একসময় দেশের ফুটবলে ভরা যৌবন ছিল। তখন খেলা হতো সারা দেশে, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা ফুটবলাররা ঢাকার মাঠ মাতিয়ে হয়ে উঠতেন জাতীয় তারকা। এই পরম্পরায় চিড় ধরেছে ঝিমিয়ে পড়া জেলা ফুটবলের কারণে। এর মধ্যে আবার বিশেষ কিছু জায়গা বা অঞ্চল ছিল খুবই ফুটবল উর্বরা, তাদের ফুটবলার ছাড়া জাতীয় দলও কল্পনা করা যেতো না। ফুটবলের সেই আঁতুড়ঘরগুলোর ছন্নছাড়া রূপ ধরা পড়েছে সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বদিউজ্জামান মিলনের তদন্তে। চতুর্থ কিস্তি নারায়ণগঞ্জের ফুটবল নিয়ে।
জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার গোলাম গাউস প্রচন্ড হতাশ। নারায়ণগঞ্জ জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (ডিএফএ) আয়োজনে দ্বিতীয় বিভাগ লিগ মাঠে গড়াতে চান বাফুফের নব নির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। ১৫ জানুয়ারি শুরু হওয়ার কথা এই লিগ। কিন্তু ফুটবল লিগের জন্য কোনও মাঠই নাকি পাচ্ছেন না তিনি!
নারায়ণগঞ্জের ফুটবলে সমস্যাটা এক দিনের না। শুধু মাঠের অভাব নয়। অনিয়মিত ফুটবল লিগসহ নানা কারণে ফুটবলটা হারিয়ে গেছে নারায়ণগঞ্জ থেকে। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রচুর ফুটবল একাডেমি। বছর জুড়ে নিয়মিত অনুশীলন করলেও ছেলেপুলেদের খেলার সুযোগ মেলে না। নারায়ণগঞ্জের ফুটবল প্রগতির পথে বড় বাধা স্থানীয় সংগঠকরাই। খেলাটির প্রতি তাদের ন্যূনতম মায়া নেই। বছরের পর বছর খেলাহীন ডিএফএ’র চেয়ার দখল করে রেখে তারা ফুটবলের কবর রচনা করেছে।
ফুটবলার তৈরির ‘কারখানার’ দম ফুরিয়েছে
জাতীয় দলে এক সময়ে নিয়মিত ফুটবলার সরবরাহ করত নারায়ণগঞ্জ জেলা। ঢাকার মাঠে এই জেলার ফুটবলারের এত এত সমারোহ ছিল, এটাকে ফুটবল কারখানাই বলা যায়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে আলাউদ্দিন খান, দুলু আফেন্দি, হাজী আবুল কাশেমরা ঢাকা মাতিয়েছেন।
এরপর একে একে আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু, সম্রাট হোসেন এমিলি, মোহাম্মদ আমানউল্লাহ, মোনেম মুন্না, মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, গোলাম গাউস, নজরুল ইসলামদের দোর্দন্ড প্রতাপ ছিল জাতীয় দলে। তারাই ছিলেন লাল-সবুজের বড় তারকা।
এদের পথ ধরে কিছুদিন আগেও ছিলেন মোহাম্মদ সুজন, আজমল হোসেন বিদ্যুৎ, ওয়ালী ফয়সাল, মিঠুন চৌধুরীরা। যদিও বর্তমানে জাতীয় দলে নারায়ণগঞ্জের দাপট আর নেই। বর্তমানে শুধু তপু বর্মণ ও মোহাম্মদ হৃদয় খেলছেন জাতীয় দলে।
অবিশ্বাস্য নিষ্ক্রিয় নারায়ণগঞ্জ ডিএফএ
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন থেকে সবচেয়ে কাছের জেলা নারায়ণগঞ্জ আর এই ডিএফএ ফুটবলের কোনও কর্মকান্ড করে না। নারায়ণগঞ্জের ফুটবলের দুরবস্থার অন্যতম কারণ হিসেবে অনিয়মিত লিগ আয়োজনকে দায়ী করলেন জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার মিঠুন চৌধুরী। নারায়ণগঞ্জ ফুটবল একাডেমির কোচ মিঠুন বলেন, “গত ১২ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জে নিয়মিত জেলা ফুটবল লিগ হয় না। গত ৬ বছর কোনও লিগই হয়নি। ডিএফএ ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার নিষ্ক্রিয়তার কারণেই ফুটবল লিগ হয় না এখানে। এমনকি লিগ আয়োজনের কোনও উদ্যোগও নেই।”
স্থানীয় ফুটবলার আরিফ হাওলাদার বলেন, “মাসের পর মাস খেলোয়াড়রা শুধু অনুশীলন করে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ স্টেডিয়ামে। কিন্তু কোনও লিগ, টুর্নামেন্ট কিছুই হওয়ার খবর নেই। নারায়ণগঞ্জ পৌর স্টেডিয়াম থেকে অনেক বড় ফুটবলার তৈরি হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই মাঠে দীর্ঘদিন যাবৎ লিগ বা টুর্নামেন্ট কিছুই হয় না। দুঃখের বিষয় আরও ৬-৭ বছর আগে প্রথম বিভাগ লিগ খেলেছিলাম। এরপর লিগের কোনও খবর নেই।” এক যুগ ধরে এখানকার লিগ অনিয়মিত। এর মধ্যে ৬ বছর আগে হয়েছে সর্বশেষ লিগ।
কাঠগড়ায় সংগঠকরা
নারায়ণগঞ্জের ফুটবল দীর্ঘদিন ধরে জিম্মি হয়ে আছে এক শ্রেণীর সংগঠক নামধারী রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (ডিএফএ) সভাপতি তানভীর আহমেদ টিুট। একই অঙ্গে তার অনেক রূপ। তিনি নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সভাপতি, আবার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও পরিচালক ছিলেন। তবে টিটুর সব ক্ষমতার উৎস লুকিয়ে আছে অন্য পরিচয়ে-নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের শ্যালক।
২০১৬ সালে প্রথমবার নারায়ণগঞ্জ ডিএফএ’র সভাপতি নির্বাচিত হন তানভীর আহমেদ টিটু। তার সময়কালে ৮ বছরে মাত্র একবার ফুটবল লিগ হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। সেটা ২০১৮ সালে! কিন্তু অবনমন না থাকায় সেই লিগেরও বৈধতা দেয়নি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন।
টিটুর আগে দুই মেয়াদে ৮ বছর নারায়ণগঞ্জ ডিএফএর সভাপতি জেলার তারকা ফুটবলার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু। তিনিও নিয়মিত নারায়ণগঞ্জে লিগ আয়োজন করেননি। এমনকি ইপিলিয়ন নামের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান লিগের পৃষ্ঠপোষক হতে চাইলেও ফিরিয়ে দিয়েছে ডিএফএ। এরপর টিটু ডিএফএ’র সভাপতি হয়ে নারায়ণগঞ্জের ফুটবলকে আরও অন্ধকারে নিয়ে গেছেন।
ডিএফএ সম্পাদক নাসিরও সমান দায়ী
টিুট পালালেও এখনও টিকে আছেন নারায়ণগঞ্জ ডিএফএ’র সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম নাসির। ১৩ বছর ধরে তিনি এই পদ আঁকড়ে বসে আছেন। সুতরাং ব্যর্থতার দায় তার ঘাড়ে কিছু কম নয়। তবে দায় চাপাচ্ছেন স্থানীয় ক্লাব সংগঠকদের ওপর, “এখানে বেশিরভাগ ক্লাবের ফুটবলে আগ্রহ নেই। অনেকে ভাবে লিগ না খেললে তো আমার পদ নষ্ট হচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জে টাকার অভাব আছে এটা ভুল। ফুটবলের উন্নতির ক্ষেত্রে আসল সমস্যা হচ্ছে আন্তরিকতা।”
নারায়ণগঞ্জে প্রথম বিভাগে ১১টি ক্লাব ও দ্বিতীয় বিভাগে ১৬টি ক্লাব। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের লিগে কোনও অবনমন নেই। এজন্য লিগগুলো হয় আকর্ষণহীন। নাসিরের চোখে এর দায় ক্লাবগুলোর, “এখানে লিগে কোনও রেলিগেশন নেই । লিগ শুরুর আগে কিছু কিছু ক্লাব মিটিং করে বলে, লিগে অংশ নেব। এজন্য ২ লাখ করে টাকা চায়। আবার রেলিগেশন থাকতে পারবে না, এই শর্ত জুড়ে দেয়। এটা ফুটবলের জন্য কলঙ্কজনক ঘটনা।”
কলঙ্কের দায় ক্লাবগুলোর ঘাড়ে চাপিয়ে নাসিরের বেঁচে যাওয়ার উপায় নেই। সমস্যাটা হলো, ১৩ বছরের ডিএফএ সাধারণ সম্পাদকের ‘মাঝে-মধ্যে’ নিজেকে দায়ী মনে হয়, “মাঝে মধ্যে মনে হয় নারায়ণগঞ্জের ফুটবলের অবনতির জন্য আমিও বড় অপরাধী। দীর্ঘদিন ফুটবল মাঠে নেই নারায়ণগঞ্জে, এই দায় আমারও আছে।”
মাঠ ও সংগঠকের আকাল
চাষাড়া পৌর স্টেডিয়াম ছিল ফুটবলের। কিন্তু এই মাঠের মধ্যে ক্রিকেট ইনডোর তৈরি করা হয়েছে দুই বছর আগে। এতে ফুটবল মাঠের পরিসর কমে গেছে। নারায়ণ জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের নতুন সভাপতি শহীদ হোসেন স্বপন আক্ষেপের সুরে বলেছেন, “ডিএফএর আগের সভাপতি (তানভীর আহমেদ টিটু) ফুটবল মাঠ ধব্বংস করে ক্রিকেট মাঠ তৈরি করেছেন। আগে এই মাঠে চমৎকারভাবে ফুটবল খেলা যেত। এখন সেটা নাইন এ সাইডের মাঠ হয়ে গেছে। এক পাশে ক্রিকেট মাঠ তৈরি করে আরেক পাশে ফুটবল মাঠ ছোট হয়ে যাচ্ছে। এখানে কোনও বাথরুম নেই, ড্রেসিং রুম নেই। এই মাঠে কিভাবে ফুটবল আয়োজন করব? তাছাড়া মাঠের সমস্যা এখানে প্রকট।”
একই সঙ্গে ভাল সংগঠকেরও তীব্র অভাব। স্থানীয় একাডেমি বন্ধন ফুটবল কোচিং সেন্টারের কোচ মাহমুদ হোসেন সুজন বলেন, “নতুন কোনও সংগঠক নারায়ণগঞ্জে উঠে আসছে না, যারা সত্যি ফুটবল ভালবেসে কাজ করবেন।”
নারায়ণগঞ্জে ছিলেন ফুটবলপ্রেমী সংগঠক শান্তিরঞ্জন মুখার্জী, শৈলেশ আচার্য, গোবিন্দ আচার্য, কুতুব উদ্দিন আকসির, এ জেড এম ইসমাইল বাবু। এদের সবাই মারা গেছেন এবং বিকল্প কেউ আসেনি। সর্বশেষ কারিগর দুলু আফেন্দিও ২০১৫ সালে চলে গেছেন। তার হাতে সম্রাট হোসেন এমিলি, বাদল, জাকির, মোহাম্মদ আলী, আমান উল্লাহর মতো ফুটবলার ছাড়াও অনেক বিখ্যাত ক্রিকেটারেরও জন্ম হয়েছে।
একাডেমি আছে, খেলা নেই
নারায়ণগঞ্জে ছোট বড় মিলিয়ে ২০টি ফুটবল একাডেমি রয়েছে। সেখানে প্রতিদিন অনেক খুদে ফুটবলার দেখা যায়। তারা রোজ অনুশীলন করে কিন্তু কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূ্র্ণ ম্যাচ খেলে না। এসব একাডেমিতে প্রতিদিন বিভিন্ন বয়সভিত্তিক ফুটবলাররা অনুশীলন করে। কিন্তু অনুশীলনেই শেষ। কোথাও টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় না এই ফুটবলাররা। কোচ মিঠুন চৌধুরী দুঃখের সঙ্গে বলেন, “একে তো নিয়মিত লিগ না হওয়াতে ফুটবল খেলতে পারে না ছেলেরা। এর ওপর একাডেমির ফুটবলারদের জন্যও কোনও টুর্নামেন্ট আয়োজন করে না কেউ। খেলা না থাকলে কত আর প্র্যাকটিস করা যায়? এদের বয়স যখন ১৮-১৯ হয়ে যায় তখন অনেকে ঝরে পড়ে।”
বন্ধন ফুটবল কোচিং সেন্টারের কোচ মাহমুদ হোসেন সুজন বলেন, “সারা বছর ছেলেরা একটা টুর্নামেন্টের জন্য তাকিয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে আমরা কোচেস সমিতি নিজেদের মধ্যে ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনের চেষ্টা করি। এই টুর্নামেন্টে খেলিয়ে ফুটবলারদের সঠিক প্রতিভা যাচাই করা কঠিন। নিয়মিত লিগ না হলে কখনোই নারায়ণগঞ্জ থেকে ভালো মানের ফুটবলার বের হয়ে আসবে না।”
একাডেমির ফুটবলারদের খেলার সুযোগ দিতে না পারায় ডিএফএ সাধারণ সম্পাদক নাসিরও আক্ষেপ করলেন, “আমরা বরাবরই চাই, বাচ্চারা খেলুক। কিন্তু এখানে অনেক দুষ্টু প্রকৃতির লোক আছে। ইপিলিয়ন গ্রুপ ফুটবল ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম নামে নারায়ণগঞ্জে একটা একাডেমি ছিল। যেটা পরিচালানার জন্য সহায়তা করেছিলাম। কিন্তু এখানে কিছু দুষ্টু প্রকৃতির লোক বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলে সেই প্রকল্প বাতিল করেছে।”
তবু সোনালী দিনের আশা
২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটিতে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জের আরেক তারকা গোলাম গাউস। নিজের এলাকার ফুটবলের উন্নতিকে প্রাধান্য দিতে চান সাবেক এই ফুটবলার। ফিরিয়ে আনতে চান ফুটবলে নারায়ণগঞ্জের সোনালী দিন, “এতদিন নারায়ণগঞ্জে নিয়মিত ফুটবল হয়নি, কিন্তু এবার মাঠে ফুটবল রাখতে চাই। এজন্য যা করার সব করব। আশা করি, আগের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটবলার উঠে আসবে নারায়ণগঞ্জ থেকে।”