চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে মো. মাসুদ রানা (২১) নামে এক যুবককে ও মো. রায়হান (১২) এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে মল্লিকপুর বাজারে আক্রান্ত হয়েছিলেন তারাসহ কয়েকজন। রক্তাক্ত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে নিচ্ছিল স্থানীয়রা। তবে পথেই মাসুদ ও রায়হান মারা যান।
তাদের নিহত হওয়ার ঘটনাটি এসেছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পাঁচ মাস আগে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ফেইসবুক পাতায়। সেখানে দাবি করা হয়েছে, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়ালে লেখার কারণে তাদের হত্যা করা হয়েছে।
মাসুদ ও রায়হান ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে সেই ফেইসবুক পোস্টে। অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় বসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে।
এদিকে আওয়ামী লীগ মাসুদ ও রায়হানকে যেভাবে চিত্রিত করছে, তা ঠিক নয় বলে জানিয়েছেন তাদের স্বজনরা।
পুলিশ বলছে, দেয়াল লিখন নয়, ফেইসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করাকে কেন্দ্র করে কিশোরদের দুপক্ষের সংঘর্ষে প্রাণ হারান রানা ও রায়হান।
নিহত মাসুদ চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার খলশী গ্রামের মো. এজাবুল হকের ছেলে। রায়হান একই গ্রামের বাগানপাড়ার আব্দুর রহিমের ছেলে।
আওয়ামী লীগ যেভাবে দেখাচ্ছে
আওয়ামী লীগের ফেইসবুক পাতায় মঙ্গলবার মধ্যরাতেই এক পোস্টে মাসুদ ও রায়হানের মৃত্যুর খবর দিয়ে লেখা হয়, “চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুই ছাত্রলীগের নেতা কর্মীকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়ালে লেখার অপরাধে #কুপিয়ে #হত্যা করা হয়েছে।”
সেখানে মাসুদ রানার পরিচয় দেওয়া হয়েছে- সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ইলেকট্রিকাল ডিপার্টমেন্ট শাখা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। সহ- সম্পাদক, নাচোল উপজেলা ছাত্রলীগ।
রায়হানের পরিচয় দেওয়া হয়েছে- কর্মী, নাচোল উপজেলা ছাত্রলীগ।
এই হত্যাকাণ্ডের জন্য জুলাই অভ্যুত্থানকারীদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে সেই পোস্টে লেখা হয়েছে- “এই দুইজনকে ফতেপুর ইউনিয়নের মল্লিকপুর বাজারে রাত আনুমানিক ১০:৩০ মিনিটে #কুপিয়ে #হত্যা করে ইউনূসের সমর্থক সন্ত্রাসীরা।”
দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সরকারের পতন ঘটে গত ৫ আগস্ট। অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা কারাগারে কিংবা অপ্রকাশ্যে থাকায় এই পোস্টের বিষয়ে তাদের কোনও বক্তব্য সকাল সন্ধ্যা জানতে পারেনি।
৫ আগস্টের পর থেকে চাপে থাকা আওয়ামী লীগ তাদের বক্তব্য-বিবৃতি ফেইসবুকে এলেও তা কোথা থেকে পরিচালিত হচ্ছে, তাও জানা যাচ্ছে না।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘ফ্যাসিবাদী’ আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে রাজনীতিতে ফিরতে দেওয়ার পক্ষপাতি নয়। তাদের চাপেই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ আমলে হাই কোর্টের যে রায় হয়েছিল, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সম্প্রতি আপিল বিভাগ তা স্থগিত করে।
আওয়ামী লীগ দাবি করছে, ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে। আর তার ধারাবাহিকতায় ‘জয় বাংলা’র পক্ষের মানুষের ওপর হামলা হচ্ছে।
কী বলছে মাসুদ-রায়হানের স্বজনরা
১২ বছরের রায়হান কোনও রাজনৈতিক দল কিংবা সংগঠনে জড়িত ছিল না বলে জানিয়েছেন তার বাবা আব্দুর রহিম। তার পাঁচ ছেলের মধ্যে সবার ছোট রায়হান। সে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত।
দেয়ালে স্লোগান লেখা নিয়ে রহিম সকাল সন্ধ্যার জিজ্ঞাসায় বলেন, “আমার ছেলে প্রতিবন্ধী। তার ঠোঁট ও তালু কাটা থাকায় ঠিকমতো কথাও বলতে পারে না। তাকে ‘ক’ লিখতে বললে ‘খ’ লিখে। সে জয় বাংলা লিখবে ক্যামনে?”
ছাত্রলীগে যুক্ত ছিল কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার ছোট্ট ছেলে; আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত কী, সেটাও জানে না। তারে ছাত্রলীগের কর্মী বানাইলো কারা?”
মাসুদ রানাকে আওয়ামী লীগ নাচোল উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক হিসাবে পরিচিত করলেও তা মিথ্যা বলে দাবি করেছেন তার বাবা মো. এজাবুল হক, তার ছোট ভাই মো. মোস্তাকিম বাবু এবং তার চাচাত ভাই মো. সুজন।
এজাবুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার ছেলে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলে আমরা তো জানতাম। আমার ছেলেটা সারাদিন কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। এরপর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান দেখার জন্য বের হয়। সেখানে কীসের গণ্ডগোলে তারে খুন করা হইলো, আমি জানি না।”
ভাই মোস্তাকিম বাবু সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার ভাই চাঁপাইনবাবগঞ্জ পলিটেকনিক্যালে পড়ত। ও শুধু পড়াশুনাই করত, কোনও রাজনীতি করত না।”
চাচাত ভাই মো. সুজন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার ভাই মারা যাওয়ার খবর শুনে শতশত মানুষ দেখতে আসছে, তাহলে সে কেমন ছিল বোঝেন। সে রাজনীতি করলে এলাকার কেউ জানবে না? এটা কখনও হয় নাকি।”
পুলিশ যা বলছে
‘জয় বাংলা’ লেখার কারণে মাসুদ ও রায়হানকে হত্যার খবরটি ‘ফেইক’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন নাচোল থানার ওসি মনিরুল ইসলাম।
তাহলে কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটল- জানতে চাইলে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ফেইসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করাকে কেন্দ্র করে এলাকার কিশোরদের দুই পক্ষের সংঘর্ষে এই ঘটনা ঘটেছে।”
এই ঘটনায় বুধবার বিকাল পর্যন্ত মামলা হয়নি। ময়নাতদন্ত শেষে নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। তাদের দাফনের প্রস্তুতি চলছে।
এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বুধবার দুপুরে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম সাহিদ।
তিনি বলেন, পুরনো বিরোধ ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় মাসুদ ও রায়হান খুন হয় বলে তারা জানতে পেরেছেন।
অতিরিক্ত এসপি আবুল কালাম বলেন, “নাচোলের খলশী গ্রামে পেয়ারাবাগানে কাজ করতেন সালাম ও শাহীন নামের দুই শ্রমিক। সম্প্রতি কাজ করার সময় শাহীন গোপনে সালামের প্রস্রাব করার ভিডিও ধারণ করে তা ফেইসবুকে পোস্ট করেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়।”
মঙ্গলবার রাতে সালামের সঙ্গে থাকার কারণেই রায়হান ও মাসুদ হামলায় পড়েছিলেন বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা আবুল কালাম।
তিনি বলেন, “মঙ্গলবার রাতে মল্লিকপুর গ্রামে গরুর হাট সংলগ্ন এলাকায় শহীদ জিয়া স্মৃতি সংঘ আয়োজিত বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান দেখতে আসেন সালাম ও তার সঙ্গীরা। সেখান থেকে ফেরার পথে রাত ১১টার দিকে মল্লিকপুর বাজারে শাহীন ও তার সহযোগীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাদের ওপর হামলা করেন।
“এতে গুরুতর আহত হন মো. মাসুদ, রায়হান, মো. সুমন, রজব আলী, মো. আরমান ও মো. ইমন। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে নেওয়ার পথে মাসুদ ও রায়হান মারা যান।”
গুরুতর আহত সুমনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি জানান, এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ দু’জনকে আটক করেছে। অন্যদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।