সেই ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। আরও এক বছরের বেশি সময় মেয়াদ ছিল তার। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে সভাপতির পদ থেকে বুধবারই (২১ আগস্ট) হয়তো পদত্যাগ করবেন তিনি। গত ১২ বছরে দেখে নেওয়া যাক নাজমুল হাসান পাপনের আলোচিত ১২টি বিতর্কিত কর্মকাণ্ড।
১ চন্ডিকা হাথুরুসিংহকে দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন নাজমুল হাসান পাপন। অথচ প্রথমবার দায়িত্বে থাকার সময় বিতর্কিত ছিলেন লঙ্কান এই কোচ। মেয়াদ পূর্ণ না করেই (২০১৪-২০১৭) বাংলাদেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব নিতে চলে গিয়েছিলেন তিনি। হাথুরু ফিরে আসার পর (২০২৩ জানুয়ারি) আরও তলানিতে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট।
২ শুধু রাজনৈতিক কারণে বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম ‘পরিত্যক্ত’ করে রাখা হয়েছে একপ্রকার। টেস্ট ভেন্যু খুলনা ও ফতুল্লা স্টেডিয়ামও পরিত্যক্ত হয়ে আছে সংস্কার না করায়। অথচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয় পূর্বাচলে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম নির্মাণের। এজন্য অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পপুলাসকে পরামর্শক ফি দেওয়ার কথা ছিল ৭৬ কোটি টাকা।
৩ তৃতীয় বিভাগ বাছাই ক্রিকেটের এন্ট্রি ফি ২০১৪ সালে ১ লাখ টাকা থেকে করা হয় ৫ লাখ টাকা। সঙ্গে শর্ত দেওয়া হয় সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের নিবন্ধনের। তাতে একাডেমি দলগুলো সরে যাওয়ায় বিসিবির কর্তাদের দুটি করে ক্লাব না খেলেই উঠেছে তৃতীয় বিভাগে। এমনকি তৃতীয় বিভাগ বাছাইয়ের চ্যাম্পিয়ন-রানার্সআপ নির্ধারিত হয়েছে টসের মাধ্যমে! ২০২২ সালের আগেও প্রিমিয়ার লিগের সেরা ৬ দল পেত ২টি করে কাউন্সিলরশিপ। এখন সবারই কাউন্সিলরশিপ একটা করে।
৪ ‘বঙ্গবন্ধু বিপিএল’ নামে ২০১৯ সালে ৮০ কোটি টাকা খরচ করে বিসিবি। করোনার জন্য ২০২০ সালে মুজিববর্ষ উদযাপনের বিশাল আয়োজন থেকে সরে এলেও ‘ক্রিকেট সেলিব্রেটস মুজিব ১০০’ নামে অনুষ্ঠান করে বিসিবির খরচ ২০ কোটি টাকা (নিয়ে আসা হয়েছিল এ আর রহমানকে)। ক্ষমতাসীন দল আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি করাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
৫ আইপিএলের পরই শুরু বিপিএল। অথচ একযুগে ফ্র্যাঞ্চাইজি এই লিগ একটা কাঠামোতে দাঁড় করাতে পারেনি পাপনের নেতৃত্বাধীন বোর্ড। অলাভজনক হওয়ায় দলগুলোর মালিকানা বদল হয়েছে একাধিকবার।
৬ সংবাদ সম্মেলনের জন্য বিসিবিতে আলাদা জায়গা আছে। তবে পাপন আলোচিত ছিলেন নিজের বাড়ির গ্যারেজে সংবাদ সম্মেলন আয়োজনের জন্য। নিজের বাড়িকে অফিসও বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। তার বাড়িতে নেৃতৃত্ব ছাড়েন মুমিনুল হক (২০২২ সালের মে)। এমনকি তামিম ইকবালের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণাও আসে বিসিবি সভাপতির বাড়ি থেকে (২০২৩ সালের আগস্ট)।
৭ আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা গঠন বা বিকেন্দ্রীকরণ করতে না পারাটা বড় ব্যর্থতা পাপনের। নানা সমালোচনার পর ২০২২ সালে ৭টি বিভাগের হাতে জেলাগুলোর ক্রিকেটের সব ধরনের কার্যক্রম রাখার জন্য আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা গঠন হলেও কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি তারা।
৮ পাপনের বিতর্কিত আরেকটা দিক ছিল অতিকথন ও সব ব্যাপারে নাক গলানো। খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত কথাও মিডিয়ায় বলতেন তিনি। একাদশ নির্বাচনের কাজটা করেন অধিনায়ক, কোচ আর টিম ম্যানেজমেন্ট। অথচ সেখানেও নাক গলাতেন পাপন।
৯ বিসিবির ফিক্সড ডিপোজিট ১ হাজার ৬৫ কোটি টাকা নিয়ে গর্ব করতেন পাপন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই টাকার সিংহভাগই এসেছে আইসিসি ও এসিসির লভ্যাংশ থেকে। অন্যান্য বোর্ডের মতো নিজেদের আয়-ব্যয়ের পূর্ণ বিবরণ অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে দেয়নি তারা। বছরের পর বছর একই অডিট প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করিয়েও বিতর্কিত হয়েছেন পাপন।
১০ খেলার মানের উন্নতি না হলেও বিদেশি হাইপ্রোফাইল কোচ নিয়োগে বেশি মনোযোগ ছিল পাপনের বোর্ডের। তাতে জড়িত ছিল কিছু পরিচালকের ‘কমিশন-বাণিজ্য’।
১১ বাজে উইকেট, নিম্নমানের বলে খেলা আর পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটকে ধ্বংসই করেছেন পাপন। আবাহনী ক্লাবকে বাড়তি সুবিধা দেওয়াটা ছিল দৃষ্টিকটু। আবাহনীতে জাতীয় দলের ১২ থেকে ১৫ জন ক্রিকেটার খেললেও তিনি এড়িয়ে গেছেন এসব।
১২ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বিসিবির প্রথম সভাপতি হয়েছিলেন প্রফেসর মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। ১৯৭৬ সালে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বিসিবির কোনও সভাপতিই ৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকেননি। নাজমুল হাসান দায়িত্বে ছিলেন টানা ১২ বছর। পছন্দের কাউন্সিলরদের কাউন্সিলরশিপ দিয়ে অনেকটা সাজানো নির্বাচনে বারবার জয়ী হয়েছেন তিনি। বিসিবির বার্ষিক সাধারণ সভাগুলো (এজিএম) হয়ে উঠেছিল সদস্যদের দামি উপহার পাওয়ার অনুষ্ঠান। এই ১২ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাটাই ছিল সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যাপার।