মহারাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী বাবা সিদ্দিকিকে গুলি করে হত্যার মধ্য দিয়ে দুই দশকের বেশি সময় পরে বলিউডে নতুন করে সহিংস সন্ত্রাসবাদ হানা দিল।
বাবা সিদ্দিকিকে হত্যাকারী হিসেবে যে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের এর নাম আলোচনায় এসেছে, তারা বেশ কয়েক বছর ধরেই বলিউড ও ভারতের মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির তারকাদের হত্যাচেষ্টা ও হুমকির জন্য আলোচনায় রয়েছে।
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, মূলত মুম্বাইয়ে নিজেদের অবস্থানের বার্তা দিতেই বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্যরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, যাতে তারা বলিউডসহ পুরো মুম্বাই শহরে ভীতির রাজত্ব কায়েম করে চাঁদাবাজি করতে পারে।
গ্যাংয়ের প্রধান লরেন্স বিষ্ণোই বন্দি আছে গুজরাটের একটি কারাগারে। যদিও অভিযোগ রয়েছে, বন্দি অবস্থাতেই তিনি যেকোনও ধরনের বার্তা নিজের দলের লোকদের কাছে পাঠাতে পারেন।
প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ বাবা সিদ্দিকি কোনও সহজ টার্গেট ছিলেন না। সেটি তার জীবন বৃত্তান্ত দেখলেই বোঝা যাবে।
বাবা সিদ্দিকি ও তার উত্থান
বাবা সিদ্দিকির পারিবারিক নাম জিয়াউদ্দিন সিদ্দিকি। রাজনীতি শুরু করেন ১৯৭৭ সালে, কিশোর বয়সে কংগ্রেস দিয়ে। ১৯৮০ সালের মধ্যেই বান্দ্রা তালুকা যুব কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন তিনি।
কংগ্রেসের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও অভিনেতা সুনীল দত্তের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সিদ্দিকির অবস্থান বলিউডে দৃঢ় করে তুলেছিল। ১৯৯৯ সালে মুম্বাইয়ের পশ্চিম বান্দ্রা থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর টানা তিনবার তিনি এ আসনের এমএলএ বা বিধায়ক ছিলেন।
২০০৪ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মহারাষ্ট্রের খাদ্য ও বেসামরিক সরবরাহ, শ্রম, এফডিএ এবং ভোক্তা সুরক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে সিদ্দিকির দক্ষতা বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। রাজনীতিবিদ হিসেবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রেও তার সুনাম ছিল। তবু ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের বিধানসভা ভোটে পশ্চিম বান্দ্রা আসন থেকে তিনি ভোটে হেরে যান।
রাজনীতির পালাবদলে গত ফেব্রুয়ারিতেই কংগ্রেসের সঙ্গে পাঁচ দশকের সম্পর্ক ছেড়ে অজিত পাওয়ারের জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টিতে (এনসিপি) যোগ দেন বাবা সিদ্দিকী। তিনি নিজে এমএলএ না থাকলেও, তার ছেলে জিসান সিদ্দিকি এখনও কংগ্রেস থেকে পূর্ব বান্দ্রার এমএলএ হিসেবে নির্বাচিত। জিসানের অফিসের সামনেই তিন আততায়ী বাবা সিদ্দিকিকে গুলি করে হত্যা করে।
বলিউড সংযোগ ও ইফতারের পার্টির অন্তরালে
মুম্বাইয়ের বিনোদন জগতে সুনীল দত্তের মধ্য দিয়ে পরিচিত মুখ হয়ে উঠলেও ধীরে ধীরে নিজের ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্বের কারণেই সেলিব্রেটিদের কাছের ও ভরসার মানুষ হয়ে ওঠেন বাবা সিদ্দিকি। গুলি করার পর বাবা সিদ্দিকিকে যখন মুম্বাইয়ের লীলাবতী হাসপাতালে নেওয়া হয়, তখনই তারকাদের একটি দল সেখানে দ্রুত ছুটে যান। এ দলে সালমান খান ছিলেন সর্বাগ্রে।
তবে বলিউডে বাবা সিদ্দিকি সবচেয়ে আলোচিত সম্ভবত ২০১৩ সালে সালমান খান ও শাহরুখ খানের মধ্যে চলতে থাকা বিরোধ মেটানোর মধ্যস্ততাকারী হিসেবে। সেবার এক ইফতার পার্টিতে দুই নায়ককেই নিমন্ত্রণ করেন তিনি। সালমানের বাবা বলিউডের বিখ্যাত প্রযোজক ও স্ত্রিপ্টরাইটার সেলিম খানও ছিলেন নিমন্ত্রিত। সেখানেই ইফতারের সময় শাহরুখ খানকে সেলিম খানের পাশে বসিয়ে দেন তিনি। তখন থেকেই দুই মহাতারকার দূরত্ব কমতে থাকে।
বলা হয়, মু্ম্বাইয়ে সর্বকালের সেরা গ্যাংস্টার হিসেবে কুখ্যাতি অর্জনকারী দাউদ ইব্রাহিমের সন্ত্রাসী দল ‘ডি কোম্পানি’র হয়ে বলিউডের চাঁদাবাজি ও মাদকসহ অন্যান্য অবৈধ ব্যবসায়ের মধ্যস্থতাকারী ছিলেন বাবা সিদ্দিকি।
রোজার মাসে চোখ ধাঁধানো ইফতার পার্টির দিতেন সিদ্দিকি। ওইসব ইফতার পার্টিতে বলিউডের বড় বড় তারকা, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা মিলিত হতেন। একধরনের ‘বিজনেস ডিল’ এর ক্ষেত্রও হয়ে উঠেছিল সিদ্দিকির দেয়া পার্টিগুলো।
মুম্বাইয়ের অপরাধ জগত যেন সিনেমার প্লট
সংঘবদ্ধ অপরাধের নজির মুম্বাইয়ের রয়েছে ১৯৭০ সালের পর থেকেই। ১৯৯০ দশক জুড়েই চলেছে বিভিন্ন সংগঠিত অপরাধী দলগুলোর একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা। ১৯৮২ সালে দত্ত সামন্তের নেতৃত্বে হওয়া ‘দ্য গ্রেট টেক্সটাইল স্ট্রাইক’ হিসেবে খ্যাত আন্দোলনের কারণে মুম্বাইয়ে অনেক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক সংকটের সামনে পড়ে তরুণদের অনেকেই তখন স্থানীয় বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনে যোগ দেয়। তবে সন্ত্রাসী দলগুলো বা গ্যাং কালচারের সর্বোচ্চ উত্থান হয় নব্বইয়ের দশকে। পুরো শহর চলে যায় সন্ত্রাসীদের আওতায়। গ্যাংস্টাররা খোলাখুলি রাজনীতিবিদ, ডেভেলপার, অভিনেতা, সিনেমা প্রযোজক এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাদের পর্যন্ত হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় করতে থাকে। এসময় মুম্বাই পুলিশ ও বিভিন্ন গ্যাংয়ের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘাত-গোলাগুলি ছিল নিত্যকার ঘটনা।
শেষ পর্যন্ত মুম্বাই পুলিশ নীতিনৈতিকতার ধার না ধেরে নির্মমভাবে গ্যাংগুলোর সদস্যদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে নামে। এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয় অনেক সন্ত্রাসীকেই। এরমধ্যে সবচেয়ে আলোচিত গোলাগুলির ঘটনাটি ঘটে ১৯৯১ সালে মুম্বাইয়ের আন্ধেরি এলাকায় ‘স্বাতী’ ভবনে। গ্যাংস্টার মায়া ডোলাস এবং পুলিশের মধ্যকার ওই রক্তক্ষয়ী গোলাগুলির ঘটনা নিয়ে পরে ‘শুটআউট অ্যাট লোখান্ডওয়ালা’ নামে একটি সিনেমাও হয়েছে।
১৯৯৩ সালে মুম্বাইয়ে সিরিজ বোমা হামলা হয়, কুখ্যাত গ্যাংস্টার দাউদ ইব্রাহিম যার সঙ্গে জড়িত ছিল বলে মনে করা হয়। পুলিশ আবারও সর্বশক্তিতে মাঠে নামে এবং সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ওপর নিদারুণ চাপ তৈরি করতে থাকে।
মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী গ্যাং দ্বারা এরপরের আলোচিত ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৭ সালে। বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক মিউজিক মুঘল নামে খ্যাত গুলশান কুমারকে একটি মন্দিরের বাইরে ১৬ বার গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। অডিও কোম্পানি টি সিরিজের মালিকের এই হত্যার পরে পুলিশ অনেক হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিকেও তদন্তের আওতায় নিয়ে এসেছিল, যার মধ্যে বলিউড সঙ্গীত পরিচালক জুটি ‘নাদিম-শ্রাবণ’-এর নাদিম আকতার সাইফিও ছিলেন।
নব্বই দশকের শেষের দিকেই অবশ্য পুলিশের টানা অভিযানে মুম্বাইয়ের গ্যাংগুলো আর এর লিডাররা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। ছোট-বড় গ্যাংস্টারদের অনেকে পালিয়ে যায়, অনেকে মারা পড়ে। ততদিনে ভারত মুক্তবাজার অর্থনীতিতে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। আর এ কারণে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো আরও নেতিয়ে পড়ে যখন মহারাষ্ট্র কন্ট্রোল অব অরগানাইজড ক্রাইম অ্যাক্ট (এমসিওসিএ) আইন জারি হয়।
ছোটা রাজন, অরুণ গাওলি এবং আবু সালেমের মতো অনেক গ্যাংস্টারকে গ্রেপ্তার করা হয়। অশ্বিন নায়েক আন্ডারওয়ার্ল্ড ছেড়ে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার হন। দাউদ ইব্রাহিমের ছোট ভাই ইকবাল কাসকারকে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে নিয়ে এসে বিচারের মুখোমুখি করার পর থেকে ডি কোম্পানি মুম্বাইতে একটিও গুলি চালায়নি। এমনকি রবি পূজারি, ইজাজ লাকদাওয়ালা এবং বান্টি পান্ডের মতো ‘বি-লিস্ট’ গ্যাংস্টাররাও জেলে বন্দি।
‘সত্য’, ‘বাস্তব’ এবং ‘কোম্পানি’- এর মতো সিনেমায় চিত্রিত হয়েছে মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ড এই ভেঙে পড়ার চিত্র।
গত দুই দশকের এ নিরবতা ভাঙলো বিষ্ণোই গ্যাং।
কে খুন করল বাবা সিদ্দিককে
বাবা সিদ্দিক হত্যার পরপরই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিন বন্দুকবাজের মধ্যে হরিয়ানার বাসিন্দা গুরমাইল সিং (২৩) আর উত্তরপ্রদেশের ধরমারাজ কাশ্যপকে (১৯) ধরতে পারে পুলিশ। এদের সঙ্গে থাকা আরেক বন্দুকধারী উত্তর প্রদেশেরই শিব কুমার গৌতমকে ধরতে পারেনি পুলিশ। তবে এরা সবাই বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত এবং বাবা সিদ্দিকিকে হত্যার দায়ও এই গ্যাংয়ের একজন শুভম লোনকার স্বীকার করেছে ফেইসবুক পোস্টে। শুভমের ভাই প্রাভিন লোনকারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, তিনিও বিষ্ণোই গ্যাংয়ের অংশ।
রোববার ফেসবুকে ‘শিবু লোনকার’ নামে নিজেরই একটি অ্যাকাউন্ট থেকে শুভম লোনকার ফেইসবুকে লিখেন, বাবা সিদ্দিকের সঙ্গে সন্ত্রাসী দাউদ ইব্রাহিম ও অভিনেতা সালমান খানের সংশ্লিষ্টতা ছিল। এ কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি দাবি করেন, এছাড়া হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরেকটি কারণ অনুজ থাপান নামের তাদেরই এক সহযোদ্ধার পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু।
২০২৩ সালে সালমানের বাড়ি গ্যালাক্সি অ্যাপার্টমেন্টের সামনের এলাকায় বিষ্ণোই গ্যাং-এর সদস্যরা এই নায়ককে হত্যার জন্য যায়। সেখানে দুইপক্ষের গোলাগুলিও হয়। সালমান খানের বাড়ির বাইরে গুলি চালানোর অভিযোগে থাপানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে পুলিশের হেফাজতে তার মৃত্যু হয়।
সিদ্দিকি হত্যা, সালমান খান এবং দাউদ ইব্রাহিম
বাবা সিদ্দিকি হত্যায় অভিনেতা সালমান খানের নাম আসছে মূলত ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে তার কৃষ্ণহরিণ শিকারকে কেন্দ্র করে। রাজস্থানের যোধপুরে সালমান খান ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ সিনেমার শুটিংয়ের ফাঁকে ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর দুইটি কৃষ্ণ বা কালো হরিণকে গুলি করে হত্যা করেন। এর ঠিক ১২ দিন পর ২৮ সেপ্টেম্বরে ঘোডা এলাকার একটি ফার্মে আরেকটি কৃষ্ণহরিণ তিনি শিকার করেন।
বিলুপ্ত প্রজাতির এ হরিণ বিষ্ণোই ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। তারা মনে করেন, হিন্দুদের বিষ্ণোই গোত্রের প্রবক্তা ভগবান জাম্বেশ্বরের পুনরুত্থানের প্রতীক কৃষ্ণহরিণ। এছাড়া ভারতের বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ীও সালমান বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকায় থাকা ওই হরিণ শিকারের কারণে দোষী সাব্যস্ত হন। এর জন্য জরিমানা দিয়েছেন তিনি। জেলও খেটেছেন। তবে রাজস্থান আদালতের দেয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ শাস্তি নয়। আর এর জন্য তিনি কখনো বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমাও চাননি।
বিষ্ণোই গ্যাং ধর্মীয় পবিত্রতা নষ্টের কারণ দেখিয়ে তাই সালমানকে হত্যা করতে চাইছে। সালমান খানের বাড়ি পূর্ব বান্দ্রায়, যেটি আবার সিদ্দিকির নির্বাচনী ও বেড়ে ওঠার এলাকা। সালমানের ওপর এ বছর এপ্রিলে হামলার পর বাবা সিদ্দিকি তার নিরাপত্তার জন্য পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারই জের হিসেবে তাকে হত্যা করা হল বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
তবে মামলা এত সহজও নয়। কেননা, ২০১৩ সালেই ‘ডি কোম্পানি’ ও দাউদ ইব্রাহিমের দলের সঙ্গে সিদ্দিকি জড়িয়ে পড়েছিলেন ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে। রাজনীতির বাইরে সিদ্দিকির রিয়াল এস্টেট ব্যবসাও ছিল। বান্দ্রা এলাকায় প্রভাব খাটিয়ে এর আগে বস্তিবাসীদের জন্য করা আবাসন প্রকল্পের টাকা ও ফ্ল্যাট কৌশলে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে। ভারতীয় গণমাধ্যমের অপরাধ প্রতিবেদকদের কেউ কেউ বলছে, দাউদ ইব্রাহিম কৌশল খাটিয়েও বিষ্ণোইদের সিদ্দিকিকে হত্যার জন্য লেলিয়ে দিতে পারেন।
লরেন্স বিষ্ণোইয়ের বলিউড মিশন বনাম সালমান খান
৩১ বছর বয়সী লরেন্স বিষ্ণোই পাঞ্জাবের ফেরজোপুর জেলার ধাতারানওয়ালি গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান। ২০১০ সালে চণ্ডীগড়ের ডিএভি কলেজে পড়ার সময় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে সে। পরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতিও নির্বাচিত হয় লরেন্স।
তবে কলেজে থাকার সময়েই তার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা হয়। সেটাই ছিল তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া প্রথম ফৌজদারি অভিযোগ। একই সময়ে একটি বাড়িতে জোর করে ঢোকার অভিযোগে আরেকটি এফআইআর দায়ের হয় তার বিরদ্ধে। ২০১২ সালে ভাটিন্ডায় প্রথম কারাবাস করে লরেন্স বিষ্ণোই।
মহারাষ্ট্র কন্ট্রোল অব অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যাক্টে অভিযুক্ত হওয়ার পর তাকে তিহার জেলে পাঠানো হয়। ২০১৩ সালে মুক্তসরের সরকারি কলেজ নির্বাচনে বিজয়ী এক প্রার্থী এবং লুধিয়ানা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে গুলি করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত লরেন্স। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ সংঘটিত করার অভিযোগ রয়েছে তার নামে। এসবের মধ্যে রয়েছে মাদক এবং চোরাচালান ব্যবসাও।
২০১৭ সাল পর্যন্ত মাত্র সাত বছরে ১৬টি গোলাগুলির ঘটনায় নাম জড়ায় লরেন্সের। এই সময়ে পাঞ্জাব, চণ্ডীগড়, রাজস্থান এবং হরিয়ানা, এই চার রাজ্যে মোট ৩৩টি মামলায় নাম জড়ায় পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র নেতার।
এর মাঝেই লরেন্স ফের শিরোনামে উঠে আসে সালমান খানকে খুনের হুমকি দেওয়ায়। একবার নয়, একাধিকবার বলিউডের এই সুপারস্টারকে হুমকি দেয় তার গ্যাং।
তারপরই ২০২২ সাল। পাঞ্জাব থেকে ২২৪ জন ভিআইপির নিরাপত্তা তুলে নেওয়ার পরের দিন গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় পাঞ্জাবি গায়ক ও রাজনীতিক সিধু মুসেওয়ালাকে। খুনের দায় স্বীকার করে বিষ্ণোই গ্যাং।
২০২৩ সালে সালমান খানকে খুনের ছক কাটেন লরেন্স। তবে সেবার ব্যর্থ হন। এ বছরের সেপ্টেম্বরে জনপ্রিয় পাঞ্জাবি গায়ক এপি ধিলোনের কানাডার বাড়ির বাইরে গুলি চালায় বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্যরা। লরেন্স অবশ্য নিজে জেলেই ছিলেন।
চাঁদা না দেওয়ার কারণে গত সেপ্টেম্বরে দিল্লির এক ব্যায়ামাগারের মালিক খুন হন। লরেন্সের দলই গুলি করে খুন করে তাকে।
এ রকম একজন নৈতিকতাহীন গ্যাংস্টার কি কেবল ধর্মীয় অনুভূতি ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে সালমান খানকে হত্যার জন্য পিছু নিবেন! এ প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় গ্যাংগুলোর অতীত বিশ্লেষণ করতে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো গ্যাংস্টারদের উত্থানের ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে বেশ কিছু কারণ বের করেছে।
প্রথমত, মুম্বাইয়ে দাউদের ডি কোম্পানি বা পুরনো চাঁদাবাজদের আধিপত্য ক্রমেই খর্ব হতে হতে নিঃশেষ প্রায়। এখন এসব সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেই সুযোগই নিতে চাচ্ছেন লরেন্স। আর এই আধিপত্য বিস্তারের জন্য ভীতি ছড়িয়ে দেয়াটা হচ্ছে প্রথম কাজ। তাই তিনি ও তার দল বাবা সিদ্দিকিকে টার্গেট করে এগিয়েছেন। সালমানের চেয়ে বাবা সিদ্দিকি এক্ষেত্রে সহজ কিন্তু মূল্যবান টার্গেট ছিল। আর এর মধ্য দিয়ে সালমান খানের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং বলিউডকেও খুব সহজে বার্তা দেয়া গেল।
এ প্রসঙ্গে ১৯৯১ সালে দাউদ ইব্রাহিমের শ্যালক ইব্রাহিম পার্কারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উদাহরণ হিসেবে টানা যেতে পারে। অরুণ গাওলি গ্যাংয়ের হাতে পার্কার খুন হয়েছিলেন, যদিও তিনি দাউদের গ্যাংয়ের সঙ্গেই ছিলেন না। একইভাবে দাউদের বড় ভাই সাবির আশির দশকে পাঠান গ্যাংয়ের হাতে খুন হয়েছিল। এমনকি অরুণ গাওলি তার বড় ভাই পাপা গাওলিকেও গ্যাং দ্বন্দ্বের কারণে হারিয়েছিলেন।
লরেন্স এ কৌশলটি অনুসরণ করছে বলে অপরাধবিজ্ঞানী ও প্রতিবেদকদের একাংশ মনে করছেন।
আবার লরেন্স বিষ্ণোই কারাগারে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেন। নিজের ক্ষমতার নজির হিসেবে কয়েক মাস আগে বিষ্ণোই কারাগারে তার সেলে বসেই ভিডিও কলের মাধ্যমে একটি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকারও দেন। অবশ্য জেল থেকে দল চালানো প্রথম গ্যাংস্টার নন তিনি। এর আগে অরুণ গাওলি এবং অশ্বিন নায়েকের মতো মাফিয়া ডনরা কারাগারে বসে তাদের গ্যাং পরিচালনা করেছিলেন।
তবে বিষ্ণোই গ্যাং এর সবচেয়ে আলাদা বা ব্যতিক্রম দিকটি হলো এর ‘ফ্রেশার’ অপরাধীর দল। আগে গ্যাংগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে অভিজ্ঞ সন্ত্রাসীরা অংশ নিত। বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সন্ত্রাসীরা অপেক্ষাকৃত অচেনা, তরুণ এবং তাদের অপরাধ সংশ্লিষ্ট তেমন কোনও রেকর্ড আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নেই বললেই চলে।
বিষ্ণোই গ্যাংয়ে ৭০০ থেকে ৮০০ ‘শ্যুটার’ বা ‘হিটম্যান’ রয়েছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর ধারণা। আর এদের বেশিরভাগই হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ এবং রাজস্থানের বাসিন্দা।
ন্যাশনালিস্ট ডন!
এর বাইরে মুম্বাইয়ের গ্যাং লিডারদের সঙ্গে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের আরেকটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাদের মতোই অন্তত দুটো ঘটনায় লরেন্স চেষ্টা করেছেন ‘জাতিকেন্দ্রিক ডন’ হয়ে সিম্প্যাথি পাবার। এর একটি হচ্ছে ২০২৩ সালে কানাডাতে খালিস্থান আন্দোলন কর্মী সুখদুল সিং ওরফে সুখখা দুনিকে-কে হত্যার দায় শিকার করে পাঞ্জাবি তথা ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ডন’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা এবং অপরটি বিষ্ণোই ধর্ম অবমাননার জন্য সালমানকে নিয়ত মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে রাখা।
এর আগে ছোটা রাজন ১৯৯৩ সালে মুম্বাইয়ের বোমা হামলার সঙ্গে জড়িতদের দেখামাত্র হত্যার উদ্যোগের কথা জানিয়ে একইভাবে ‘জাতীয় ডন’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন। আবার তারই পথ ধরে গ্যাংস্টার রাভি পুজারি এগিয়েছেন। ২০০৪ সালে রাভির লোকেরা মুম্বাই সন্ত্রাসঈ হামলার আসামীদের উকিল মাজিদ মেমনের গাড়িতে গুলি করে পুজারির ‘ন্যাশনালিস্ট ডন’ ইমেজ তৈরি করতেই। আবার দাউদ ইব্রাহিম ‘মুসলমানদের ত্রাতা’ সাজতে মুম্বাই সিরিজ হামলা চালিয়েছেন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে যোগসাজসে।
পরিশেষ
যাই হোক না, ‘ভয়’ হচ্ছে মাফিয়াতন্ত্রের মুদ্রা ব্যবস্থা। নিজের গ্যাং সম্পর্কে যত ভীতি ছড়ানো যায়, তত সহজে আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়া সহজ হয়, বেশি টাকা আসে। নব্বইয়ের দশকে মুম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ড ‘একজনকে হত্যা করুন, ১০০ জনকে ভয় দেখান’ নীতি অনুসরণ করে চলতো।
একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করে গ্যাংগুলো ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে, যা চাঁদাবাজিকে সহজ করে। একটি আঘাতের পর, যখনই গ্যাংস্টাররা ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্র নির্মাতা বা হোটেল মালিকদের কাছে চাঁদার জন্য ফোন দেয় তখন প্রায় নির্দ্বিধায় টাকা পেয়ে যায়। এমনকি পুলিশের কাছ পর্যন্ত যান না ভুক্তভোগীদের কেউ। এখন মুম্বাইতে সক্রিয় বিষ্ণোই গ্যাং একই পথ অনুসরণ করে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাই। আন্ডারওয়ার্ল্ডের কার্যকলাপের কারণে সেটি আবারও কি চূড়ান্ত ঝুঁকির দিকে যাবে?