বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে রাজপথ কাঁপানো ছাত্রনেতা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হওয়া নাহিদ ইসলামকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী টাইম।
গত মঙ্গলবার প্রকাশিত এ প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘হাউ নাহিদ ইসলাম বিকেইম এ ফেইস অব বাংলাদেশ’স রেভ্যুলেশন’।
প্রতিবেদনের শুরুতে টাইম ম্যাগাজিন বলেছে, দুই বছর আগে নাহিদ ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন। তখন তার থিসিসের বিষয় ছিল ‘কেন বাংলাদেশের কোনও ছাত্র আন্দোলন তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি’।
সেই থিসিসের উপসংহার কী টেনেছিলেন- তা মনে না থাকলেও এখন কিছু যায়-আসে না। ২৬ বছর বয়সী এই তরুণ ইতিহাস পাল্টে দিয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র আন্দোলনের সবচেয়ে পরিচিত মুখগুলোর একজন নাহিদ, যাদের নেতৃত্বে সম্প্রতি সারা বাংলাদেশে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। যার ধারবাহিকতায় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাকে একসময় বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারীদের মধ্যে একজন হিসেবে মনে করা হতো।
সেপ্টেম্বরের এক রবিবার বিকালে ঢাকায় তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে নিজের চেয়ারে বসে টাইমের সঙ্গে কথা বলছিলেন নাহিদ ইসলাম।
“হাসিনা একজন রক্তচোষা ও সাইকোপ্যাথ”, নির্লিপ্তভাবে টাইমকে বলেন তিনি।
নাহিদ ইসলাম কিছুদিন আগেও তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষক হিসেবে বাসায় টিউশন করাতেন। আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে বাধ্য হন। এখন তিনি দেশের আইসিটি ও মিডিয়া উপদেষ্টা।
জুন মাসে মুষ্টিমেয় ছাত্রদের সঙ্গে নাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন, প্ল্যাকার্ড হাতে লোকেদের রাস্তায় নামতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। হাইকোর্ট তখন একটি বিতর্কিত কোটা পুনর্বহাল করেছে, যা বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রবীণ সৈনিকদের পরিবারের সদস্যদের সরকারি চাকরি পেতে সমর্থন করেছিল। নাহিদ এবং তার সহকর্মীরা তার পরিবর্তে সবার জন্য একটি ন্যায্য সুযোগ দাবি করেছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তাল হয়েছিল। সেই সময়ে সরকার শেষ পর্যন্ত পিছু হটেছিল। এবারও আন্দোলন শেষ হয়ে যেত বলে মনে করেন নাহিদ ইসলাম।
কিন্তু তখনই নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর রাউন্ড গুলি চালাতে শুরু করে। ১৬ জুলাই, আবু সাইদ নামে আরেক ছাত্র নেতা কেবল একটি লাঠি হাতে পুলিশ কর্মকর্তাদের দিকে হাঁটার সময় গুলিবিদ্ধ হন।
“তার হত্যাকাণ্ড আন্দোলনের গেইম-চেঞ্জিং মুহূর্ত হিসেবে পরিণত হয়”, বলেন নাহিদ।
বিক্ষোভ দ্রুত দেশে ছড়িয়ে পড়ে। একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার, ক্রমবর্ধমান দাম এবং ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের মুখে হতাশায় থাকা জনগণ আন্দোলনকে স্বাগত জানায়।
অবশেষে বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগের দাবি তোলে। ৩ আগস্ট ছাত্ররা যখন এক দফা দাবি নিয়ে আসে, তখন নাহিদই তা ঘোষণা করেছিলেন। “হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে” এই ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
৫ আগস্ট যখন কয়েক লাখ লোক ঢাকার কেন্দ্রস্থলে শেখ হাসিনার বাসভবনে প্রবেশ করছিল, তখন তাকে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়। যেখানে তিনি নির্বাসনে রয়েছেন।
“কেউ ভাবতে পারেনি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে”, নাহিদ তার চেয়ারে দুলতে দুলতে বলেন একথা।
সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে ছাত্ররা হঠাৎ করেই ১৭ কোটি মানুষের দেশের দায়িত্ব নিতে শান্তিতে নোবেলজয়ী ৮৪ বছর বয়সী মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার অনুরোধ করেন।
টাইম বলছে, এই অর্থনীতিবিদ, যিনি তার ক্ষুদ্রঋণ ধারণা দিয়ে উন্নয়ন শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, হাসিনা সরকার কর্তৃক তার বিরুদ্ধে আরোপিত আইনি অভিযোগের কারণে তিনি নিজেই নির্বাসিত ছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিনি মামলা থেকে খালাস পান।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ইউনূস এখন নাহিদের বস। তবে এটা শুধু ছাত্ররা চেয়েছিল বলে।
কে কার কাছ থেকে আদেশ নিচ্ছেন- জানতে চাইলে নাহিদ ইসলাম হাসতে হাসতে বলেন, “বড় বড় সব সিদ্ধান্ত আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই নেন ইউনূস।”
নাহিদ ইসলাম মন্ত্রণালয়ে তার ডেস্কে একটি লাল ল্যান্ডলাইন দেখিয়ে বলেন, ‘ভিআইপি ফোন’।
এরপর একটু নড়ে বসে বলেন, “এটা দিয়ে কী করব আমি জানি না। আমি ড. ইউনূসকে হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট করি।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক সপ্তাহে তার জীবনে ঘটে যাওয়া সব কিছু নিয়ে নাহিদ এখনও অবাক হন। তবে এতে তার নির্লিপ্ত আচরণে পরিবর্তন আসেনি।
নাহিদের থেকে বয়সে বড় ব্যক্তিগত সেক্রেটারি তার স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য নথিপত্র নিয়ে ঘরে-বাইরে ছুটে চলেছেন। নাহিদের দুটি মোবাইল ফোন অনবরত বাজছে এবং দর্শনার্থীরা ভোরবেলা পর্যন্ত তার বাসভবনে আসেন।
তার বাসভবন অপ্রত্যাশিতভাবে ঢাকার একটি অভিজাত এলাকায়। যেখানে দর্শনার্থীদের জন্য ঘরটি একটি ঝাড়বাতি এবং সাদা মখমলের সোফা দিয়ে সজ্জিত, যা নাহিদের পুরানো অ্যাপার্টমেন্টের সমান।
সমাজবিজ্ঞানের স্নাতক নাহিদ সবসময় সরকারের বিরুদ্ধে ছিলেন। তার জন্ম ঢাকায়, বাবা শিক্ষক।
২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রথম সপ্তাহেই সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনের প্রান্তে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন নাহিদ। ২০১৮ সালে ক্যাম্পাসের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন এবং পরে সমবয়সীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্র সংগঠন, গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি গঠন করেছিলেন।
কিন্তু তিনি এই বছরের জুলাই মাসে বৃহত্তর জনসাধারণের কাছে প্রথম পরিচিত হন। তিনি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা অপহরণ ও নির্যাতনের শিকারও হন। যারা সরকার বিরোধীদের জোরপূর্বক গুমের জন্য কুখ্যাত। এক রাতে, প্রায় ৩০ জন সাধারণ পোশাকধারী অফিসার এক বন্ধুর বাড়িতে হাজির হয়, যেখান নাহিদ ইসলাম লুকিয়ে ছিলেন গ্রেপ্তার এড়াতে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, তারা তার মাথায় কালো কাপড় পরিয়েছিল, তারপর তারা তাকে বলেছিল: “তুমি পৃথিবী আর কখনও দেখতে পাবে না।”
নাহিদের ধারণা, তাদের গোপন কারাগারগুলোর একটিতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা তাকে মারধর করে। যা দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল, তা লোহার রডের মতো অনুভূত হয়েছিল। আঘাতে হাত ও পায়ে ক্ষত হয়েছিল। বেদনা, যন্ত্রণাদায়ক শব্দ এবং তার দিকে একটি চকচকে উজ্জ্বল আলো রাখা হয়েছিল। তার মাথা ঘুরছিল। এক পর্যায়ে মাঝেমধ্যেই অচেতন হয়ে পড়ছিলেন।
তারা জানতে চেয়েছিল, “মাস্টারমাইন্ড কে? টাকা আসছে কোথা থেকে”, বলেন নাহিদ ইসলাম। এর একদিন পরে তাকে একটি সেতুর পাশে ফেলে দেওয়া হয়।
“গোয়েন্দা বিভাগ আমাদের আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে পরিচিত মুখ খুঁজছিল। কিন্তু আমাদের তো মাত্র একজন নেতা ছিল না। এটাই ছিল আমাদের প্রধান শক্তি”, বলেন নাহিদ ইসলাম।
নাহিদ ইসলাম আত্মবিশ্বাসের সাথে উপদেষ্টা হিসেবে তার নতুন ভূমিকা পালন করছেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেওয়া ছিল দলগত কাজ : “মিডিয়া সবসময় একটি মুখ চায়, কিন্তু আমি এই আন্দোলনের একমাত্র নেতা নই। আমরা অনেকেই ছিলাম।”
শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ক্ষমতার শূন্যতা দ্রুত পূরণ করতে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাহিদ ইসলামের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর সামিনা লুৎফা বলেন, ছাত্ররা যেদিন জনগণের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা করেছিল সেদিনই তিনি ‘অস্বাভাবিক রকম নার্ভাস’ নাহিদের দেখা পেয়েছিলেন। “ও খুব ছোট, এটি একটি বিশাল দায়িত্ব ছিল।”
অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। এই নতুন বাংলাদেশে, সবাই শুধু সেই ছাত্রদের কাছ থেকে সেরাটা আশা করে, যারা তাদের একজন “স্বৈরশাসক” থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। এখন অনেকেই খোলাখুলি কথা বলতে সাহস পাচ্ছে।
আলাপের এ পর্যায়ে আবার ফোন বাজতে শুরু করে নাহিদ ইসলামের। তাকে ঢাকার একটি হাসপাতালে মধ্যস্থতা করতে বলা হচ্ছে। যেখানে ছাত্ররা তাদের একজন সহকর্মীর কথিত অবহেলার কারণে মারা যাওয়ার পর ডাক্তারদের ওপর হামলা চালায়। এর জবাবে চিকিৎসকরা ধর্মঘট করছেন।
এরপর যখন তিনি ভাত ও মুরগি দিয়ে খাবার খাচ্ছিলেন, তখন আসল আরেকটা ফোন। এ ফোনটা ছিল প্রধান উপদেষ্টার ইউনূসের অফিস থেকে। সরকারি চাকরির দাবিতে বিক্ষোভরত কয়েকজনকে তার নম্বর দেওয়া যাবে কিনা- সে অনুমতি চাওয়া হচ্ছিল ওই ফোনে।
“অদ্ভুত একটা অবস্থা”, বলেন নাহিদ ইসলাম।
বিক্ষোভকারীদের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “একসময় বিক্ষোভকারী ছিলাম আমরা। এখন আমাদেরই বিক্ষোভকারীদের সামলাতে হবে।”
টাইম বলছে, ভোট কারচুপি, সমালোচকদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন এবং ভয়ের সাধারণ পরিবেশের মাধ্যমে টিকে থাকা ১৫ বছরের শাসনের পর তাদের কণ্ঠস্বর শোনানোর সাফল্যে বাংলাদেশিরা উজ্জীবিত। মানুষ এখন তাদের নতুন স্বাধীনতা ব্যবহার করছে। নারী হয়রানি মামলার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে। এমনকি ঢাকার উচ্চবিত্ত এলাকার স্কুলের ছেলেমেয়েদেরও প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে। তারা তাদের অধ্যক্ষকে পছন্দ করে না, তারা বলেছে।
এর কারণ ব্যাখ্যায় নাহিদ বলেন, “গত ১৫ বছর ধরে মানুষ কথা বলতে পারেনি, অবশেষে তারা সুযোগ পেয়েছে।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাহিদ ইসলামকে সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বলে মনে হচ্ছে।
দেশে স্বস্তির সাধারণ অনুভূতি থাকলেও উদযাপনের খুব বেশি সময় নেই। আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার নতুন সরকারের জন্য উদ্বেগের বিষয়। সামরিক বাহিনী বা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ জোরপূর্বক ক্ষমতা ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে- এমন একটি দীর্ঘস্থায়ী আশঙ্কাও রয়েছে। এটি প্রথমবারের মতো হবে না। বাংলাদেশে রাজনীতি ঐতিহ্যগতভাবে সহিংসতার শিকার হয়েছে।
নাহিদ বলেন, নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা এবং দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ। “আমরা এখানে অল্প সময়ের জন্য থাকব।”
তিনি বলেন, “আর কোনও দুর্নীতি ও সহিংসতা জনগণ চায় না। আমাদের নতুন প্রজন্মের কথা বোঝা উচিত। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।”