এক ব্যাংক হিসাবে ১৩৪ কোটি টাকা লেনদেনের খবরে সংবাদের শিরোনাম হয়ে উঠেছেন সংবাদকর্মী মুন্নী সাহা। কোনও প্রতিবেদনের শিরোনাম- ‘মুন্নী সাহা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক একাউন্টে ১৩৪ কোটি টাকা জমা’। কোনোটির শিরোনাম- ‘মুন্নী সাহা সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে বেতনের বাইরে জমা হয় ১৩৪ কোটি’। কোনোটির শিরোনাম আবার সরাসরি- ‘মুন্নী সাহার একাউন্টে ১৩৪ কোটি টাকা’।
তিন দশক আগে সংবাদকর্মী হিসাবে মুন্নী সাহার যাত্রা যেখানে শুরু, সেই ভোরের কাগজের সাবেক মালিকদের টেলিভিশন স্টেশন দেশ টিভির ইউটিউব চ্যানেলেও এই খবরের শিরোনাম ছিল- ‘কয়েকশ কোটি টাকার মালিক সাংবাদিক মুন্নী সাহা’।
সরকার পরিবর্তনের পর চাপে থাকা মুন্নী সাহার ব্যাংক হিসাবে লেনদেন নিয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সূত্রের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এমন সব খবর আসার পর বুধবার তা নিয়ে সরগরম হয়ে ওঠে সোশাল মিডিয়া।
তবে মুন্নী সাহা দাবি করছেন, তাকে জড়িয়ে এসব প্রতিবেদনের শিরোনাম বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। কারণ ওই ব্যাংক হিসাব তার স্বামীর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের। সেখানে তিনি নমিনি হওয়া ছাড়া তার আর কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এসব অ্যাকাউন্টে ১৩৪ টাকা জমা হয়েছে বলে যে দাবি করা হয়েছে সেটি ভুল। আসলে এই পরিমাণ টাকা লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ লেনদেনই এম এস প্রমোশনের। এই হিসাবের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি শুরুর পর থেকে এর ব্যবসায়িক লেনদেন, কর্মীদের বেতন সব কিছু রয়েছে।”
এম এস প্রমোশনের কর্ণধার কবির হোসেন তাপসও দাবি করছেন, তার ব্যবসার সঙ্গে স্ত্রী মুন্নী সাহার কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই।
স্বামীর ব্যাংক হিসাবে এখন ১৪ কোটি টাকা জমা রয়েছে দেখে মুন্নী সাহা রসিকতা করে বলেন, “তবে তাপসের একাউন্টে মাত্র ১৪ কোটি টাকা স্থিতির কথা শুনে স্ত্রী হিসেবে আমি হতাশ। কারণ এতদিনে তাহলে সে কী ব্যবসা করল?”
প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনেগুলোতে বলা হয়, মুন্নী সাহার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবে বেতনের বাইরেও ১৩৪ কোটি টাকা জমা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় ১২০ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। স্থগিত করা হিসাবে স্থিতি আছে মাত্র ১৪ কোটি টাকা।
মুন্নী সাহার স্বামী কবির হোসেন তাপসের মালিকানাধীন এম এস প্রমোশনের হিসাবে এই অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়ার কথা বলা হয় প্রতিবেদনে।
মুন্নী সাহা বলেন, কবির হোসেন তাপস ২০০২ সালের দিকে যখন এমএস প্রমোশন চালু করেন, তখন প্রতিষ্ঠানের জন্য খোলা ব্যাংক হিসাবে তাকে নমিনি করা হয়েছিল।
“ব্যবসায়িক একাউন্ট খুলতে গিয়ে শুধু নমিনি হিসেবে আমার নাম দিয়েছেন। তার কোনও প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার কোনও পার্টনারশিপ নেই। আমার কোনও শেয়ার নেই, কিচ্ছু নেই। আমি তার কোনও গ্যারান্টারও নই।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার ২২ বছরে লেনদেন, মানে ট্রানজেকশন মাত্র ১৩৪ কোটি টাকা! ব্যবসায়ী হিসেবেও খুব সফল বলা যায় না।”
সংবাদপত্র-টেলিভিশনে দীর্ঘ দিন সাংবাদিকতা করে আসা মুন্নী সাহা নিজেকে নিয়ে এই সংবাদ প্রতিবেদনগুলো দেখে হতাশা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, “আজ দেশের অনেকগুলো নিউজ পোর্টাল এবং দৈনিকে আমার একাউন্টে কত টাকা তা নিয়ে কিছু মিসলিডিং হেডলাইন দেখে বিস্মিত হয়েছি। অনেকেই আমার একাউন্টে ১৩৪ কোটি টাকা- এমন ফটোকার্ড বানিয়ে ক্লিক নিচ্ছেন। যেখানে রিপোর্টে পরিষ্কার করেই লিখেছেন- মুন্নী সাহার স্বামীর বিজনেস একাউন্ট এম এস প্রমোশনসের লেনদেনের কথা। ‘লেনদেন ‘ শব্দটা আমাদের বন্ধুরা নিশ্চয়ই বোঝেন।
“কোনও কোনও রিপোর্টে কৌশলে লিখেছে যে, ৫ আগস্টের আগে ১২০ কোটি টাকা তোলা হয়েছে। সেটাও যে লেনদেন, মানে ২২ বছরের বেতন বিল, ভাড়া, খরচ সবকিছু বাবদ; ২২ বছরের প্রতি মাসে মাসে হিসাবে তোলা, সেটা এড়িয়ে শুধু ভুল বার্তা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে; সেটা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছি।”
ওয়ান ব্যাংকের ঋণখেলাপি হওয়ার অভিযোগ নিয়ে মুন্নী সাহা বলেন, “তাপস ওয়ান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ২০১৫ সালে। কিন্তু আরও আগে থেকেই সে ওয়ান ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের প্রচারণামূলক কাজ করেছেন। সেই সুবাদে তার সঙ্গে ব্যাংকটির সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
“সে যখন ব্যবসায়িকভাবে বেকায়দায় পড়ে, তখন ওয়ান ব্যাংক ঋণ দিয়ে তাকে সাহায্য করেছে বলে আমি জানি। অথচ এর সঙ্গেও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে জড়ানো হয়েছে।”
জনৈক মাহফুজুল হকের মালিকানাধীন প্রাইম ট্রেডার্সের সঙ্গে এম এস প্রমোশনের ব্যাংক লেনদেনের বিষয়ে মুন্নী সাহা বলেন, “মাহফুজুল হককে চিনি না আমি। এ বিষয়ে কিছুই জানি না।।”
মুন্নী সাহার স্বামী কবির হোসেন তাপস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার মূলত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ব্যবসা। আর প্রাইম ট্রেডার্সের ব্যবসা চাল-ডালের। চট্টগ্রামে আমি যখন কোনও ইভেন্টের কাজ করতাম, তখন তাদের কাছ থেকেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতাম।”
২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আলাদা তিনটি চেকের মাধ্যমে এম এস প্রমোশনের হিসাব থেকে প্রাইম ট্রেডার্সের হিসাবে ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা স্থানান্তরের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “এক দিনে এই লেনদেনের কথাটি একেবারে মিথ্যা। এটা ওই বছর তাদের সঙ্গে আমার সারা বছরের লেনদেন ছিল হয়ত। এতদিন পর পুরো বিষয়টি আমার মনে নেই।”
ওয়ান ব্যাংকের ঋণের বিষয়ে তাপস বলেন, “এটা কোনও সরাসরি ঋণ নয়। আমি ওয়ার্ক অর্ডারের বিনিময়ে ঋণটি নিয়েছিলাম। সেই ঋণের কিস্তি এখনও নিয়মিত শোধ করছি আমি।
“আমি খুব ছোট একজন ব্যবসায়ী। আমার প্রমোশনস বিজনেস একাউন্টের নমিনি মুন্নী সাহা। শুধু ওটুকুই। আমার ব্যবসার সাথে মুন্নী সাহার কোনও সম্পৃক্ততা নেই। যে অর্থের কথা বলা হয়েছে তা আমার টোটাল ব্যবসার লেনদন। একসাথে কখনই এত টাকা ছিল না। সুতরাং ১২০ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না,” বলেন তাপস।
গুলশান-তেজগাঁও লিংক রোড এলাকায় নিকেতনে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি থাকার কথাও এসেছে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনে।
এই বাড়ি নিয়ে মুন্নী সাহা বলেন, “রোজা গ্রীণ একটি বাড়ি নয়, এটা সোসাইটি। এই ভবনে ১২৬টি ফ্ল্যাট আছে। তার মধ্যে ছোট্ট একটি ফ্ল্যাট কিনেছি আমি কিস্তিতে।
“রোজা গ্রীণের মালিক আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ। আমি যখন ফ্ল্যাট নিই তখন আমার ৩ রুমের ফ্ল্যাটের প্রয়োজন ছিল। একটি কক্ষ আমার নিজের জন্য, একটি মায়ের জন্য, আরেকটি আমার ভাইয়ের জন্য। কিন্তু তখন সেখানে ৩ রুমের আর কোনও ফ্ল্যাট অবশিষ্ট ছিল না, শুধু ২ রুমের ছোট ফ্ল্যাট ছিল। তখন আমার চাহিদা শুনে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার ছোট দুটি ফ্ল্যাটকে একসঙ্গে করে আমাকে দেয়।”
২০০৭ সাল থেকে ফ্ল্যাটটির কিস্তি দেওয়া শুরু করে সব অর্থ পরিশোধ তরে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেই ফ্ল্যাটটিতে থাকা শুরু করেন বলে জানান মুন্নী সাহা।
এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তবে এই রিপোর্ট প্রকাশে ভালো হয়েছে আমার। আমি নিজেকে ক্লিয়ার করতে পারছি। ফেইসবুকে অনেকে বলবলি করেন, আমি নাকি ২৮-৩০টা ফ্ল্যাটের মালিক। আমার সেই ফ্ল্যাটগুলো কোথায়? মাত্র ১টার কথা লেখা হলো কেন?”
অথচ আমি তখন নিষিদ্ধ ছিলাম
ভোরের কাগজ দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু হলেও ২০০০ সালে একুশে টেলিভিশনের মাধ্যমে গোটা বাংলাদেশে রিপোর্টার হিসাবে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন মুন্নী সাহা। একুশে টিভি বন্ধ হওয়ার পর তিনি যোগ দেন এটিএন নিউজে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নানাজনের করা ‘ফ্যাসিবাদের দোসর সাংবাদিক’দের তালিকায় মুন্নী সাহার নামও আসে।
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে গুলিতে শিক্ষার্থী নাঈম হাওলাদার (১৭) নিহত হওয়ার ঘটনায় যে মামলা করেন তার বাবা, সেখানে শেখ হাসিনা, তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে মুন্নী সাহাসহ ৭ সাংবাদিককে আসামি করা হয়।
গত ৩০ নভেম্বর কর্মস্থলের নিচে কারওয়ান বাজারে একদল ব্যক্তি মুন্নী সাহাকে আটকালে পুলিশ গিয়ে তাকে হেফাজতে নেয়। পরে অবশ্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মুন্নী সাহা বলেন, “বিগত সরকারের দোসর হিসেবে ট্যাগ দিলেও গত ১০ বছর আমি এবং আমার মত আরও দুয়েকজন সেলিব্রিটি সাংবাদিক সরকারি অনুষ্ঠান, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্স কাভার করার তালিকায় নিষিদ্ধ ছিলাম। ‘এক টাকার খবর’ নামের অনলাইনের অনুমতিপত্রও সাবেক তথ্যমন্ত্রী দেন নাই।
“সাংবাদিক হিসাবে কোনও সরকারি পদ-পদবি নেওয়ার সুযোগ আমাকে নিতে হয়নি বলে আমি গর্বিত। প্রধানমন্ত্রীর ইন্টারভিউ বা সালমান এফ রহমানের মুখের ওপর কড়া প্রশ্ন করায় নানান সময় আমাকে যে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে, সেটা আমি সাংবাদিকতার শক্তিই মনে করি।”
ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেও হেনস্থার শিকার হওয়ার কথা তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক বলেন, “সাহা পরিবারে জন্ম বলে আমাকে ভারতের দালাল বলতে মুখিয়ে থাকা মানুষগুলো অন্তত এই সরকারের স্বচ্ছ অনুসন্ধান থেকে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, কতটা অন্ধত্ব নিয়ে আমার ওপর অবিচার করেছেন। যেটা গত ১৫/১৬ বছর ধরেই আমাকে সহ্য করতে হয়েছে।
“বিগত সরকারের সময় আমি বারবার এসব মিথ্যাচারের ব্যাপারে, সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যারাসমেন্টের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেও ফল পাইনি। বরং এই সরকারের স্বচ্ছতার প্রক্রিয়ায় বিষয়গুলো তদন্ত হওয়াতে আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বস্তি বোধ করছি।”
“আমাকে নিয়ে যা যা ঘটছে, তা ব্লেসিংস ইন ডিজগাজড হিসাবে গ্রহণ করছি। যদিও আমাকে স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে ট্যাগ দিয়ে মামলা দেওয়া হয়েছে, গত ১৪/১৫ বছর ধরেই সোশাল মিডিয়ায় আমাকে নিয়ে যে অপপ্রচার চালানো হয়েছে, তার পুরোটাই যে ভুল, তা অন্তত এ ধরনের ইনভেস্টিগেশনে প্রমাণিত হলো,” বলেন তিনি।
তবে শুধু তার নামের জন্য ব্যবসায়ী হিসাবে স্বামীকেও সামাজিক হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে বলে জানান মুন্নী সাহা।
তিনি বলেন, “যে কোনও রাজনৈতিক পালাবদলে বাংলাদেশ ব্যাংক ইন্টিলেজেন্স ইউনিট যে কারোরই হিসাব চাইতে পারেন। সেই তালিকায় সাংবাদিক হিসেবে অনেকের সাথে আমার নাম ছিল। এবং কর্তৃপক্ষ দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে অনুসন্ধান করেছে বলে আমার বিশ্বাস।
“একজন সংবাদকর্মী হিসেবে মনে করি, বাংলাদেশের যে কোনও ব্যবসায়ীর ২২ বছরের ট্রানজেকশন ১৩৪ কোটি টাকা এবং সঞ্চয় ১৪ কোটি টাকা, কোনও গুরুত্বই বহন করে না। বিভিন্ন মিডিয়ার সংশ্লিষ্টরা মনে মনে হলেও স্বীকার করবেন যে, এমন মিথ্যা শিরোনাম তারা করেছেন, কী আর্ন করার জন্য?”
মুন্নী সাহার ব্যাংক হিসাব নিয়ে তদন্তের কোনও তথ্য বিএফআইইউ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। কোনও সংবাদ মাধ্যমে বিএফইউর কোনও কর্মকর্তার কোনও বক্তব্যও আসেনি। সকাল সন্ধ্যা চেষ্টা চালিয়েও কারও কোনও বক্তব্য পায়নি।