ডিএমটিসিএল। এনিয়ে সমালোচনার মধ্যে দুদিন পর ৩ নভেম্বর একক যাত্রার কার্ড আবার চালু হয়।
তবে নতুন টিকেট হাতে পেয়ে দেখা যায় যে আগের কার্ডে থাকা শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন ও জাতীয় ফুল শাপলার ছবি নেই। তার বদলে নতুন কার্ডে যুক্ত করা হয়েছে মেট্রোরেলের ছবি।
আলোচনা-সমালোচনা
নতুন কার্ড দেখার পর অনেকেই সোশাল মিডিয়ায় তা নিয়ে লিখছে। তার মধ্যে সমালোচনাই বেশি।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল নামে একজন ফেইসবুকে লিখেছেন, “মেট্রোর নতুন কার্ড থেকে শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন ও শাপলা প্রতীক তুলে দেওয়া হলো। বাদ দেওয়া হলো ভাষা আন্দোলনের ৫২, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার প্রতীকসমূহ!”
মোস্তফা হোসাইন নামে আরেকজন ফেইসবুকে লিখেছেন, “এবার রিসেট বাটনের চাপে মেট্রোরেলের টিকেট থেকে স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, জাতীয় সংসদের ছবি বাতিল। এরপর কী?”
গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বক্তব্যে জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও মাত্রা বোঝাতে ‘রিসেট বাটন’ কথাটি আসে।
তার সেই বক্তব্য নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা। তখন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে ‘রিসেট বাটন’ কথার ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়। তাতে মুক্তিযুদ্ধকে কম্পিউটারের হার্ডঅয়্যারের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়, একাত্তরের ইতিহাস মুছে দেওয়ার কথা ড. ইউনূস বলেননি।
তবে সেই ব্যাখ্যার পরও এনিয়ে কথা চলছে অনলাইন-অফলাইনে।
জিয়াউল হক নামে আরেকজন ফেইসবুকে লিখেছেন, “ওদের সংস্কার! মেট্রোরেলের নতুন কার্ড থেকে শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন ও শাপলা প্রতীক তুলে দেওয়া হলো। আগের টিকেটের রং সবুজ রং হলেও বর্তমান টিকেটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পতাকার রং জলপাই সবুজের মতো। এই হলো পরিবর্তন।
“এই কারণে কিছু দিন আগে নিউজ করা হইছিল মেট্রোর হাজার হাজার কার্ড গায়েব। এই নিউজটা করানোর উদ্দেশ্য ছিল কার্ডের সংকট দেখিয়ে নতুন করে, নতুন ভেন্ডরের কাছ থেকে মেট্রোর স্মার্টকার্ড বানানো। নতুন নতুন ধান্দা।”
সমালোচনার পাশাপাশি টিকেটের নকশা পরিবর্তনের জন্য কেউ কেউ ধন্যবাদ জানিয়েছে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষকে।
তাদেরই একজন রোহিত দে ফেইসবুকে লিখেছেন, “আগের টিকেটটা এমআরটি পাসের মতো ছিল। তাই সহজেই মানুষ এটাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারত অনেক ভিড়ের মধ্য দিয়ে। তখন মেট্রোরেলের কর্মীরা অনেক সময় বুঝতে পারত না। কারণ ডিজাইন তো প্রায় এক। এখন এই ডিজাইনটা ভিন্ন হওয়াতে মেট্রোরেলের কর্মীরা সহজেই বুঝতে পারবেন- এটা একক যাত্রার টিকেট।
“আর মেট্রোরেলের টিকেটে তো মেট্রোরেলেরই ছবি থাকবে, এটা স্বাভাবিক। আমি আমার পক্ষ থেকে এই পদক্ষেপটাকে সাধুবাদ জানাই।”
মোহাম্মদ শিমুল হুদা নামে আরেকজন ফেইসবুকে লিখেছেন, “মেট্রোর টিকেটে মেট্রোর ছবি থাকাই যৌক্তিক।”
যা বলছে ডিএমটিসিএল
ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারাও নকশা পরিবর্তনের জন্য একক যাত্রার টিকেট এবং এমআরপি পাসকে আলাদা করাই যুক্তি হিসাবে দেখাচ্ছে।
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (লাইন-৬) অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক (ইলেকট্রিক্যাল, সিগন্যাল এন্ড টেলিকমিউনিকেশন এন্ড ট্র্যাক) অতিরিক্ত সচিব মো. জাকারিয়া সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সিঙ্গেল যাত্রার টিকেট আর এমআরটি পাস- এই দুটোর ডিজাইন মূলত একই রকম ছিল। যারা শিক্ষিত কিংবা যারা এমআরটিতে আছেন, তারাও অনেক সময় এই দুই টিকেটের পার্থক্য বুঝতে পারতেন না। যার কারণে সিঙ্গের জার্নির টিকেটটা দিয়ে যাত্রী বের হওয়ার সময় যখন দেখে সামনে যাত্রী এমআরটি পাস গেটের স্লটে টাচ করছে, তখন সিঙ্গেল টিকেটের যাত্রীও টাচ করে বের হতে চান।
“আর সিঙ্গেল যাত্রার টিকেট স্লটে টাচ করলে অ্যালার্ম দিতে থাকে। এসময় শব্দও হয়, লাল বাতিও জ্বলতে থাকে। এসময় গেটের লকটি ৫ সেকেন্ডের জন্য অকেজো হয়ে যায়। এতে পেছনের যাত্রীরা আটকে যায়। এ কারণে পিক আওয়ারে যখন যাত্রীর চাপ বেশি থাকে, তখন বেশ সমস্যা হচ্ছিল।”
এই সমস্যা এড়াতেই দুই টিকেটের নকশা বদলের কথা আগেই ভাবা হয়েছিল বলে জানান অতিরিক্ত সচিব জাকারিয়া।
তিনি বলেন, “এ কারণে অনেক আগেই টিকেট দুটির নকশা আলাদা করার চিন্তা ছিল। আলাদা নকশা মানে একেবারেই আলাদা, যেন দেখলেই বোঝা যায় এই দুটি পৃথক টিকেট। সেই চিন্তা থেকেই এই ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে।”
এর পেছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই দাবি করে জাকারিয়া বলেন, “আপনারা জানেন যে আমরা প্রজেক্টের শুরুতে সিঙ্গেল জার্নির যে টিকেটগুলো পেয়েছিলাম, সেখান থেকে দুই লাখের বেশি মিসিং হয়ে গেছে। এখন আমাদের যখন নতুন করে টিকেটগুলো কিনতে হলো, তখন ভাবলাম আমরা এই সুযোগটা নিই। যেন দুই টিকেটের মধ্যে দৃশ্যমান পার্থক্য থাকে।”
নকশা বদলের ব্যাখ্যায় মেট্রোরেলের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “আমাদের অপারেশন শুরুর পর ১ বছর ১০ মাস গেছে। শুরুতেই আমাদের কার্ড কেনা ছিল। আর যেগুলো কেনা ছিল, সেগুলো তো চাইলেই আমরা পরিবর্তন করতে পারব না।
“এখন কার্ড হারিয়ে যাওয়ার কারণে যেহেতু নতুন করে কেনার প্রয়োজন হয়েছে, তখন আমরা ডিজাইনটি পরিবর্তন করলাম। যাতে যাত্রীরা বুঝতে পারে এমআরটি পাস আর সিঙ্গেল টিকেট এক জিনিস না। দুটার ব্যাবহার দুই রকম।”
একক যাত্রার টিকেট পরিবর্তন হলেও এমআরটি পাস আগের নকশায়ই থাকছে বলে জানান তিনি।