অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনাকে হটানোর পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হলেও যতটুকু কাজ করেছে, তাতে সন্তুষ্ট নন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।
আকাশচুম্বী জনপ্রত্যাশার মধ্যে কাজ করে যাওয়া এই সরকারেকে ১০ এর মধ্যে ৫ নম্বরের বেশি দিতে চাইছেন না তিনি।
যে ঐক্যের বলে গত আগস্টে কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটিয়েছেন, এখন সেই ঐক্যের সুতা ছিঁড়ে না গেলেও কিছুটা ঢিলা হয়েছে বলে স্বীকার করেন তিনি।
প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সরকারের মূল্যায়ন, রাজনৈতিক দল গঠনসহ নিজেদের পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন নাহিদ। বুধবার সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে, সেই প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র ছিলেন নাহিদ।
আন্দোলনের মুখ নাহিদের নাম টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে গত বছর বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ জনের তালিকায় উঠে আসে।
গত বছরের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা থেকে সেই সরকারের উপদেষ্টা বনে যান নাহিদ।
সেই সরকারের ছয় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর নেওয়া সাক্ষাৎকারে নাহিদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- জনপ্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পেরেছেন আপনারা? ১০-এর মধ্যে কত দেবেন?
জবাবে নাহিদ বলেন, “আমি ৫০ শতাংশের কিছু কম দেব।”
সেইসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ থাকলেও সদিচ্ছাটা সম্পূর্ণভাবে আছে। রাজনৈতিক দল, অভ্যুত্থানের শক্তি এবং সাধারণ মানুষের সহযোগিতা আরও পাওয়া গেলে সরকার আরও কার্যকর হতে পারবে।
“মানুষের অনেক প্রত্যাশা থাকতে পারে, পরিবর্তনের স্বাদ সবাই পেতে চায়। কিন্তু আমাদের কাজগুলো করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে।”
সংস্কার, বিচার এবং শহীদ পরিবার ও আহতদের পুনর্বাসন- এই তিনটি বিষয়ে এখন সরকারের অগ্রাধিকার বলে জানান তিনি। পাশাপাশি রুটিন ওয়ার্ক হিসাবে আইনশৃঙ্খলা ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণও কাজের মধ্যে রাখছেন।
“এই পাঁচটা জিনিসকে মাথায় রেখে আমরা কাজ করছি। কিন্তু এর মধ্যে যে নানা আন্দোলন ও দাবি-দাওয়া, এ বিষয়গুলো আসলে আমাদের কাজে অনেক ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। নানা আন্দোলন কিন্তু সেভাবে আগের মতো দমন করা হচ্ছে না। আমরা সেটা করতেও চাই না। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা হচ্ছে।”
‘মনে হচ্ছে চতুর্মুখী শত্রু’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সরকারও ‘অনেকটা বিব্রত’ মন্তব্য করে উপদেষ্টা নাহিদ বলেন, “মানুষ চেয়েছিল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিটা সামাল দেওয়া যাবে। কিন্তু এই সরকার তো আগের সরকারের ধ্বংসাবশেষের ওপর তৈরি হয়েছে।
“আমরা আমলাতন্ত্র, পুলিশকে যে জায়গায় পেয়েছি…সরকারকে সেই জায়গা থেকে উঠে দাঁড়াতে হয়েছে। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা, ষড়যন্ত্র।”
“আগে শত্রু মনে হতো একটা, এখন মনে হচ্ছে চতুর্মুখী। নানা ধরনের শত্রু আছে,” বলেন নাহিদ।
“যেভাবে চাঁদাবাজি বেড়েছে…মানুষের তো এটাও প্রত্যাশা ছিল যে গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হবে। যে দলগুলো অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের কর্মীরাই তো চাঁদাবাজিতে। সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা তো তাদের পক্ষ থেকেও লাগবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে শুধু গ্রেপ্তার করে বা আইনশৃঙ্খলা দিয়ে তো এটার পরিবর্তন হবে না।”
অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এখন দূরত্ব ও বিভক্তির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে নাহিদ বলেন, “অভ্যুত্থানের পর আমরা নিজেদের অনেক দলীয় স্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ইত্যাদিতে ঢুকে গেছি। এটার কারণে অনেক বিষয়ে আমরা এক থাকতে পারিনি।
“শুধু তো রাজনৈতিক দল নয়, এই যে এত এত আন্দোলন হচ্ছে, সবাই নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থের আন্দোলন করছে। আমাদের তো এখন জাতীয় স্বার্থ নিয়ে সবার এক হয়ে কাজ করা উচিৎ ছিল। সেই ঐক্যটাও দেখা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তেই নিজ নিজ স্বার্থ আদায় করে নিতে চাইছে।”
পরক্ষণেই তিনি বলেন, “তারপরও আমি মনে করি না যে ঐক্য পুরোপুরি বিনষ্ট হয়েছে। ভিন্নমত তৈরি হচ্ছে, সেটা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হচ্ছে।
“আমাদের আগের যে ট্র্যাডিশন (ঐতিহ্য), একেবারে বিরোধাত্মকভাবে প্রতিহিংসা, সেই জায়গায় আমরা যাচ্ছি না এখনও। সংস্কারের জায়গায় আমাদের কতটুকু ঐকমত্য হচ্ছে, সেটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হবে ঐক্য আসলে কতটুকু আছে আর কতটুকু নেই।”
‘বিএনপি ভুল বলছে’
বর্তমান সরকারকে অনির্বাচিত আখ্যা দিয়ে বিএনপির বক্তব্যের বিরোধিতা করেন নাহিদ।
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগও বলছে, এটা অনির্বাচিত, অবৈধ, অসাংবিধানিক সরকার। বিএনপিও যখন সে ধরনের বক্তব্য দেয়, তখন কিন্তু প্রশ্ন ওঠে সরকারকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা কী?
“বিএনপি যেটা বলার চেষ্টা করছে যে এটা অনির্বাচিত সরকার, এই কথাটা তো ভুল আসলে। এই সরকারের বৈধতা তো নির্বাচন নয়। কারণ, ক্ষমতার পটপরিবর্তন তো নির্বাচনের মাধ্যমে হয়নি, একটা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থানের সমর্থনই তো থাকে। সেটাই আছে এবং একটা অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য এসেছে।”
আওয়ামী লীগ যে দৃষ্টিতে সরকারকে দেখে ও ব্যাখ্যা করে, বিএনপি যদি সেই দৃষ্টিতেই ব্যাখ্যা করা শুরু করে, তাহলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন নাহিদ।
নির্বাচনের সময় নতুন সরকার গঠন নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথায় ‘এক-এগারো’র ইঙ্গিত পাওয়ার কথা এর আগে জানিয়েছিলেন নাহিদ।
সেই বিষয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, “বিএনপির মহাসচিব যে অর্থে নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলছেন… এই সরকার তো যথেষ্ট নিরপেক্ষ। সরকার বিএনপির সঙ্গে এক ধরনের আলোচনার মধ্য দিয়েই বড় সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে।
“যেভাবে নিরপেক্ষতার কথা বলা হচ্ছে, তাতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সরিয়ে আরেকটা সরকারের পরিকল্পনা বিএনপির আছে কি না বা বিএনপি এটা চায় কি না, সেই প্রশ্ন আসছে। যদি চেয়ে থাকে, সেটা একটা এক-এগারো টাইপের সরকার হবে।”
তবে বিএনপির মহাসচিব ‘খুব ইনটেনশনালি (উদ্দেশ্যমূলকভাবে)’ এটা বলেছেন বলে মনে করেন না নাহিদ।
আওয়ামী লীগ নিয়ে কী হবে?
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরতে না দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। সম্প্রতি উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও এই কথা বলেন, যিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেপথ্যে নেতা হিসাবে স্বীকৃত সামনে থাকা আন্দোলনকারীদের কাছে।
সেই বিষয়ে প্রশ্নে নাহিদ বলেন, “মাহফুজ আলম রাজনৈতিক জায়গা থেকে কথাটা বলেছেন। আমরা যারা গণঅভ্যুত্থানের প্রতিনিধিত্ব করছি, আমরাও মনে করি যে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বা নৈতিক অধিকার নেই এই দেশে এই নামে বা এই আদর্শ নিয়ে আর রাজনীতি করার।”
তবে এর সঙ্গে আরও বিষয় জড়িত থাকার কথা তুলে তিনি বলেন, “এটার লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কটা (আইনি কাঠামো) কী হবে, এ বিষয়ে সরকার এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়া এগোলে আদালত থেকে সুপারিশ আসতে পারে, নির্বাচন কমিশন থেকে সুপারিশ আসতে পারে এবং রাজনৈতিক দলগুলোরও মতামত থাকবে।
“এসব বিবেচনায় হয়ত আমরা আওয়ামী লীগের ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। তার আগে বিচার কার্যক্রমটা প্রধান। বিচারের মধ্য দিয়েই আমরা বুঝতে পারব, আওয়ামী লীগের দল হিসেবে অংশগ্রহণ (গণহত্যায়) কতটুকু, দলটির নেতা-কর্মীদের কত অংশ জড়িত এবং কীভাবে অপরাধটা সংঘটিত করেছিলেন।”
নতুন দল নিয়ে সময়ের অপেক্ষায়
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা নতুন রাজনৈতিক দল করতে যাচ্ছে। সেই দলের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে নাহিদের নাম আলোচনায়ও রয়েছে।
নাহিদ বলছেন, তারা নতুন দলে যোগ দিলে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেই তা করবেন। তবে এখনও চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
“উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমরা এখনও নিইনি। হয়ত আরেকটু সময় লাগবে। আমরা একটু বোঝার চেষ্টা করছি, কোথায় আমাদের ভূমিকাটা সবচেয়ে বেশি হবে- সরকারের ভেতরে নাকি বাইরে।”
নাহিদ জানান, ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয়ার্ধে নতুন দলের আত্মপ্রকাশের বিষয়ে চিন্তা করা হচ্ছে। ১৫ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এটা হতে পারে বলে তিনি জেনেছেন। এর নাম এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
উপদেষ্টাদের মধ্যে তিনজন ছাত্রেরে একজন নতুন দলে নেতৃত্ব দেবেন এবং বাকি দুজন আপাতত সরকারে থেকে যাবেন, এমনটাই হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে নাহিদ বলেন, “হতে পারে।”
আপনি কি নতুন দলে দায়িত্ব নিচ্ছেন- সে প্রশ্নে তিনি বলেন, “সরকার ছাড়ার সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত হয়নি। যদি সে রকম হয়, তখন…
“আমরা গণঅভ্যুত্থানের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে এসেছি। আমাদের কিছু অঙ্গীকার আছে। সেটা বাস্তবায়ন করে সরকার ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। সেই বিষয়টা এখন পুনর্বিবেচনা করতে হচ্ছে।”